<p style="text-align:justify">কলিং বেল চাপতেই হাসিমুখে স্বাগত জানালেন ওয়াহিদ। বললেন, ‘গানের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।’ ঘরটিতে আসবাব বলতে ছোট্ট একটি সোফা, একটি ল্যাপটপ আর কয়েকটি ক্যাসেট প্লেয়ার। এ ছাড়া যা আছে, সবই সংগীত নিয়ে।</p> <p style="text-align:justify">দেয়াল-লাগোয়া তিনটি শেলফ। সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা আট ফুট, প্রস্থ সাত ফুট। হরেকরকম ক্যাসেট আর অডিও সিডি থরে থরে সাজানো শেলফগুলোতে। দক্ষিণে জানালার পাশের সেলফটি বইপত্রে ঠাসা। সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে, বাংলার রক মেটাল, মান্না দে, উঠান সংগীত সংখ্যা—সংগীতবিষয়ক এমন নানা বইপত্র শোভা পাচ্ছে সেখানে। আরেকটি শোকেসে আছে ডিভিডি আর সংগীত সম্পর্কিত নানা রকম স্মারক। শোকেসটির ওপর কয়েকটি ক্যাসেট প্লেয়ার। শেলফে ঠাঁই নেই বলে কিছু অ্যালবাম রাখা হয়েছে মেঝেতে।<br /> ওয়াহিদ বললেন, ‘এখন এগুলো নিয়েই দিন কাটে আমার।’</p> <p style="text-align:justify"><img alt="1" height="79" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/8888888.jpg" style="float:left" width="253" /></p> <p style="text-align:justify"><br /> গানপাগল এই মানুষটার পুরো নাম ওয়াহিদ জামান মাসুম। জন্ম ১৯৭২ সালে, কুমিল্লায়। বাবার চাকরিসূত্রে শৈশব-কৈশোর কেটেছে বৃহত্তর সিলেটে। পরিবারসহ এখন থাকেন ঢাকার খিলগাঁওয়ে।</p> <p style="text-align:justify">জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। এরপর দীর্ঘদিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। এখন সংগীত সম্পর্কিত নানা বিষয় নিয়ে মজে আছেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>আর কিছু চায় না মনে গান ছাড়া</strong></p> <p style="text-align:justify">বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। খুব ভোরে ছেলেমেয়েদের ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। নাশতা তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগত। এই ফাঁকে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজাতেন রবীন্দ্রসংগীত। ধীরে ধীরে ভারতীয় বাংলা, হিন্দি এবং দু-চারটি ইংরেজি অ্যালবামও আসতে লাগল ওয়াহিদদের ডেরায়। তাঁর মামা এনায়েত করিমের রেডিও ছিল। মামার পাশে বসে রেডিও শুনতেন। আরেকটু বড় হলে মামা ভাগ্নেকে একটি ওয়াকম্যান কিনে দিয়ে বললেন, ‘অঙ্ক করার সময় গান শুনবি।’</p> <p style="text-align:justify">আমিনুল হক তুষার নামে ওয়াহিদের এক ফুফাতো ভাই থাকতেন ঢাকায়। নতুন কোনো অ্যালবাম বের হলে তিনি চিঠি লিখে জানাতেন ওয়াহিদকে। ঢাকায় বড় কনসার্ট থাকলে সেটাও জানাতেন। দুজনে মিলে যেতেন সেসব আয়োজনে। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে ক্যাসেট কিনতেন ওয়াহিদ। একেকটার দাম ছিল ৩৫ টাকা। বললেন, ‘বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় গানই আমাকে বেশি টানে। গান শুনলে মনে অপার্থিব আনন্দ মেলে।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>হারিয়ে যেতে দেবেন না</strong></p> <p style="text-align:justify">ক্যাসেট, সিডি নিয়মিতই কিনতেন। কিন্তু সংগ্রহশালা গড়ে তুলবেন—এমন চিন্তা ছিল না শুরুর দিকে। মোটাদাগে ২০১৩ সালের দিকে ব্যান্ডের অ্যালবামগুলো জোগাড় করা শুরু করলেন। দেখলেন, অ্যালবাম প্রকাশকারী কম্পানিগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অডিও শপগুলো ইলেকট্রনিকস, কম্পিউটার এক্সেসরিজের দোকানে রূপ নিচ্ছে! ভাবলেন, এই ইতিহাসকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। তখন থেকে অ্যালবাম সংগ্রহে জোর দিলেন। রবীন্দ্রসংগীত থেকে শুরু করে রক—সব ধরনের অ্যালবাম সংগ্রহ করেন। তাঁর সংগৃহীত প্রথম অ্যালবামটি শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের।