<p style="text-align:justify">৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’-এর ‘করেসপনডেন্স’ পাতায় ওজোনস্তর রক্ষায় মন্ট্রিয়ল চুক্তিকে ‘জম্বি’ হিসেবে বিবেচনা না করার জন্য একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিখেছেন ‘ইনস্টিটিউট ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট, ওয়াশিংটন’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক বর্ষীয়ান প্রফেসর ডারউড জেলকি। ‘হাইতিয়ান-ফরাসি’ লোকসংস্কৃতিতে ‘জম্বি’ বলতে জাদুবিদ্যার মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত মৃতদেহকে বোঝানো হয়ে থাকে।</p> <p style="text-align:justify">১৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে এই একই জার্নালে প্রকাশিত তিনটি দেশের (অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন) চারজন বিশিষ্ট গবেষকের একটি লেখার প্রতিক্রিয়া জানাতে প্রফেসর জেলকি তাঁর লেখাটি লিখেছেন।</p> <p style="text-align:justify">সেই লেখায় গবেষকরা প্রায় আট দশক আগে হওয়া ‘আন্তর্জাতিক তিমি কনভেনশন’-এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে উল্লেখ করে সেটিসহ আন্তর্জাতিক অনেক চুক্তিকে ‘জম্বি’র সঙ্গে তুলনা করে সেগুলো বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। লেখকদের যুক্তি হচ্ছে, এ পর্যন্ত পরিবেশবিষয়ক প্রায় তিন হাজার আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, যার অনেকগুলোরই লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় সেগুলোকে ‘জম্বি’ হিসেবে বাঁচিয়ে রেখে সেসবের সেক্রেটারিয়েট পরিচালনার জন্য বছরে লাখ লাখ ডলার খরচ করা অর্থহীন। এই প্রসঙ্গে লেখকরা নির্দিষ্টভাবে ওজোনস্তর রক্ষায় ১৯৮৭ সালে করা মন্ট্রিয়ল চুক্তিকে উল্লেখ করে বলেছেন, এই চুক্তির লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়েছে কিংবা শিগগিরই অর্জিত হবে। কাজেই এই চুক্তির সমাপ্তি ঘোষণা করে সেটির অবশিষ্ট কাজ ইউএনএফসিসিসি  (ইউনাইটেড  নেশনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)-এর কাছে হস্তান্তর করা প্রয়োজন।</p> <p style="text-align:justify"><img alt="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/16-09-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpg" height="197" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/16-09-2024/2/kalerkantho-ed-2a.jpg" width="350" />প্রফেসর জেলকি তাঁর লেখায় যা বলতে চেয়েছেন তা হচ্ছে : মন্ট্রিয়ল চুক্তি এখনো প্রাসঙ্গিক এবং তা চালু রাখার বাধ্যবাধকতা আছে। এই চুক্তি এ পর্যন্ত প্রায় ১০০ ক্ষতিকর রাসায়নিক বন্ধ করার মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ওজোনস্তর রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। চুক্তিতে বর্ণিত কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে অতিবেগুনি রশ্মির দ্বারা সৃষ্ট ত্বক ক্যান্সারের কারণে বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঠেকানো প্রয়োজন। ফ্লোরিন জাতীয় গ্যাসের উৎপাদন বন্ধ করা এবং অতিবেগুনি রশ্মির দ্বারা কার্বন জমা হওয়ার ভাণ্ডার বনভূমির ক্ষতি রুখে দেওয়ার মাধ্যমে চলতি শতকের মধ্যে আড়াই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা ঠেকিয়ে রাখার কাজে সহায়ক এই চুক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার।</p> <p style="text-align:justify">উল্লেখ্য, এই চুক্তিতে নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাসের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলোচনা চলছে এবং তা করা গেলে ওজোনস্তর রক্ষার পাশাপাশি বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাসের কাজেও মন্ট্রিয়ল চুক্তি আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।