<p>ফেসবুক, গুগলসহ ইন্টারনেটভিত্তিক বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাগে আনতে পারছে না সরকার। স্থানীয় কার্যালয় না থাকায় দেশের প্রচলিত আইনে তাদের কাছ থেকে কোনো ধরনের ট্যাক্স, ভ্যাট ও অন্যান্য রাজস্ব আদায় করা যাচ্ছে না। উল্টো হুন্ডিসহ আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে অর্থপাচার অব্যাহত রেখেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এতে একদিকে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারও হারাচ্ছে বড় অঙ্কের রাজস্ব।</p> <p>এদিকে রাষ্ট্রবিরোধী ও স্পর্শকাতর নানা বিষয়ে কনটেন্ট সরাতে বললেও তারা কানে তুলছে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পাশাপাশি দেশের উচ্চ আদালতও এই বিষয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে ব্যবস্থা নেওয়ার পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু আইনি কাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায় এসব নির্দেশনা কার্যকর করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাকে। এ রকম প্রেক্ষাপটে অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো কঠোর অবস্থানে যাওয়ারও দাবি উঠেছে। </p> <p>নিউজ কনটেন্টের জন্য ফেসবুককে মূল্য পরিশোধে বাধ্য করতে এবার অস্ট্রেলিয়ার পথে হাঁটছে কানাডাও। কানাডা সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ফেসবুক নিউজ কনটেন্টের জন্য মূল্য পরিশোধের ব্যাপারে তারাও আইন করতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুক যদি নিউজ প্রদর্শন বন্ধ করে দেয়, তার পরও কানাডা সরকার পিছু হটবে না বলে জানিয়েছেন কানাডার হেরিটেজ মন্ত্রী স্টিফেন গিলবল্ট। এ আইনের খসড়া তৈরির দায়িত্বে আছেন তিনি। আইনটি আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই অনুমোদন পাবে। মন্ত্রী বলেন, এ যুদ্ধে সামনের সারিতে থাকবে কানাডা। গত সপ্তাহে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে একটি আইন অনুমোদিত হয়। ওই আইনে নিউজ কনটেন্টের কারণে ফেসবুককে মূল্য পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। দেশটির সরকার বলছে, তারা আইন অনুযায়ী সামনে এগোবে।</p> <p>তথ্যপাচার ঠেকানো এবং দেশীয় মাধ্যমের প্রসারে ফেসবুক, গুগলের মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে চীন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার পরও ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ফ্রান্স ফেসবুকসহ ইন্টারনেট জায়ান্টগুলোর ওপর ডিজিটাল সেবা কর আরোপ করে আইন পাস করে। ওই আইন অনুযায়ী ফেসবুক, গুগল, অ্যাপলসহ বৈশ্বিক ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিক্রির ওপর ভিত্তি করে ৩ শতাংশ কর দিতে হয়। এই কম্পানিগুলোর ওপর ২০২২ সাল নাগাদ ডিজিটাল কর আরোপের পরিকল্পনা কানাডারও রয়েছে। ফেসবুকসহ ইন্টারনেট জায়ান্ট কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা যে দেশে ব্যবসা করে সেখানে যথাযথভাবে কর পরিশোধ করে না।</p> <p>জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কর ফাঁকির বিষয়টি এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে। স্বরাষ্ট্র ও তথ্য মন্ত্রণালয় এবং আমরা বিষয়টি কঠোরভাবে দেখছি। এটি এখন সবার জন্য কনসার্ন। শুধু কর ফাঁকিই নয়, দেশে ধর্মান্ধতা, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ইত্যাদি নিয়ে এসব মাধ্যমে জঘন্য ধরনের প্রচারণা করা হয়, যা থেকে বাদ যান না সেনাবাহিনী, পুলিশ, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। আমাদের জন্য মহাবিপজ্জনক কনটেন্ট সরাতে অনুরোধ করলেও ওরা সেগুলো সরায় না। দুনিয়ার কোথাও এমন কোনো প্রযুক্তি নেই, যেটি দিয়ে এই সমস্যার মোকাবেলা করা যায়। ফলে তাদের ঘাড়ে হাত দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। ঘাড়ে ধরার জন্য আমরা অন্য দেশ থেকে কিছু অভিজ্ঞতাও নিচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যন্ত্রণার চোটে ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, তুরস্ক, ভারত আইন করেছে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু এটি করা হয়েছে সাধারণ অপরাধের জন্য, যেখানে শাস্তির পরিমাণ কম। এ ধরনের বৈশ্বিক ছোটখাটো শাস্তি দিয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বাগে আনা যাবে না। এদের ভাতে মারতে, পানিতে মারতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি যত দূর জানি, এ বিষয়ে একজন আইন উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, আইনিকাঠামো শক্তিশালী হওয়া দরকার, যাতে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউবকে বিলিয়ন ডলার জরিমানা করা যায়।’