<p>সত্তরের দশকের নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গের মর্যাদাপূর্ণ আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত করা হলো। শনিবার (২৭ এপ্রিল) সন্ধ্যায় অসীমবাবুর হাতে ‘আনন্দ পুরস্কার’ তুলে দিলেন বাংলাদেশের ‘কালের কণ্ঠ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক, বরেণ্য ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন। অসীম চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘নকশালবাড়িনামা’-কে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও অবদানকে স্মরণ করে এই সম্মাননায় ভূষিত করা হয় তাকে।</p> <p>বাংলাদেশের সঙ্গে নকশাল আন্দোলনের সম্পর্ক অনেক গভীর। ১৯৩৭ সালে অবিভক্ত বাংলার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে পাস করে বাংলাদেশের এডওয়ার্ড কলেজে আইএসসি পড়তে গিয়েছিলেন অসীমের নেতা চারু মজুমদার। চারু মজুমদারের হাত ধরেই প্রতিবাদে নিজেকে শামিল করেন অসীম। এরপর অসীমদের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সময়কাল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রতিবাদী জোশ প্রখরভাবে আছড়ে পড়ত ষাট-সত্তরের দশকের বাংলা সাহিত্যেও। অনুষ্ঠানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরই প্রধান অতিথি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রারম্ভিক বক্তৃতায় জানা গেল, তিনি অসুস্থ। তাই ইমদাদুল হক মিলনই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে আলোকিত করলেন এই আয়োজন।</p> <p>অসীম চট্টোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়া আনন্দ পুরস্কারের মানপত্রে উল্লেখ ছিল, ‘অসীমবাবুর এই লেখায় আছে তাঁর অনুসৃত পথের দিশা : নকশালদের পথ ছাড়ো, নকশালপন্থার পথ ধরো।’ পুরস্কারপ্রাপক অসীমবাবু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত কাকাসুলভ মেজাজে মাইকের সামনে এসে প্রতিবাদ জানালেন, ‘ভুল লেখা হয়েছে। ওটা হওয়া উচিত নকশালবাড়ির পথ ধরো।’ তাঁর এই মেজাজি এই চটজলদি প্রতিবাদের জন্যই তো তিনি অনন্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই আবারও অসীমবাবুর সেই তুখোড় দৃষ্টিতে মুগ্ধ।</p> <p>সভার প্রধান অতিথি ইমদাদুল হক মিলন বলেন, এক রাজনৈতিককর্মী যে তাঁর ষাট বছরের পথচলায় এত মানুষকে মনে রেখেছেন, সেখানেই তিনি হতবাক। এ তো লেখকের কাজ! প্রথম যখন সুবর্ণরেখার ধারে এক গ্রামে ‘ডিক্লাসড’ হওয়ার চেষ্টায় কাকা, বর্ণনাটা ভয়াবহ। ধান কাটতে পারছেন না, হাল দিতে গেলেও গা হাত পায়ে প্রবল ব্যথা। একদা বুকার পুরস্কারে মনোনীত বাঙালি নীল মুখোপাধ্যায়ের ‘দ্য লাইভস অব আদার্স’-এর নায়কও তো এ রকম কষ্টের কথাই লিখেছিল। সাহিত্য থেকে রাজনীতি, সবই যেন বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে একাকার। অসীমদের আন্দোলন-সংগ্রাম বারবার উঠে এসেছে সাহিত্যের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে।</p> <p>ইমদাদুল হক মিলনের কথায়, পথের ফারাক তো থাকতেই পারে। নকশালবাড়ি, শ্রীকাকুলাম, ইয়েনান প্রতিটি পথেরই থাকতে পারে নিজস্ব দাবি, নিজস্ব সংঘাত ও সমঝোতা। কিন্তু ষাট বছর আগের নকশালবাড়িনামা যেন বাঙালির শেষ মাইলফলক। সেটাই বাঙালির ট্র্যাজেডি। বারংবার ব্যর্থতার গোলকধাঁধায় ঘুরেছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের চেষ্টা করেছে। সেই সঙ্গে অসীমবাবুর জীবনদর্শন ও সংগ্রামী সময়কালের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধাও জানান বরেণ্য লেখক ইমদাদুল হক মিলন।</p> <p>অসীমবাবু নিজের বক্তৃতায় গণতন্ত্রকেই সর্বোৎকৃষ্ট উল্লেখ করে জানিয়েছেন, ‘গণতন্ত্রই মানুষকে পথ দেখায়। গণতন্ত্র যেটা ছিল, আছে, থাকবে।’ তাঁর মতে, ‘পার্টি নয়, নেতা নয়, জনগণই ইতিহাস তৈরি করে। জনতা যতই দরিদ্র হোক, তার সে শক্তি আছে। নকশালবাড়ি, শ্রীকাকুলাম জনতার এই শক্তি দেখিয়েছিল। আজ লোকে ভুলে গিয়েছে, কিন্তু নকশালবাড়ির পথ তো মিজোরাম, জম্মু-কাশ্মীরেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চেয়েছিল।’ অসীমদের আন্দোলন সারা ভারতের সঙ্গে বাংলার এক সাযুজ্য তৈরি করেছিল। হিন্দু-মুসলমান ভাগাভাগি ছিল না, বাঙালি-অবাঙালি ভেদ ছিল না। সেখানে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীতক গরিব মানুষের একটাই সংজ্ঞা। সেটা অর্থনীতির মাপকাঠি। ‘বাংলাবিরোধীদের বিসর্জন’ বলার কূপমণ্ডূকতাও ছিল না নকশালবাড়ি লাল সেলামের সেই যুগে।</p> <p>অসীম চট্টোপাধ্যায় একজন ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং একজন সাবেক নকশাল নেতা। তিনি কলকাতার তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন এবং প্রথমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের (তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র শাখা) এবং তারপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) ছাত্রনেতা ছিলেন। তিনি ১৯৭২-৭৮ সালে কারারুদ্ধ ছিলেন। অসীম একটি পৃথক দল হিসেবে বেঙ্গল-বিহার-ওড়িশা বর্ডার রিজিওনাল কমিটি, সিপিআই (এমএল) গঠন করেন। তাঁর দল সত্যনারায়ণ সিংয়ের সিপিআই (এমএল)-এ যোগ দেয় । পরে চ্যাটার্জি ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবী লীগ গঠন করেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার (বিধানসভা) নির্বাচনে দুইবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাকে ‘কমরেড কাকা’ বলেই ডাকা হয়। </p> <p>শনিবার (২৭ এপ্রিল) আয়োজিত এক বার্ষিক সাহিত্য পুরস্কারের মঞ্চে এ বছর ‘আনন্দ পুরস্কার’ তুলে দেওয়া হয় কিংবদন্তি অসীম চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। তাঁর আত্মজীবনী ‘নকশালবাড়িনামা’-কে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি সম্মানিত করা হয় এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদকে।</p>