<p style="text-align:justify">দিল্লির ‘কিলা’ ছেড়ে তিনি মেহবুব-এ-ইলাহির দরগাহতে এসে পৌঁছেছেন - এ খবর পেয়েই তড়িঘড়ি বাদশাহর সামনে হাজির হয়েছিলেন হজরত খাজা শাহ গুলাম হাসান। সেটাই ছিল তৈমুর বংশের উত্তরসূরি – সম্রাট বাবর, শাহজাহানদের বংশধর - বাহাদুর শাহ জাফরের শেষ বারের মতো দিল্লির লাল কেল্লা ছেড়ে বেরিয়ে আসা। দিনটা ছিল ১৮৫৭ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর।</p> <p style="text-align:justify">তার ‘নানা’-র বর্ণনা করা ওই ঘটনা নিজের মায়ের মুখে অনেকবার শুনেছেন খাজা হাসান নিজামি। তার ‘নানা’ বা মায়ের বাবা খাজা শাহ গুলাম হাসান চিশতী ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের আধ্যাত্মিক পথ-প্রদর্শক। আর যে মেহবুব-এ-ইলাহির দরগাহর কথা লিখে গেছেন খাজা হাসান নিজামি, সেটি খাজা নিজামুদ্দিন চিশতীর দরগাহ।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"> <p style="text-align:justify"><strong>আরো পড়ুন</strong></p> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3" style="text-align:justify"><img alt="পিতার নেক আমল ও দোয়ার বরকত" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/11/07/1730950169-9e59359b6b76a2a6886d9de9ef2909c5.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p style="text-align:justify">পিতার নেক আমল ও দোয়ার বরকত</p> </div> </div> </div> <p style="text-align:justify"><a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/Islamic-lifestylie/2024/11/07/1443767" target="_blank"> </a></p> </div> </div> <p style="text-align:justify">হাসান নিজামি লিখেছেন, "তার চেহারায় তখন হতাশা আর উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। মাত্র কয়েকজন হিজরা এবং মোট-বাহক তার সিংহাসন বয়ে নিয়ে আসার জন্য সঙ্গে এসেছিলেন। তার পোশাক ধুলোমলিন। তার সফেদ দাড়িতেও ময়লা লেগে ছিল।" সম্রাট তিন দিন অভুক্ত<br /> “সম্রাট দরগাহ-তে এসেছেন শুনেই আমার নানা তার সামনে নিজেকে পেশ করলেন। …আমার নানাকে দেখে তার মুখে একটা মলিন হাসি ফুটে উঠল। সম্রাটের সামনে বসে তার শরীর স্বাস্থ্যের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নিলেন তিনি,” লিখেছেন হাসান নিজামি।</p> <p style="text-align:justify">তার লেখা বইটি হিন্দিতে অনুবাদ করেছিলেন উমরাও সিং কার্ণিক, আর ইতিহাসবিদ রাণা সাফভিও বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। ইতিহাসবিদ রাণা সাফভির করা ইংরেজি অনুবাদে সেদিনের ঘটনার বিবরণএরকম - "বেশ কিছুক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলার পরে একটা সময়ে বাহাদুর শাহ জাফর খাজা শাহ গুলাম হাসান চিশতীকে জিজ্ঞাসা বলেছিলেন, 'আমি তিন দিন কিছু খাই নি। বাড়িতে যদি কিছু খাবার থাকে, আমাকে এনে দিতে পারেন'?”</p> <p style="text-align:justify">হাসান নিজামি লিখেছেন, “আমার নানা জবাব দিয়েছিলেন, মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে কেউই রান্না করে উঠতে পারেনি। তবুও যা আছে, আমি এখনই নিয়ে আসছি।“ নিজের ঘরে গিয়ে শাহ গুলাম হাসান চিশতী জানতে পারেন যে ঘরে কয়েকটি বেসনের রুটি আর মুলোর আচার ছাড়া অন্য কিছুই নেই। সেটাই একটা রেকাবে সাজিয়ে সম্রাটের সামনে হাজির করেছিলেন তিনি। সেই খাবার খেয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে হজরত নিজামুদ্দিনের দরগাহ থেকে বেরিয়ে হুমায়ূনের সমাধির দিকে রওয়ানা হয়েছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"> <p style="text-align:justify"><strong>আরো পড়ুন</strong></p> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3" style="text-align:justify"><img alt="আজ কেমন থাকতে পারে ঢাকার আবহাওয়া" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/11/07/1730949278-e06d061a77a7bde916b8a91163029d41.