</p> <p style="text-align:justify">এসব কারণে এ বছর (২০২৪) আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘মন্ট্রিয়ল প্রটোকল : অ্যাডভান্সিং ক্লাইমেট অ্যাকশন’। এই প্রতিপাদ্যের মূল বার্তা হচ্ছে, মন্ট্রিয়ল চুক্তি এখনো ওজোনস্তর ক্ষয় ও বৈশ্বিক উষ্ণতা মোকাবেলার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। জীবজগৎ তথা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই দুটি সংকট মোকাবেলায় উৎসাহ সৃষ্টি এবং আরো কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মন্ট্রিয়ল চুক্তি এখনো এক অতিপ্রয়োজনীয় দলিল। এই চুক্তির প্রসারণ ও পৃথিবীর প্রতিটি দেশে কার্যকরভাবে তা বাস্তবায়ন করা দরকার।</p> <p style="text-align:justify">জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১৬ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবস পালন করা হয়।</p> <p style="text-align:justify">আন্তর্জাতিকভাবে এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে গত শতকের তিরিশের দশকে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ওজোনস্তর সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। সিডনি চ্যাপম্যান নামে একজন ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ ও ভূপদার্থবিজ্ঞানী ১৯৩০ সালে পৃথিবীকে বেষ্টন করে থাকা ওজনস্তর সম্পর্কিত এক তত্ত্ব সর্বপ্রথম প্রকাশ করেন (চ্যাপম্যান মেকানিজম তত্ত্ব)। ১৯৭৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফ্রাংক সেরউড রোল্যান্ড ও তাঁর সহযোগী ড. মারিও জে. মলিনা ক্লোরোফ্লোরো-কার্বনের মতো দীর্ঘস্থায়ী হ্যালোকার্বন যৌগকে ওজোনস্তর ধ্বংসের জন্য দায়ী করেন (রোল্যান্ড-মলিনা তত্ত্ব)। শুরু হয় বায়ুমণ্ডলে ওজোনস্তর ক্ষয়ের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে জোর আলোচনা। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সর্বপ্রথম ১৯৭৭ সালে (১-৯ মার্চ) ওয়াশিংটন ডিসিতে ওজোনস্তর ক্ষয় বন্ধে একটি বিশ্ব কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে।</p> <p style="text-align:justify">এরপর ১৯৮৫ সালে তিনজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জোসেফ চার্লস ফারম্যান, বি জি গার্ডেনার ও জে ডি সাংকলিন অ্যান্টার্কটিকায় ওজোনস্তর ক্ষয়জনিত গহ্বর তৈরি সম্পর্কে তাঁদের যুগান্তকারী প্রবন্ধ ‘নেচার’-এ প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট মহলে  হৈচৈ পড়ে যায়। কারণ ওজোনস্তর ক্ষয় হয়ে তা ধ্বংসের অর্থই হলো মানুষ তথা জীবজগতের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়া। কাজেই এই ওজোনস্তর ক্ষয় রুখে দেওয়া প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোর তৎপরতা শুরু হয়ে যায়।</p> <p style="text-align:justify">এই তৎপরতার ফলে ভিয়েনা কনভেনশন (১৯৮৫, কার্যকর ১৯৮৮) ও মন্ট্রিয়ল চুক্তি (১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭, কার্যকর ১৯৮৯) সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। এ ছাড়া লন্ডন সংশোধনী (১৯৯১, কার্যকর ১৯৯২), জাতিসংঘ কর্তৃক ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোনস্তর রক্ষা দিবস ঘোষণা (১৯৯৩, কার্যকর ১৯৯৫), বেইজিং সংশোধনী (১৯৯৯, কার্যকর ২০০২) ও কিগালি সংশোধনী (২০১৬, কার্যকর ২০১৯) সম্পন্ন হয়। ফলে পৃথিবীতে ওজোনস্তর ক্ষয়কারী পদার্থসমূহের (ওজোন ডিপ্লেটিং সাবসট্যান্স–ওডিএস) উৎপাদন লক্ষণীয়ভাবে বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। তবে মন্ট্রিয়ল চুক্তির প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরিয়ে যায়নি।