আজ এত বছর পর এসে মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় বড় ধরনের ঘাটতি ছিল। কর্ণেল ফারুক ও রশিদ চক্র যে এই পরিকল্পনা করেছে, তার কিছুই আমরা টের পাই নাই কেন? এ সকল প্রশ্ন আমাকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়াবে।
বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধুকে হয়ত সতর্ক করে থাকতে পারে। কিন্তু দেশের ভেতরে এত গোয়েন্দা সংস্থা, এত বাহিনী, কেউই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র টের পেল না? এখন মনে হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই ঢিলেঢালা ছিল।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট পিজিআর প্রতিষ্ঠিত হলেও, উক্ত রেজিমেন্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল না। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসা একটি সেনা গোলন্দাজ ইউনিট। মোট কথা রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সকলকেই দায়ী করা যায়। এটি ছিল সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, যা হয়ত ইচ্ছাকৃত নয়। তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আমরা যারা ব্যক্তিগত স্টাফ ছিলাম - তাদের “নিরাপত্তা” বিষয়ে কোন দায় দায়িত্ব ছিল না। নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব বর্তায় প্রধান নিরাপত্তা অফিসারে উপর এবং তখনকার গার্ড রেজিমেন্টের উপর।
১৫ আগস্ট ঘটনার দিনই আমরা তিন এডিসি’র দায়িত্ব নির্ধারিত ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে সকালে বঙ্গবন্ধুর সমাবর্তনী অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল। তবে সকালবেলা ৬ টার দিকে গণভবনের ফখরুল ইসলাম নামের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা গণভবন থেকে আমাকে টেলিফোনে জানায়, “ধানমন্ডি ও মিরপুর রোডের দিকে গুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আপনারা কিছু শোনেননি?” আমি বললাম, শুনিনি। এরমধ্যে কোন কিছুর ভ্রক্ষেপ না করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। আমি মাশহুরুল হককে জানালাম, তিনি বললেন যাবেন। গাড়িতে উঠার আগে তিনি আমার হাতে একটি পিস্তল দিয়ে এটা সঙ্গে রাখতে বললেন, আমি অপর এডিসি লেঃ রাব্বানীকেও বললাম। তিনিও যাওয়ার কথা বললেন। আমরা তিনজনই সিভিল পোশাকে বঙ্গভবন থেকে একটি গাড়ি নিলাম। রাজা মিয়া নামের একজন ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিলেন। যখন নিউমার্কেট পার হয়ে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কে এলাম, তখন কালো ইউনিফর্ম পরিহিত কোরের লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমরা জানালাম, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাব। ওরা বলল, তাকে তো হত্যা করা হয়েছে। আমরা বললাম, কী বলছ? তোমরা কি পাগল? কিন্তু আমরা তাদের বাধা পেরিয়ে সামনে এগোলাম। এরপর কলাবাগানের কাছে ফের আরেক দল আটকাল। কৌশলে এ বাধাও পার হলাম। তখন তো কারফিউ চলছিল। রাস্তায় কোন সাধারন লোকজন ছিল না। বিদ্রোহী সেনাদের তৃতীয় দল আমাদের বাধা দিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে, সাংহাই চীনা রেস্তোরাঁর নিকটে ওরা আমাদেরকে গাড়ি থেকে নামিয়ে টেনেহিঁচড়ে লেকের পাড়ে নিয়ে আটকে ফেলল। আমাকে দেয়া হল পিঠে ও পেটে বিশাল জোরে কতগুলি ঘুষি, কেননা আমার পকেটে ছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশহুরুলের দেওয়া ছোট পিস্তলটি। এরপর তারা আমাদের সবার চোখ বেঁধে ফেলল। পিছমোড়া করে হাত বাঁধল। চোখ বেঁধে ফেলায় ভাবলাম, এটা হয়তো হত্যার আগের প্রস্তুতি। আমাদের আর নিস্তার নাই। ওদের কথাবার্তায় টের পেলাম, কর্মকর্তা গোছের কেউ কেউ ওখান দিয়ে আসা-যাওয়া করছিল। তাদের প্রশ্নের উত্তরে সেনারা বলল, ‘তিন গাদ্দারকে ধরেছি।’ একবার কর্ণেল ফারুকও ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেনারা তাঁকে আমাদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করল, তারা আমাদেরকে কী করবে ? তিনি আমাদের দুজনকে না চিনলেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাশরুল হককে চিনলেন। কর্ণেল ফারুক বললেন, “এদেরকে ধরে রাখো।”