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p style="text-align:justify">আজ কেমন থাকতে পারে ঢাকার আবহাওয়া</p> </div> </div> </div> <p style="text-align:justify"><a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/dhaka/2024/11/07/1443766" target="_blank"> </a></p> </div> </div> <p style="text-align:justify">এদিকে, বাহাদুর শাহ জাফর, তার স্ত্রী ও কয়েকজন সন্তান হুমায়ুনের সমাধিতে রয়েছেন, সে খবর পেয়ে ব্রিটিশ বাহিনীর মেজর উইলিয়াম হডসন তার বাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেন সমাধি। ব্রিটিশ বাহিনী তার এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের জীবনহানি ঘটাবে না, এই শর্তে আত্মসমর্পণে রাজী হন বাহাদুর শাহ। হুমায়ুনের সমাধি থেকে পরিবার সহ বেরিয়ে আসেন তিনি, ১৮৫৭ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর।</p> <p style="text-align:justify"><strong>জাফর-পুত্রদের হত্যা</strong></p> <p style="text-align:justify">ভারতের শেষ মুঘল সম্রাটকে গ্রেফতার করে যখন দিল্লির দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে, তখনই মেজর হডসনের কাছে খবর আসে যে সম্রাটের আরও কয়েকজন পুত্র এবং এক নাতি তখনও হুমায়ুনের সমাধিতে অথবা তার কাছাকাছি লুকিয়ে আছেন। কর্নেল ম্যালেসন সম্পাদিত, ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত ছয় খণ্ডের ‘ইন্ডিয়ান মিউটিনি অফ ১৮৫৭-৮’ নামক বইয়ে লেখা হয়েছে, “সম্রাটের পুত্র ও নাতিদের লুকিয়ে থাকার খবর পেয়ে মেজর হডসনের মধ্যে একটা পাশবিক প্রবৃত্তি জেগে উঠল। তার মনে হয়েছিল যে এরা ক্ষমার যোগ্য হতে পারে না।"</p> <p style="text-align:justify">“পরদিন সকালে বাহিনীর জেনারেলের অনুমতি নিয়ে লেফটেন্যান্ট ম্যাকডাওয়েল সহ ১০০ জনের একটা বাহিনী ও দুই গুপ্তচর – মুন্সী রজব আলি ও ইলাহি বকশ মির্জাকে নিয়ে মেজর হডসন আবারও রওয়ানা হলেন হুমায়ুনের সমাধির দিকে,” লিখেছেন কর্নেল ম্যালেসন। সেখানে সম্রাটের দুই পুত্র মির্জা মুঘল, মির্জা খিজর সুলতান এবং নাতি মির্জা আবু বকর্-এর সন্ধান পাওয়া গেল।</p> <div class="d-flex justify-content-center"> <div class="col-12 col-md-10 position-relative"> <p style="text-align:justify"><strong>আরো পড়ুন</strong></p> <div class="card"> <div class="row"> <div class="col-4 col-md-3" style="text-align:justify"><img alt="রাজধানীতে যেসব মার্কেট বন্ধ আজ" height="66" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/2024/11/07/1730948445-9725bc56a238caeca377d53682c34fe2.jpg" width="100" /></div> <div class="col-8 col-md-9"> <p style="text-align:justify">রাজধানীতে যেসব মার্কেট বন্ধ আজ</p> </div> </div> </div> <p style="text-align:justify"><a class="stretched-link" href="https://www.kalerkantho.com/online/dhaka/2024/11/07/1443764" target="_blank"> </a></p> </div> </div> <p style="text-align:justify">আগের দিনই সম্রাট নিজে আত্মসমর্পণ করেছেন, তাই পরের দিন খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি ব্রিটিশ বাহিনীকে। এই তিনজনকে গ্রেফতার করে মেজর হডসনের বাহিনী যখন প্রায় দিল্লিতে পৌঁছে গেছে, তখন এক সৈনিকের কাছ থেকে পিস্তল নিয়ে নিজে গুলি করে সম্রাটের ওই তিনজনকে হত্যা করেন মেজর হডসন।</p> <p style="text-align:justify">যেখানে বাহাদুর শাহ জাফরের দুই পুত্র এবং এক নাতিকে হত্যা করা হয়, দিল্লির সেই এলাকার নাম এখন ‘খুনি দরওয়াজা’। এরা ছাড়া মির্জা কোয়াইশ, মির্জা আবদুল্লা সহ সম্রাটের কয়েকজন পুত্র-কন্যা দিল্লি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে জানা যায় ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভসে রাখা সেই সময়কার ব্রিটিশ নথিপত্র এবং হাসান নিজামির লেখা ‘বেগমাৎ কে আঁসু’ বইটি থেকে।