</p> <p>মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা রাজস্ব বোর্ডেরও দৃৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বিজ্ঞাপন থেকে তারা টাকা নিচ্ছে। টাকাকে তারা ডলারে রূপান্তর করছে কী করে? এটা হুন্ডি কিংবা মানি লন্ডারিং ছাড়া বিদেশে নিতে পারার কথা না। তারা এ দেশ থেকে যে পরিমাণ আয় করছে, সেটার করও দিচ্ছে না। আমরা ইচ্ছা করলে যে কারো সাইট বন্ধ করতে পারি। তবে পুরো প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করাটাই আসল সমাধান নয়, আমরা যেটা বন্ধ করতে চাচ্ছি, সেটা যাতে বন্ধ করতে পারি সেই প্রযুক্তির খোঁজ করছি।’</p> <p>এদিকে অনলাইন বিজ্ঞাপনের নামে বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি নিয়ে যাচ্ছে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া। দেশে সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছাড়াও বিলের ওপর ৪ শতাংশ কর কাটা হয়। কিন্তু বিদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্বীকৃত কোনো অফিস কিংবা লেনদেনের বৈধ মাধ্যম না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কর আদায় কিংবা হুন্ডি প্রতিরোধ কঠিন হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য তাদের অনুমোদন নিতে হয় না। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোনো এজেন্ট বিজ্ঞাপনের ব্যয় পরিশোধের জন্য টাকা পাঠাতে চাইলে এই অনুমোদন লাগে। ‘কেস টু কেস’ ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ এই অনুমোদন দিয়ে থাকে।</p> <p>জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টিতে এনবিআর কাজ করছে। এনবিআরের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্প্রতি আমার কথা হয়েছে। তারা বৈধ উপায়ে টাকা নিচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশিত চ্যানেলে তাদের টাকা নিতে হবে। এটি ফেসবুকের সিঙ্গাপুর কার্যালয়ের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে আমরা বলেছি। তারা আমাদের সব কথা শোনে না।’</p> <p>টিভি টুডের এডিটর ইন চিফ মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফেসবুক গণমাধ্যম না, এটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা অস্ট্রেলিয়ার মতো চিন্তা করতে পারিনি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’</p> <p>বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, ‘পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের হিসাব রাখা যত সহজ, অনলাইন মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের হিসাব রাখা কঠিন। সব বিজ্ঞাপন সবাই দেখতে পাবে না। এ জন্য তাদের বাংলাদেশে অফিস চালু করতে বাধ্য করা যেতে পারে।’</p> <p>এদিকে ফেসবুকের বাংলাদেশ এজেন্ট এইচটিটিপুল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) যথাসময়ে ভ্যাট পরিশোধ না করায় ভ্যাট গোয়েন্দা বিভাগ এইচটিটিপুলের বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা করেছিল। এরপর তারা ৭৭ লাখ ৬২ হাজার টাকা বকেয়া ভ্যাট এবং এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা দেয়।</p> <p>এদিকে সার্চ ইঞ্জিন গুগল, ইয়াহু, ই-কমার্সের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউবসহ ইন্টারনেটভিত্তিক সব প্ল্যাটফর্ম থেকে কর, ভ্যাটসহ সব ধরনের রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। ওই সব কম্পানির অনুকূলে এ পর্যন্ত পরিশোধিত অর্থ থেকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এই রাজস্ব আদায় করতে বলা হয়। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রতি এক রায়ে এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন।</p>