এভাবে আমাদের চোখ বেঁধে সেখানে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা রাখার পর কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের বোন জামাই মরহুম মেজর শহীদুল্লাহ আমাদের অবস্থা দেখে মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করলেন এবং গণভবনে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমাদের চোখ খুলে দিয়ে একটি কক্ষে আটকিয়ে রাখা হলো। দিনটি ছিল শুক্রবার।
সন্ধ্যায় গণভবনের কম্পোটলার যিনি আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলেন, তিনি একটি গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিলে প্রহরারত সৈনিকদের ফাঁকি দিয়ে আমরা বঙ্গভবনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি, কর্নেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী ( পরে মেজর জেনারেল ) নতুন সামরিক সচিবের দায়িত্ব গ্রহন করেছেন। এরমধ্যে তিন বাহিনী থেকে তিনজন নতুন এডিসি নিয়োগ পেয়ে তাদের দেখলাম আমাদের জায়গায় ডিউটি করতে। আরো শুনলাম আমাদের অন্যত্রে পোস্টিং করা হয়েছে। কিন্তু হঠাত্ সন্ধ্যায় শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজনে আমাদের ডাক পড়ল। যাঁরা নতুন যোগদান করেছিল, তাঁদের ওই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের অভিজ্ঞতা ছিল না বলেই আমাদের ডাক পড়েছিল। তবে সারাদিনের ধকলে আমরা ছিলাম ভীষনভাবে ক্লান্ত। ভয়ে ভয়ে আমরা নতুন সামরিক সচিবকে রিপোর্ট করলাম। উনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন আমরা যেন শপথ অনুষ্ঠানটি ভালোভাবে করি। সে শপথ অনুষ্ঠানের একটি ছবিতে আমাকে অতি বিষন্ন এ দেখা যাচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল কতটা বিড়ম্বনায় ছিলাম।
এরপর বঙ্গভবনেই এক ধরনের বৈরী পরিবেশে আড়াই মাস কেটে গেল। আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কোনো দায়িত্ব ছিল না আমাদের। বঙ্গবন্ধুর প্রাক্তন এডিসি হিসেবে বঙ্গভবনে কর্মরত অন্যরা আমাদের এড়িয়ে চলত। কর্ণেল ফারুক ও কর্ণেল রশিদ বঙ্গভবনের তৃতীয় তলায় ভিআইপি রুমে থাকতেন। তাঁদের মধ্যে এক ধরনের অহংকার এসে গেল যে, ‘তারাই দেশ চালাচ্ছে।’ কিছুদিন যেতেই পুরো সেনাবাহিনী তাঁদের বিরুদ্ধে চলে গেল। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর জেষ্ঠ্য কর্মকর্তারা কোনোভাবেই তাঁদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে পারছিল না। যেহেতু সার্বিকভাবে সেনাবাহিনী এই সামরিক অভ্যুত্থানে জড়িত ছিল না, সেহেতু পুরো সেনাবাহিনী ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। বরং সেনাবাহিনী আড়াই মাস সময়ের মধ্যে অভ্যুত্থানকারীদের স্থানচ্যুতি করে দিয়েছিল। সুতরাং সেনাবাহিনীকে উক্ত সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করা যাবে না। কিন্তু সেনাবাহিনীর সিনিয়র কমান্ড কর্তৃক ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটার পর, ঘটনাস্থলে যাওয়া সকলেরই আকাংখিত ছিল। ঘটনার পর, স্থানীয় সেনা অধিনায়ক ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং সেনাবাহিনী পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিল। যেকোনো বিবেচনায়ই এটা ছিল একটি চরম ব্যর্থতা।