</p> <p style="text-align:justify"><strong>বাহাদুর শাহর নির্বাসন</strong></p> <p style="text-align:justify">বাহাদুর শাহ জাফরকে গ্রেফতারের পরে এরকম একটা পরিকল্পনা হয়েছিল যে বিচারের আগেই তাকে লাহোরে সরিয়ে দেওয়া হোক। তবে শেষমেশ ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে বিচারই করা হবে বাহাদুর শাহ জাফরের। যে দিল্লির লাল কিল্লা ছিল মুঘল সম্রাটদের নিজস্ব মহল আর দরবার, সেখানেই ১৮৫৮ সালের ২৭শে জানুয়ারি তার বিচার শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বাহাদুর শাহ জাফরকে নির্বাসনের সাজা দেওয়া হয়। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য চেয়েছিল যে গোটা ‘মুসলমান বংশ’টিকেই নির্বাসনে পাঠানো উচিত।</p> <p style="text-align:justify">ভারতের তৎকালীন রাজধানী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামের বিদেশ দফতর ১৮৫৮ সালের ৩০শে এপ্রিল একটি চিঠি পাঠিয়েছিল ভারত সরকারের সচিবকে, যেখানে তারা ব্যাখ্যা দিয়েছিল যে কেন বাহাদুর শাহ জাফরসহ পুরো ‘বংশ’টিকেই চিরতরে ভারতের মানুষের মন থেকে মুছে দেওয়া দরকার। সেই নথিতে লেখা হয়েছিল যে ‘বিদ্রোহে’ কার কী ভূমিকা ছিল, সেটা বিচার না করে মুঘল পরিবারের যে যেখানে আছে, সবাইকেই নির্বাসনে পাঠানো হোক - যাতে ভবিষ্যতে তারা অথবা তাদের কোনও বংশধর ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কোনও ধরণের বিদ্রোহের নেতৃত্ব না দিতে পারেন।</p> <p style="text-align:justify">সরকার অবশ্য সিদ্ধান্ত নেয় যে শুধুমাত্র বাদশাহ এবং তার পরিবারের কয়েকজন সদস্যকেই রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হবে। দিল্লি থেকে প্রথমে ইলাহাবাদ, সেখান থেকে কলকাতা হয়ে জাহাজে চাপিয়ে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। </p> <p style="text-align:justify"><strong>সম্রাটের সঙ্গে স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূও নির্বাসনে</strong></p> <p style="text-align:justify">দিল্লির তৎকালীন কমিশনার সিবি সন্ডার্স কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে একটি তালিকা পাঠিয়েছিলেন, যাদের রেঙ্গুনে নির্বাসনের জন্য দিল্লি থেকে রওয়ানা করা হচ্ছে। সেই তালিকায় বাহাদুর শাহ জাফরসহ তার পরিবারের মোট আটজন, সম্রাটের হারেম থেকে মোট পাঁচজন নারীর নাম ছিল। পুরুষ এবং নারী পরিচারক মিলিয়ে আরও মোট ১৬জনের নাম ছিল সে তালিকায়। পরিবারের যে সদস্যরা রেঙ্গুনে বাদশাহর সঙ্গে যান তার মধ্যে ছিলেন প্রধান-পত্নী জিনাত মহল এবং তার ছেলে মির্জা জওয়াঁ বখত্, অন্যতম উপপত্নী মুবারক উন্নিসা এবং তার সন্তান মির্জা শাহ আব্বাস,আর জওয়াঁ বখতের কিশোরী স্ত্রী শাহ জামানি বেগম।</p> <p style="text-align:justify">ইতিহাসবিদ মেহদী হুসেইন তার বই ‘বাহাদুর শাহ জাফর-টু অ্যান্ড দ্য ওয়ার অফ্ ১৮৫৭’ - এর পরিশিষ্টতে একটি ব্রিটিশ নথি উদ্ধৃত করেছেন। সেখান থেকে জানা যায়, ১৮৫৮ সালের সাতই অক্টোবর সকালে দিল্লি থেকে ওই ২৯ জনের দলটিকে রওয়ানা করানো হয় এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে। তবে, এলাহাবাদ পৌঁছানোর পরে ১৪ জন ফিরে যেতে চান। তাদের সেখানেই আটক করা হয় এবং বাহাদুর শাহ জাফরসহ বাকিদের স্টিমারে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করানো হয়।</p> <p style="text-align:justify">তারা সবাই কলকাতার উপকণ্ঠে ডায়মন্ড হারবারে পৌঁছান চৌঠা ডিসেম্বর এবং তাদের স্টিমার থেকে সরাসরি জাহাজে স্থানান্তরিত করা হয়। ডায়মন্ড হারবার থেকে ‘মাগুয়েরা’ নামের একটি জাহাজে চৌঠা ডিসেম্বর, ১৮৫৮, রওয়ানা হল রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে। সেটিতে চেপেই ভারতভূমি থেকে বিদায় নিলেন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। সেই জাহাজ রেঙ্গুনে পৌঁছেছিল ১০ই ডিসেম্বর, ১৮৫৮।