</p> <p style="text-align:justify">ভূপৃষ্ঠের ১০–১৫ কিমি (ট্রপোসফেয়ার) ওপর থেকে শুরু করে প্রায় ৫০ কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাকে স্ট্রাটোসফেয়ার বা ওজোনস্তর বলা হয়। মানুষসহ জীবজগতের বেঁচে থাকার জন্য ওজোনস্তর স্বাভাবিক থাকা প্রয়োজন। সাধারণত ৩০০ ডিইউ (ডবসন ইউনিট) বা ৩ মিমি পুরু ওজোনস্তরকে স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। কারণ এ ধরনের ওজোনস্তর ভেদ করে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি–টাইপ ‘ইউভি-সি’ (১০০–২৮০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য) ও ‘ইউভি-বি’ (২৮০–৩১৫ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য) পৃথিবীতে চলে আসতে পারে না। ফলে রক্ষা পায় মানুষসহ সামুদ্রিক জীব, গাছপালা ও ফসল। কোনো জায়গায় ওজোনস্তর ক্ষয় হয়ে ১০০ ডিইউ-এর নিচে নেমে এলে বিজ্ঞানীরা সেখানে গহ্বর তৈরি হয়েছে বলে ঘোষণা করেন। ওজোনস্তরে গহ্বর তৈরি হলে সেখান থেকে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে এসে মানুষসহ জীবজগতের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।</p> <p style="text-align:justify">ওজোনস্তর ক্ষয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্লোরিন ও ব্রোমিনযুক্ত নানা ধরনের গ্যাস (সিএফসি, হ্যালোন, মিথাইল ক্লোরাইড, এইচসিএফসি ইত্যাদি)। পৃথিবীতে একসময় এগুলো ব্যাপকভাবে রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, অ্যারোসল, ফোম, অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র, ইনহেলার ইত্যাদি তৈরির কারখানাসহ ড্রাই ক্লিনিং করার সময় ব্যবহার হতো। গবেষণায় দেখা গেছে, একটিমাত্র ক্লোরিন পরমাণু এক লাখেরও বেশি ওজোন অণুকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। আর ওজোনস্তরের জন্য ব্রোমিন হচ্ছে ক্লোরিন থেকে ৪৫ গুণ বেশি ক্ষতিকর।</p> <p style="text-align:justify">উপরোক্ত রাসায়নিক গ্যাসগুলো ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে গবেষকরা দাবানল, কৃত্রিম উপগ্রহ (কিউবস্যাট বা ন্যানোস্যাটেলাইটস) এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে ওজোনস্তর ক্ষয়ের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উল্লেখ্য, দাবানলের জন্য প্রধানত বৈশ্বিক উষ্ণতা দায়ী—যার জন্য প্রধানত মানুষের কর্মকাণ্ড চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কৃত্রিম উপগ্রহও মানুষই তৈরি করে। কাজেই মানুষের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ওজোনস্তর ক্ষয়জনিত সমস্যাসহ পরিবেশের অনেক সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান করা সম্ভব। মন্ট্রিয়ল চুক্তির প্রসারণ ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু ওজোনস্তর রক্ষা নয়, বরং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা সমস্যা সমাধানেও তা সাহায্য করতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">আন্তর্জাতিক ওজোন সেক্রেটারিয়েটের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ওজোন ক্ষয়কারী পদার্থসমূহের ২০২২ সাল পর্যন্ত ব্যবহারসংক্রান্ত পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর এসংক্রান্ত পরিসংখ্যান আছে ২০২৩ পর্যন্ত। এই ওয়েব পেজে দেওয়া তথ্যানুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ওজোনস্তর রক্ষাসংক্রান্ত কর্মকাণ্ড নির্বাহের জন্য বাংলাদেশকে মোট ১৪,২১৭,৫২৮ মার্কিন ডলার দেওয়া হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে সম্পাদিত কাজসমূহের বিস্তারিত বিবরণ পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গে সংযুক্ত ‘ওজোন সেল’-এর পাতায় থাকা প্রয়োজন। ওজোন ধ্বংসকারী পদার্থসমূহের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোক নিয়োগ করা দরকার।</p> <p style="text-align:justify"><strong>লেখক </strong>: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p>