</p> <p style="text-align:justify"><strong>এক ঠিকানায় ২০ হাজার অ্যালবাম</strong></p> <p style="text-align:justify">সোলস, মাইলস, এলআরবি থেকে শুরু করে দেশের সব ব্যান্ডের প্রায় ৯০ শতাংশ অ্যালবাম আছে ওয়াহিদের ঝুলিতে। কাটতির ওপর ভিত্তি করে একেকটা অ্যালবামের একাধিক সংস্করণ বের হতো তখন। সেগুলোও আছে ওয়াহিদের সংগ্রহশালায়।</p> <p style="text-align:justify">শিরোনামহীনের প্রথম অ্যালবাম ‘জাহাজী’ যেমন আছে তেমনি আছে বাংলাদেশে আধুনিক গানের প্রথম অ্যালবাম হিটস অব এম এম শোয়েব। ১৯৮২ সালে শাহীন ডিসকো রেকর্ডিং থেকে বেরিয়েছিল এটি।</p> <p style="text-align:justify">‘মোহাং আইয়ুব বাচ্চু’—শুরুর দিককার অ্যালবামগুলোতে আইয়ুব বাচ্চুর নাম লেখা হতো এভাবে। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘আধুনিক গান’-এর অ্যালবাম। দেশে প্রথম ডাবল ধারার অ্যালবাম নিয়ে আসে এলআরবি। সারগম থেকে প্রকাশিত সেই অ্যালবামেরও দেখা মিলবে ওয়াহিদের তাকে।</p> <p style="text-align:justify">১৯৯২-৯৩ সালের দিকে আবিদা সুলতানা, শাকিলা জাফর, সাবা তানীসহ ১৬ জন শিল্পীর গান নিয়ে সংগীতা থেকে বেরিয়েছিল ‘বিটিভি টপস্টার’ নামের একটি অ্যালবাম। মুক্তিযুদ্ধের শরণার্থী শিবিরে গাওয়া গানগুলো সংগ্রহ করেছিলেন তোরাপ আলী সাঁই। শরণার্থী শিবিরের সেই গানগুলো নিয়ে বেশ কিছু অ্যালবাম বেরিয়েছিল। সব আছে ওয়াহিদের কাছে।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশে একসময় মঞ্চ নাটকের অ্যালবাম বের হতো। আবদুল্লাহ আল মামুনের জনপ্রিয় রচনা ‘এখনো ক্রীতদাস’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে মমতাজ উদদীন আহমদের নাটক ‘দুই বোন’। এ দুটি অ্যালবাম আছে ওয়াহিদের সংগ্রহে। এর বাইরে সংসদে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির ভাষণের অ্যালবামও আছে বেশ কয়েকটি।</p> <p style="text-align:justify">১৯৮৮ সালে বের হয়েছিল সোলসের ‘ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট ভলিউম ৪’ অ্যালবামটি। বাংলা ও ইংরেজি গানের লিরিকসহ দুর্লভ এই অ্যালবামটি আছে ওয়াহিদের কাছে। বাংলাদেশে সর্বাধিক বিক্রীত অ্যালবাম ধরা হয় মুজিব পরদেশীর ‘আমি বন্দি কারাগারে’কে। চেনাসুর থেকে প্রকাশিত অ্যালবামটিও আছে। </p> <p style="text-align:justify">তপন চৌধুরীকে তো লোকে আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে চেনে। কিন্তু কজন জানে তিনি গজলেও দুর্দান্ত? এমনকি ‘নস্টালজিয়া’ নামে গজলের একটা অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। সেটিও আছে ওয়াহিদের কাছে। </p> <p style="text-align:justify">মাইলসের প্রথম ও দ্বিতীয় অ্যালবামও আছে। পেপার রাইম ব্যান্ড সৃষ্টির আগে ব্যান্ডের দুই কম্পোজার রাশেদ ইকবাল এবং নাসের এম হকের কম্পোজিশনে একটি অ্যালবাম বের হয় ১৯৯৩ সালে। শিল্পী ছিলেন রুমী। ক্রিপ্টিক ফেইটের প্রথম অ্যালবাম সম্পূর্ণ ইংরেজি ঊহফং ধত্ব ভড়ত্বাবৎ শিরোনামের দুর্লভ অ্যালবামটিও আছে।</p> <p style="text-align:justify">এ ছাড়া শিল্পী আব্বাস উদ্দিন, আব্দুল আলীম, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আব্দুল জব্বার, প্রবাল চৌধুরী, সুবীর নন্দী, খোন্দকার নূরুল আলম, বশির আহমেদ, কলিম শরাফী, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, শুভ্রদেবসহ সব ঘরানার প্রায় সব শিল্পীর এ যাবৎ প্রকাশিত সব অ্যালবাম দেখতে পাবেন ওয়াহিদের কাছে। বললেন, ‘সব মিলিয়ে ২০ হাজারের বেশি অ্যালবাম আছে আমার কাছে। এত বড় সংগ্রহশালা গড়ার পেছনে গীতিকার সাকী আহমদ ও শিল্পী জয় শাহরিয়ারসহ অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি। সবার কাছে কৃতজ্ঞ আমি।