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সম্রাটের পরিবারের চারটি ঘর, খাবার-খরচ দিনে ১১ টাকা</strong></p> <p style="text-align:justify">বাহাদুর শাহ জাফর ও তার পরিবার রেঙ্গুনে পৌঁছানোর পরে স্থানীয় বিত্তবান মুসলমানদের মধ্যে তাকে ঘিরে কিছুটা উৎসাহ দেখা গেলেও, তা খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় নি- এমনটাই জানা যাচ্ছে ১৮৫৯ সালের একটি ব্রিটিশ নথিতে। ফোর্ট উইলিয়ামে সেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন এইচ নেলসন ডেভিস – যিনি ১৮৫৯ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে রাজকীয় বন্দীদের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। রেঙ্গুনে পৌঁছনর পরে ১৮৫৮-র ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সম্রাট, তার পরিবারের কয়েকজনকে তাঁবুতে আর বাকিদের একটি বাড়িতে রাখা হয়েছিল।</p> <p style="text-align:justify">এর পর রেঙ্গুন শহরের সেনা ছাউনি এলাকাতেই একটি কাঠের বাড়িতে সবার থাকার ব্যবস্থা হয়। মি. ডেভিসের পাঠানো তেসরা অগাস্ট, ১৮৫৯ তারিখের রিপোর্টে বর্ণনা করা হয়েছিল, “মূল নিরাপত্তা চৌকির কয়েক গজের মধ্যেই এই বাড়িটি অবস্থিত। দেশের অন্যান্য কাঠের তৈরি বাড়ির মতো এটিও জমি থেকে বেশ কিছুটা উঁচু। পুরো জায়গাটি ১০০ ফিট স্কোয়ার আর তার চারদিকে ১০ ফিট উঁচু বেড়া আছে।"</p> <p style="text-align:justify">ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ক্যাপ্টেন ডেভিস বাড়ির বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে, “বাড়িটিতে চারটি ঘর আছে, একেকটি ১৬ ফিট স্কোয়ার আয়তনের। একটিতে ‘প্রাক্তন রাজা’কে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, অন্যটির দখল নিয়েছে জওয়াঁ বখত্ এবং তার কিশোরী স্ত্রী। তৃতীয়টিতে আছেন জিনাত মহল বেগম। এই প্রত্যেকটি ঘরের সঙ্গে বাথরুম রয়েছে। শাহ আব্বাস এবং তার মা অন্য ঘরটিতে আছেন। আলাদা দুটি বাথরুম এবং একটি রান্নাঘর আছে।” সম্রাট এবং তার পরিবার সহ ‘রাজকীয় বন্দী’দের খাওয়ার খরচ বাবদ দিনপ্রতি বরাদ্দ করা হয়েছিল ১১ টাকা।</p> <p style="text-align:justify">এছাড়াও প্রতি রবিবার অতিরিক্ত এক টাকা বরাদ্দ ছিল এবং মাসে একদিন প্রসাধনী কেনার জন্য জনপ্রতি দুই টাকা করে বরাদ্দ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। তবে, যে তিনটি জিনিষ একেবারেই নিষিদ্ধ ছিল তা হল কাগজ, কালি আর কলম এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি পরিচারকদেরও পাস নিয়ে ভেতরে যেতে হত। বাহাদুর শাহ জাফর সম্রাট ছাড়াও ছিলেন অতি উচ্চ স্তরের কবি, ক্যালিগ্রাফার এবং একজন সুফি সাধক। কিন্তু, নির্বাসিত হওয়ার পর থেকে কবিতা লেখার জন্য কাগজ-কালি বা কলম পাওয়ার অধিকারী ছিলেন না তিনি। বাধ্য হয়ে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে ঘরের দেওয়ালে কাঠকয়লা দিয়ে লিখে গিয়েছিলেন তার শেষ জীবনের কবিতাগুলো।</p> <p style="text-align:justify"><strong>জাফরের দুই পুত্রকে ‘ব্রিটিশ’ বানানোর ভাবনা</strong></p> <p style="text-align:justify">নেলসন ডেভিস কলকাতায় কর্মকর্তাদের কাছে যে ১১ পাতার রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন, তাতে সম্রাটের দুই পুত্রকে নিয়ে একটি অদ্ভুত পরিকল্পনার অবতারণা করেছিলেন মি. ডেভিস। তিনি সরকারের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, বাহাদুর শাহ জাফরের দুই পুত্রকে ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলে তাদের যাতে ‘অ্যাংলিসাইজড রাজা’ হিসাবে সামনে নিয়ে আসা যায়। এই প্রস্তাব দেওয়ার আগে ‘দিল্লির প্রাক্তন রাজা’র দুই পুত্রের ‘জ্ঞানের পরিধি’ নিয়েও কিছু কথা লিখেছিলেন তিনি।</p> <p style="text-align:justify">মি. ডেভিস লিখেছিলেন, দুই ছেলের মধ্যে বড়, মির্জা জওয়াঁ বখত্ একটু ‘হামবড়া’ ভাব দেখাতেন। তবে তিনি এবং তার সৎ-ছোটভাই – দুজনেই একেবারেই অজ্ঞ ছিলেন। বড়জন সামান্য হলেও ফার্সি লিখতে পড়তে পারতেন কিন্তু একেবারে সাধারণ বিষয়েও তাদের কোনও জ্ঞানই ছিল না। এমনকি তাদের নিজের দেশের সীমানা কতটা সেটাও তারা জানতেন না। তবে, দুজনের মধ্যেই জানার ইচ্ছা ছিল প্রবল।