এরপর ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান হলো। সেটা একটি অন্যরকম স্মৃতি। তবে আমরা চেয়েছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সফল হোক। খুনিরা পালিয়ে গেল। তার আগে একটি বৈঠকে তো একজন সেনা কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছিলেন। তবে সেসময় উক্ত বৈঠকে আমরা পুরোনো এডিসিদের মধ্যে কেউ উপস্থিত ছিলাম না। চারদিকে থমথমে অবস্থা। বঙ্গভবনের বাইরে অরাজকতা চলছিল। নভেম্বর মাসের ৬-৭ তারিখে ‘সিপাহী সিপাহী’ ‘ভাই ভাই’ বলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলো। ইতিমধ্যে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হল। কিন্তু জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যা সম্পর্কে আমরা পুরো অন্ধকারে ছিলাম। পরে যখন জেনেছি তখন খুনিরা দেশ ছেড়ে চলে গেছে। জেল হত্যার বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। পরবর্তিতে বিচারপতি আবু সাদাত সায়াম রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলে, আমাদের বদলির আদেশ বাতিল করা হয় এবং সেনাসদরের আদেশক্রমে পূর্ববর্তী (এডিসি ) কার্যক্রমে ফিরে যাই।
আজকের দিনে বলতে চাই বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশাল হৃদয়ের একজন মানুষ। এডিসি হিসেবে আমরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যের মতো ছিলাম। সকালে বঙ্গভবন থেকে ৩২ নম্বরে আসতাম, রাতে ফিরে যেতাম। প্রতিদিন বাসায় গেলে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আমাদের খেতে বলতেন। তাঁর মাতৃসূলভ ডাকে বেশীর ভাগ সময়ই না খেয়ে আসতে পারতাম না। আর খেতে না চাইলেও বঙ্গবন্ধু খেয়ে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ছিল পিতা ও পুত্রের মত। তার সঙ্গে যারাই কাজ করেছেন, তিনি তাদের সবার পরিবারের খোঁজখবর নিতেন। নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী থেকে বঙ্গবন্ধুর আরও দুজন এডিসি ছিলেন। আমাদের তিনজনকে’ই তিনি খুব ভালোবাসতেন। কর্তব্যের তাগিদেই সেদিন আমরা তিনজন সামরিক কর্মকর্তা বঙ্গভবন থেকে তাঁর বাসার দিকে ছুটে গিয়েছিলাম। এই সাহসিকতার জন্য পরবর্তীতে কি এর কোন মূল্যায়ন হয়েছে এই প্রশ্ন আমাকে অনেকে করেন । আমি ব্যক্তিগতভাবে এতদিন পরও এই ঘটনার মূল্যায়নের জন্য কোন তদবির করিনি। এখানে সাহসিকতা ছাড়াও ‘কর্তব্যের খাতিরে সাড়া’ এ কথাটিই মুখ্য ছিল।
মোটকথা, বঙ্গবন্ধুকে আমরা বাঁচাতে পারি নাই, এই গ্লানি এবং মনোবেদনা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। তবে মূল্যায়ন, পদক, বড় কোন পদ ইত্যাদির ব্যাপারে কেন আমার অনিহা - এ ধরনের কথা প্রতি বছরই ১৫ ই আগষ্টের পর আমাক কেউ কেউ বলে থাকে আমি তখন বলি , বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রির সঙ্গে বছরে আমার দুই-তিনবার, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং সশস্ত্র বাহিনী দিবসে দেখা হয়, তখন - উনি কৌতুকের ছলে বলেন যে আপনার দাড়ি তো দেখছি খালি বড় হচ্ছে। অতি সংক্ষিপ্ত কুশলাদি বিনিময়ের পর আমি সহাস্যে একটি স্মার্ট সালাম দিয়ে উনার মঙ্গল কামনা করে প্রতিবারই বিদায় নিই। কারন কোন কিছু পাওয়ার তাগিদে নয় কর্তব্যের তাগিদেই সেদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম।
সত্যিকার অর্থে বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে আমি সেনাবাহিনীর একজন বড় অফিসার হতে পারতাম না, বা অবসর গ্রহণের পরবর্তী জীবনে বিশ হাজারের অধিক জনবল বিশিষ্ট "এলিট ফোর্স "নামক এত বড় প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানির মালিক হতে পারতাম না। যদিও বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের পর ষ্টাফ অফিসার হিসেবে আমাদের স্থিতিকাল সংক্ষেপণ করা হয়েছিল, তথাপি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সূযোগ পেয়ে আমি অতি গর্বিত। জাতির পিতার প্রতি আমাদের ঋণ অপরিশোধনীয়, উনার প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ সম্মান, গভীর শ্রদ্ধা, অপরিসীম কৃতজ্ঞতা। ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ প্রতি বছর ১৫ আগষ্ট আমরা এলিট ফোর্সে রক্তদান কর্মসূচি ও দোয়া মাহফিলের আয়োজনের মাধ্যমে উনার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
লেখক: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, পিএসসি (অবঃ) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলিট সিকিউরিটি সার্ভিস লি.
অনুলিখন: মোবারক আজাদ