সন্তান কেমন হবে? তাকে লেখাপড়া শিখালাম, বড় করলাম, তার শখ-আহ্লাদ পূরণ করলাম। কিন্তু যদি শেষ বয়সে সে আমাদের খোঁজখবর না নেয়, আমাদের প্রতি উদাসীন হয়ে যায়—তাহলে কেমন লাগবে বাবা-মায়ের? এমনই এক মর্মস্পর্শী প্রশ্ন এবং হৃদয়বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়েছে 'সন্তান' সিনেমাটি। এটি পরিচালনা করেছেন রাজ চক্রবর্তী। 'সন্তান' একটি পারিবারিক নাটকীয় সিনেমা, যা পিতা-মাতা এবং তাদের সন্তানের মধ্যে ভেঙে পড়া সম্পর্কের জটিলতা, আবেগ এবং নৈতিক দ্বন্দ্বকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলে।
এই সিনেমা শুধু বিনোদনের মাধ্যমই নয় বরং সমাজের একটি বাস্তব চিত্র যা দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে এবং তাদের ভাবনায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
গল্পটি শরদিন্দু (মিঠুন চক্রবর্তী) এবং তার স্ত্রী মালা (অনসূয়া মজুমদার) নামে এক বৃদ্ধ দম্পতির জীবন নিয়ে আবর্তিত। তারা তাদের একমাত্র সন্তান ইন্দ্রনীলের (ঋত্বিক চক্রবর্তী) ওপর নির্ভরশীল, যে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করে এবং বিলাসবহুল জীবনযাপন করে। কিন্তু ইন্দ্রনীল তার বাবা-মায়ের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন।
মালার অসুস্থতা এবং অপারেশনের প্রয়োজন দেখা দিলে শরদিন্দু ছেলের কাছে সাহায্য চান, কিন্তু ইন্দ্রনীল বারবার তা প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি সে তার বাবাকে অপমান করে এবং অর্থ দিতে অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত শরদিন্দু আদালতে ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেন, যেখানে আইনজীবী ইন্দ্রাণী (শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়) তার পক্ষে লড়াই করেন।
গল্পের নাটকীয়তা এবং আবেগপ্রবণ মুহূর্তগুলো দর্শকদের গভীরভাবে আবদ্ধ করে রাখে।
বিশেষ করে মালার চরিত্রটি, যিনি মাতৃত্বের দায়িত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন, তা গল্পে একটি নতুন মোড় আনে। আদালতের ভেতরে-বাইরে চলা সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং আবেগময় সংঘাত গল্পটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনীল তার ভুল বুঝতে পারে এবং তার বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করে।
সিনেমাটির সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অভিনয়শিল্পীদের অসাধারণ পারফরম্যান্স। মিঠুন চক্রবর্তী শরদিন্দুর চরিত্রে যে আবেগ এবং সংগ্রাম ফুটিয়ে তুলেছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
অনসূয়া মজুমদার মালার চরিত্রে মাতৃত্বের মমতা এবং কষ্টকে এতটাই জীবন্ত করে তুলেছেন যে দর্শকদের চোখে পানি আনা ছাড়া উপায় থাকে না। ঋত্বিক চক্রবর্তী ইন্দ্রনীলের চরিত্রে স্বার্থপরতা এবং পরবর্তীতে অনুশোচনার যে দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, তা তার অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দেয়। শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ও আইনজীবী ইন্দ্রাণীর চরিত্রে বলিষ্ঠ এবং স্মরণীয় অভিনয় করেছেন।
সিনেমাটির গল্প যদিও কিছুটা পুরনো, রাজ চক্রবর্তীর পরিচালনা এবং চরিত্রায়ণের গভীরতা এটিকে একটি অনবদ্য সৃষ্টিতে পরিণত করেছে। দ্বিতীয়ার্ধ কিছুটা দীর্ঘ মনে হলেও, আবেগপ্রবণ দৃশ্যগুলো সেই দুর্বলতা পুষিয়ে দেয়। সিনেমাটি আমাদের সমাজের একটি বাস্তব চিত্র উপস্থাপন করে, যেখানে বাবা-মা এবং সন্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি এবং এর পরিণতি গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।
‘সন্তান’ শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি একটি নৈতিক বার্তা যা দর্শকদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এটি পিতা-মাতা এবং সন্তানদের তাদের সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। সিনেমাটি দেখার পর দর্শকরা তাদের নিজেদের জীবনের দিকে তাকাবে এবং পরিবারের মূল্যবোধকে নতুন করে উপলব্ধি করবে।
সব মিলিয়ে ‘সন্তান’ একটি আবেগময় ও হৃদয়স্পর্শী সিনেমা, যা পারিবারিক বন্ধন এবং দায়িত্বের গুরুত্বকে সুন্দরভাবে তুলে ধরে। এটি শুধু বিনোদনই দেয় না বরং জীবনের একটি গভীর পাঠও শেখায়।