</p> <p style="text-align:justify">এই দুই ভাইয়ের জানার ইচ্ছা দেখে মি. ডেভিস মনে করেছিলেন যে, দুই রাজপুত্রকে যদি ইংল্যান্ডে পাঠানো যায় তাহলে ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশদের পছন্দ করবে, এমন দুই মুঘল রাজপুত্র গড়ে তোলা যাবে। তবে কলকাতায় বড়লাট, অর্থাৎ গভর্নর জেনারেলের দফতরে রেঙ্গুন থেকে ওই প্রস্তাব এসে পৌঁছানোর পরেই তা পত্রপাঠ খারিজ হয়ে গিয়েছিল।</p> <p style="text-align:justify">‘যেসব তুচ্ছ বিষয় সরকারের জানার দরকার নেই’, তা যেন এরপর থেকে নিজের চিঠিতে আর না লেখেন মি. ডেভিস, এটা স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মি. ডেভিসের পরবর্তী কিছু রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে সম্রাটের দুই সন্তানের ইংরেজি শিক্ষা চলছিলই। তারা নিয়মিত মি. ডেভিসের বাড়িতেও যেতেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সম্রাটের মৃত্যু</strong></p> <p style="text-align:justify">সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে যখন রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো হল, তখন তার বয়স ৮৩ বছর। শরীর-স্বাস্থ্য-মন – স্বাভাবিকভাবেই ভেঙ্গে গেছে তখন। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য নিয়মিত খেয়াল রাখত তাদের হাতে বন্দী ‘দিল্লির প্রাক্তন রাজা’র শরীরের দিকে। শারীরিক অবস্থার রিপোর্টও পাঠানো হত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। মি. নেলসন ডেভিস তার চিঠিতে লিখেছেন যে, বাহাদুর শাহ জাফরের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন রেঙ্গুনের সিভিল সার্জেন। আবার তিনি এও লিখেছিলেন যে ‘দিল্লির রাজা’ এবং তার কিশোরী পুত্রবধূ শাহ জামানি বেগম সামান্য কারণেই ডাক্তার দেখাতে চাইতেন।</p> <p style="text-align:justify">বৃদ্ধ সম্রাটের কথা বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হত মি. ডেভিসের, কারণ, “তার দাঁত পড়ে গিয়েছিল।“ তবে, ১৮৬২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে খুব দ্রুতই স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে তার। অবশেষে সে বছরেই সাতই নভেম্বর মৃত্যু হয় শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের। এবারে তাকে দাফন করার পালা।</p> <p style="text-align:justify">এ নিয়ে ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মনে প্রথমেই যে ভয়টা ঢোকে, তা হল খুব দ্রুত এবং যথাসম্ভব গোপনে কবর দেওয়ার ব্যাপারটা সেরে না ফেলতে পারলে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাকে কবর দেওয়ার পরের দিন রাজধানী কলকাতায় সরকারের কাছে পাঠানো একটি চিঠিতে লেখা হয়েছিল সে আশঙ্কার কথা। সম্রাটের মৃত্যুর খবর দিল্লিতে পৌঁছেছিল প্রায় দুই সপ্তাহ পরে, ২০শে নভেম্বর। প্রাথমিকভাবে কবরের জায়গাটা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সেই বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে নষ্ট হয়ে যায়। কবরের ওপরে জন্মায় ঘাসের পুরু আস্তরণ। ক্রমশ হারিয়ে যায় শেষ মুঘল সম্রাটের কবরটি। কিন্তু বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর প্রায় ৪০ বছর পরে বিষয়টি নিয়ে আবারও চিঠি আদান প্রদান শুরু হয়।</p> <p style="text-align:justify">মোটামুটিভাবে একটি স্থান নির্ধারিত হয়, যেখানে একটি ফলকও বসানো হয়। আর ১৯৯১ সালে সেখানে মাটি খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া যায় আসল কবরটি। উদ্ধার হয় তার কঙ্কালও। এখন সেখানে নির্মিত হয়েছে বড়সড় সমাধি ক্ষেত্র।