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>ছুটে গেছেন নানা প্রান্তে</strong></p> <p style="text-align:justify">সংগ্রহের নেশা পেয়ে বসার পর কোথাও পুরনো অ্যালবামের খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যান সেখানে। একসময়ের ৩৫ টাকার অ্যালবামের জন্য কখনো কয়েক হাজার টাকাও খরচ করতে দ্বিধা করেননি। একবার খবর পেলেন শিল্পী সাহেদের একটি অ্যালবাম আছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে এক ভদ্রলোকের কাছে। পরদিন সকালেই ছুটে গেলেন সেখানে। ‘প্রভু’ শিরোনামের সেই অ্যালবামের জন্য ব্যয় করতে হয়েছিল দেড় হাজার টাকা। এমন অনেক গল্প জমা আছে ওয়াহিদের ঝুলিতে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সেই আক্ষেপ ঘুচল না</strong></p> <p style="text-align:justify">শুধু অ্যালবাম নয়, বিচিত্রা, বিচিন্তা, আনন্দলোক, তারকালোকসহ সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক ম্যাগাজিনের বিশাল সংগ্রহ ছিল ওয়াহিদের। একবার কী একটি কাজে ঢাকা এসেছিলেন। ফিরে গিয়ে দেখেন কে যেন সব বিক্রি করে দিয়েছে। এই আক্ষেপ কখনো ঘুচবে না।</p> <p style="text-align:justify"><strong>আর্কাইভ মিউজিয়াম করবেন</strong></p> <p style="text-align:justify">ওয়াহিদের সংগ্রহে থাকা বেশির ভাগ অ্যালবাম এখনো সচল। প্রায়ই সেগুলো বাজান। মাঝেমধ্যে রোদেও দেন। জানালেন, ‘বেশিদিন না বাজালে ফাঙ্গাস পড়ে নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রায় বাজাই। রোদে দিয়ে আর্দ্রতা কমাতে হয়। ধীরে ধীরে ডিজিটালি সংরক্ষণের চেষ্টা করছি। অনেক শিল্পীর কাছে তাঁর নিজের অ্যালবামই নেই এখন। এখন বাজারেও নেই। কিন্তু আমার কাছে আছে জানতে পারলে খুশি হন। এরই মধ্যে কয়েকজন শিল্পী সেটা নিয়েও গেছেন।’</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশে সংগীত নিয়ে কোনো আর্কাইভ নেই। সে অভাব ঘোচাতে কাজ করছেন বলে জানালেন ওয়াহিদ। বললেন, ‘সব ঘরানার শিল্পীদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেইসসহ সংগীতের একটা পূর্ণাঙ্গ আর্কাইভ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। এরই মধ্যে সে কাজে অনেকদূর এগিয়েছি আমরা।’ এ জন্য অ্যালায়েন্স ফর মিউজিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভ নামে একটি সংগঠনও গড়েছেন। এখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান মিউজিক আর্কাইভ নিয়ে।</p> <figure class="image"><img alt="2" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/1.jpg" width="1000" /> <figcaption>বাংলাদেশে আধুনিক গানের প্রথম অ্যালবাম হিটস অব এম এম শোয়েব। ছবি : মোহাম্মদ আসা</figcaption> </figure> <p style="text-align:justify"> </p> <figure class="image"><img alt="2" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/2.jpg" width="1000" /> <figcaption>দেশে প্রথম ডাবল ধারার অ্যালবাম নিয়ে আসে এলআরবি। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</figcaption> </figure> <figure class="image"><img alt="2" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/3.jpg" width="1000" /> <figcaption>মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থী শিবিরে গাওয়া গানগুলো নিয়ে বেশ কিছু অ্যালবাম বেরিয়েছিল। সব আছে ওয়াহিদের কাছে। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</figcaption> </figure> <figure class="image"><img alt="kk" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/4.jpg" width="1000" /> <figcaption>বাংলাদেশে একসময় মঞ্চ নাটকের অ্যালবাম বের হতো। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</figcaption> </figure> <figure class="image"><img alt="kk" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/5.jpg" width="1000" /> <figcaption>আজম খানের শুরুর দিকের অ্যালবাম। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</figcaption> </figure> <figure class="image"><img alt="kk" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/online/2024/11/02/my1205/6.jpg" width="1000" /> <figcaption>এমন বৈচিত্র্যময় নানা সংগ্রহ আছে ওয়াহিদের সংগ্রহে। ছবি : মোহাম্মদ আসাদ</figcaption> </figure> <p style="text-align:justify"> </p>