</p> <p style="text-align:justify"><strong>বাদশাহ-র মৃত্যুর পরে পরিবারে অশান্তি</strong></p> <p style="text-align:justify">সম্রাটের মৃত্যুর পরেই তার পরিবারে নেমে এসেছিল তুমুল অশান্তি, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে কেউ কারও সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলতেন না। সেই অশান্তির কিছুটা বিবরণ ব্রিটিশ নথিতে পাওয়া যায়। মিয়ানমারের জাতীয় আর্কাইভসে সে নথি খুঁজে পেয়েছেন লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পল।</p> <p style="text-align:justify">মি. ডালরিম্পল লিখেছেন, "জাফরের মৃত্যুর পরে মুঘল রাজকীয় পরিবারের যা অবশিষ্ট ছিল, তা খুব কম সময়ের মধ্যেই ভেঙ্গে পড়ল। ক্যাপ্টেন ডেভিস কলকাতায় পাঠানো তার রিপোর্টে লিখেছিলেন, যে সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব তারা করে, মুঘলদের মধ্যে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে এখন।"</p> <p style="text-align:justify">ওই নথিতে মি. ডালরিম্পল দেখেছেন যে বেগম জিনাত মহলের সঙ্গে তার ছেলে এবং পুত্রবধূর ভয়াবহ ঝগড়া চলছিল। সম্রাটের পত্নী একদিকে, জওয়াঁ বখত ও তার স্ত্রী দ্বিতীয় একটা গোষ্ঠী এবং সম্রাটের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শাহ আব্বাস ও তার মা এবং নানি তৃতীয় একটা পক্ষ।</p> <p style="text-align:justify">“তিনটি পক্ষই নিজেদের ঘর পৃথক করে নিয়েছেন, রান্না-খাওয়াও আলাদা হয়ে গেছে এবং বলতে গেলে কোনও কথাবার্তাই নেই এক পক্ষের সঙ্গে অপর পক্ষের,” লিখেছেন মি. ডালরিম্পল।</p> <p style="text-align:justify">ওই একই সময়ে বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্রবধূ শাহ জামানি বেগম ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যেতে শুরু করেন। সেই অবস্থাতেও তাকে পারিবারিক পোশাক-গয়না বন্ধক রেখে নিজের ও সন্তানদের খাবারের যোগাড় করতে হত। মি. নেলসন ডেভিস তার রিপোর্টে লিখেছেন যে, ১৮৭২ সালের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান শাহ জামানি বেগম। অন্যদিকে, সম্রাট-পত্নী জিনাত মহল নিজের অর্থেই একটা বাড়ি কিনে সেখানেই একাকী জীবন যাপন শুরু করেন। সঙ্গে দুই-তিনজন পরিচারক থাকতেন।</p> <p style="text-align:justify">জিনাত মহল একটা সময়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন যে, জওয়াঁ বখতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি ভারতে ফিরে যেতে চান। স্বাভাবিকভাবেই সে আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আফিমের নেশা করতে শুরু করেন সম্রাট-পত্নী।</p> <p style="text-align:justify">আর সম্রাটের কনিষ্ঠ পুত্র শাহ আব্বাসের সঙ্গে বিয়ে হয় রেঙ্গুনের স্থানীয় এক মুসলমান ব্যবসায়ীর কন্যার। তারা আলাদাভাবেই বসবাস শুরু করেন।</p> <p style="text-align:justify">এটি অবশ্য শাহ আব্বাসের প্রথম বিয়ে, পরে তিনি অন্তত আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন। বাহাদুর শাহ জাফরের মৃত্যুর প্রায় ২০ বছর পরে তার প্রিয় স্ত্রী জিনাত মহলকেও প্রায় একই জায়গায় দাফন করা হয়।</p> <p style="text-align:justify">তাদের বড় পুত্র, মুঘল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে যাকে একসময়ে স্থির করেছিলেন সম্রাট নিজেই, সেই মির্জা জওয়াঁ বখত্ মাত্র ৪২ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান।তার কবরও বাবা-মায়ের কবরের কাছাকাছিই কোনও এক জায়গায় ছিল।</p> <p style="text-align:justify"><strong>সম্রাটের নাতি দিল্লিতে ভিক্ষা করতেন</strong></p> <p style="text-align:justify">শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও তার পরিবারকে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানো পর থেকে তার পরিবারের প্রায় সব খরচ খরচাই দিত ব্রিটিশ সরকার। জওয়াঁ বখতের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবথেকে বড় সন্তান জামশিদ বখত। বিয়ের আগে তাকে মাসিক ১৫০ টাকা করে পেনশন দিত সরকার।</p> <p style="text-align:justify">বিয়ের পরে মাসিক ২৫০ টাকা করে, বাড়ি ভাড়া ইত্যাদির জন্য আরো মাসিক ১০০ টাকা আর তার স্ত্রীর জন্য ১০০টাকা পেনশন ধার্য করে। মুঘল বংশের যেসব সদস্য বেনারস বা দিল্লিতেই থেকে গিয়েছিলেন, মাসিক ভাতা পেতেন তারাও। সেই পেনশনের পরিমাণ ছিল কারও জন্য মাসিক পাঁচ টাকা, কেউ পেতেন সাত বা ১০ টাকা।</p> <p style="text-align:justify">ভারত সরকারের ১৮৯৯ সালের বিদেশ দফতরের একটি নথি পাওয়া যায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে দিল্লির সাবেক রাজপরিবারের ৩৬ জন নারী সদস্যের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা করে পেনশন মঞ্জুর করা হচ্ছে। ইতিহাসিবিদ হাসান নিজামি তার বই ‘বেগমাৎ কে আসুঁ’ বইতে দিল্লির এমন এক ভিখারির কাহিনী লিখেছেন, যাকে সন্ধ্যের অন্ধকারে ভিক্ষা করতে বেরতে হত।</p> <p style="text-align:justify">“সেই ভিখারি কাল্লু খাস কি হাভেলি থেকে বেরিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে, পক্ষাঘাতগ্রস্ত পা টেনে টেনে, খুব ধীরে ধীরে সোজা জামা মসজিদের দিকে চলে যেতেন। একেক মিনিট পর পর তিনি হাঁক দিতেন, ‘হে আল্লা, দয়া করে আমাকে এক টাকার মতো আটা জুগিয়ে দিন। শুধু আপনিই পারেন দান করতে..' “হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া দিল্লির বাসিন্দারা কেউই জানত না যে তিনি সম্রাটের আসল নাতি, এবং তার নাম মির্জা কামার সুলতান,” লিখেছেন হাসান নিজামি।</p> <p style="text-align:justify"><strong>আরো যেসব কারণে ব্রিটিশদের সাহায্য চাইতে হত</strong></p> <p style="text-align:justify">মাসিক পেনশনের বাইরেও নানা কারণে ব্রিটিশ সরকারের কাছে হাত পাততে হত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বংশধরদের। ন্যাশনাল আর্কাইভসে এরকম বহু নথি পাওয়া গেছে। যেমন ১৯১৫ সালের একটি ফাইলে দেখা যাচ্ছে যে সম্রাটের বড় নাতি মির্জা জামশিদ বখত সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন 'শরীর-স্বাস্থ্য ঠিক করার জন্য' তৎকালীন বার্মার একটি শহরে যাতে তিনি ঘুরতে যেতে পারেন। সে আবেদনের ভিত্তিতে তাকে ৫০০ টাকা মঞ্জুর করেছিল সরকার।</p> <p style="text-align:justify">এর আগে সম্রাটের বড় ছেলে জওয়াঁ বখতের স্ত্রী শাহ জামানি বেগমের দাফনের জন্যও বাড়তি খরচের অনুমোদন চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন রেঙ্গুনের ‘রাজকীয় বন্দীদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। অন্যদিকে, সম্রাটের ছোটপুত্র শাহ আব্বাস ১৯১০ সালের ২৫শে ডিসেম্বর রেঙ্গুনেই মারা যান। তারপরের বছর থেকে তার তৃতীয় স্ত্রী, বিধবা জুম্মা বিবি মাসিক ৪০ টাকা পেনশন পেতেন। এ অর্থ দিয়ে জুম্মা বিবিকে বড়সড় সংসার চালাতে হত, যে সংসারে ছিলেন বিধবা পুত্রবধূ, আর তিন নাতি-নাতনি।</p> <p style="text-align:justify">তবে, ১৯১৩ সালে তিনি ভারতের মসলিপটনমে ফিরে যেতে চান তার নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছে। জাহাজ ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা দেওয়ার আবেদন করেন জুম্মা বিবি। সেই আবেদন মঞ্জুরও হয়েছিল। </p> <p style="text-align:justify"><strong>যে পরিবারকে এত ভয়, কেন তাদের পেনশন?</strong></p> <p style="text-align:justify">বাহাদুর শাহ জাফরকে গ্রেফতার করার পর থেকে বারে বারেই ব্রিটিশ সরকারের নথিতে দেখা গেছে যে এই পরিবারের কেউ যাতে আবারও ১৮৫৭-র মতো কোনও বিদ্রোহে নেতৃত্ব না দিতে পারেন, তা নিয়ে একটা ‘দুশ্চিন্তা’ ছিলই। যে পরিবারটিকে নিয়ে এতই ভয় ছিল, তাহলে কেন তাদের ভরণ-পোষনের সব আর্থিক দায় নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার? সহায়তা এবং ভাতা দেওয়া নিয়ে এমন বেশ কিছু ফাইল ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভসে পাওয়া যায়, যেখানে কর্মকর্তাদের মধ্যেও এই ব্যাপারে নানা মত যে ছিল, তা বোঝা যায়।</p> <p style="text-align:justify">‘ইন্ডিয়ান হিস্টরি কংগ্রেস’-র সচিব ও আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক আলি নাজিম রেজাভি বলছিলেন, “বাহাদুর শাহ জাফরের সঙ্গে ব্যবস্থাটাই এরকম ছিল যে আপনার সব ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, পরিবর্তে আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের।“ এই ব্যবস্থাটা পারিবারিক পেনশনের, অর্থাৎ জাফরের পরে তার বংশধরেরাও এই পেনশন পাবেন – সেটাই ছিল বন্দোবস্ত।</p> <p style="text-align:justify">এক কথায় বলতে গেলে, আপনি এবং আপনার বংশধরেরা আমাদের শাসনে, রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নাক গলাবেন না, তা থেকে দূরে থাকবেন, পরিবর্তে আপনার পরিবারের প্রয়োজনগুলো আমরা দেখব,” বলছিলেন অধ্যাপক রেজাভি।</p> <p style="text-align:justify"><strong>এখন কোথায় মুঘল বংশের উত্তরসূরিরা?</strong></p> <p style="text-align:justify">বাহাদুর শাহ জাফরের কয়েকজন পুত্রকে হত্যা করা হয়েছিল, অন্য কয়েকজন পুত্র, কন্যা পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বেঁচেছিলেন। দুই পুত্র তার সঙ্গে রেঙ্গুনে নির্বাসনে গিয়েছিলেন। তবে, সম্রাট-পরবর্তী তৃতীয় প্রজন্ম থেকে মুঘল বংশের সব উত্তরসূরিদের খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন কাজ, বলছিলেন ইতিহাসবিদ রাণা সাফভি।</p> <p style="text-align:justify">ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভসের নথি ঘেঁটে বিচ্ছিন্নভাবে বাহাদুর শাহ জাফরের পরবর্তী প্রজন্মের বংশধরদের কারও কারও খোঁজ পাওয়া যায়, তবে সম্পূর্ণ বংশলতিকা যোগাড় করা কার্যত অসম্ভব। ওই বংশের সদস্যদের মাসিক ভাতা, পড়াশোনার খরচ বা বিয়ে অথবা কবর দেওয়ার মতো কাজে খরচ জোগানো নিয়ে ১৯২৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের অনেকগুলি দফতরের মধ্যে ফাইল আদানপ্রদান হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যাচ্ছে যে, ১৯২৫ সালে ‘প্রাক্তন রাজার’ পরিবারের ১৬৬ জন সদস্যকে পেনশন দেওয়া হত।</p> <p style="text-align:justify">অনেক নথি থেকে এটা স্পষ্ট যে তার বংশধরেরা ভারত, মিয়ানমার এবং সম্ভবত পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এখন তারা কে কোথায়, তা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। যদিও কোনও কোনও ব্যক্তি ও পরিবার দাবি করে যে তারা মুঘল পরিবারের বংশধর। কিন্তু তাদের সে দাবি নিয়ে ইতিহাসবিদদের সন্দেহ যেমন আছে, তেমনই তারা এটাও মনে করেন এইসব পরিবারগুলির দাবি সত্যিও হতেও পারে, আবার ভুয়াও হতে পারে। মুঘল পরিবারের ভুয়া উত্তরসূরি আগেও ধরা পড়েছে।</p> <p style="text-align:justify">অধ্যাপক আলি নাদিম রেজাভি বলছিলেন, “যে অবস্থায় মুঘল রাজ পরিবারের সদস্যদের দিল্লি থেকে পালাতে হয়েছিল, তখন তারা নিজেদের বংশ পরিচয় সংক্রান্ত প্রমাণ সঙ্গে রাখবেন, এটা আশা করা যায় না। তারা তখন প্রাণভয়ে পালিয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">“তাই মুঘল পরিবারের বংশধর যে আসলে কারা, তা প্রমাণ করা অসম্ভব। যারা দাবি করছেন নিজেদের ওই বংশের উত্তরসূরি হিসাবে, হতেই পারে সে সঠিক দাবি। আবার ভুয়া দাবিও হতেই পারে। আমাদের হাতে সেরকম কোনও প্রমাণ বিশেষ নেই,” বলছিলেন অধ্যাপক রেজাভি। ভারতের ন্যাশনাল আর্কাইভসে রাখা ১৯২৫ সালের যে নথির কথা একটু আগেই উল্লেখ করলাম, সেখানেই দেখা যাচ্ছে যে মুঘল রাজবংশের সদস্য হিসাবে পেনশন পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন, এমন ৬০০ আবেদন প্রাথমিক তদন্তের পরেই খারিজ হয়ে গিয়েছিল।</p> <p style="text-align:justify">আবার ইতিহাসবিদ ও লেখক হাসান নিজামি তার বই ‘বেগমাৎ কে আসুঁ’ বইতে এমন একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, যিনি মুম্বাইয়ের (তৎকালীন বোম্বে) পুলিশ-প্রশাসন মহলে পরিচিত ছিলেন মুঘল রাজবংশের বংশধর হিসাবে। কিন্তু সে বংশ পরিচয় যে ভুয়া, সেটাও পরে প্রমাণিত হয়েছিল।</p>