<p>বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—আমাদের এই মাতৃভূমি রাষ্ট্রটির সবচেয়ে ব্যতিক্রমী জাতীয় নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমান নিজেকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় সফল হয়েছিলেন শতভাগ। একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাটি তখনকার বাঙালি জাতিকে নয়া উপনিবেশবাদী জালেম পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল সেই মার্চের শেষ দিনগুলো থেকেই।</p> <p>প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের ও দেশপ্রেমের শক্তিতে, অসম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জিয়াউর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে দখলদার পাকিস্তানি সেনাদের উচ্ছেদের লড়াইয়ে একজন অগ্রনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। এবং পরবর্তীকালের সত্তরের দশকের শেষভাগে এবং আশির দশকের শুরুতে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর বাংলাদেশের নতুন রূপান্তরের রাজনীতিতে বিশাল অবদান রাখার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট জিয়া নিজেকে সফল রাষ্ট্রনায়কের অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধে তথা স্বাধীনতাযুদ্ধে একজন মহাবীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ জিয়াউর রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞ জাতি তাঁকে যথার্থ ‘বীর-উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করেছিল ১৯৭২ সালে।</p> <p>আজ ৭ নভেম্বর, বাংলাদেশের ইতিহাসে লাল হরফে লেখা একটি জাতীয় দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ও নয়া উপনিবেশবাদী সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান। জাতির বিশাল সংকটের মুহূর্তে দেশপ্রেমিক বিপ্লবী সিপাহি-জনতা চক্রান্তকারীদের হটিয়ে দিয়ে, গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল এই দিনে; যদিও তখন কৌশলগত কারণে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন, জাতির পঁচাত্তর-নভেম্বরের বিপ্লবের আসল নায়ক ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান ও উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।</p> <p>বাংলাদেশের গণমানুষ অচিরেই জিয়াউর রহমানকে প্রথমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত করেছিল। জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থনের ম্যান্ডেট নিয়ে এই পদের উপযোগী মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন তিনি। এবং আরো কিছুকাল অতিবাহিত হওয়ার পরেই জনগণের সরাসরি ভোটের দ্বারা নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই বিপুল জনসমর্থনে জাতির এক নম্বর নেতা প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব লাভ করেন জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট জিয়া সামরিক শাসন থেকে যথাসম্ভব দ্রুততায় পুরো গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বা বলা চলে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।</p> <p>১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে পুরো স্বচ্ছতার প্রক্রিয়ায় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন, রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উপমহাদেশের আধিপত্যবাদী শক্তির ‘ভাড়াটে এজেন্ট হিসেবে পরিচিত’ একটি রাজনৈতিক দলের অবিরাম ষড়যন্ত্রের মাঝে জিয়াউর রহমান তাঁর সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনকালে কিছু অপ্রিয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধ্য হয়েছিলেন, তবে সব কিছুই আখেরে দেশের ও দেশবাসীর জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছিল। তখনকার দিনে আধিপত্যবাদীদের লেজুড়বৃত্তি করা রাজনৈতিক দলটির অর্বাচীন নেতারা নিজেদের মতলববাজির রাজনীতির স্বার্থে জিয়াউর রহমানকে যাচ্ছেতাই ভাষায় আক্রমণ করে তাঁর সম্পর্কে বিষোদগার করে গেছেন—এই বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তাঁর স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সমাপনকাল পর্যন্ত। জিয়াউর রহমান বা তাঁর দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সেসবের উপযুক্ত জবাব দেয়নি, অবশ্য দেশবাসী ওই ষড়যন্ত্রকারীদের কথায় কান দেয়নি, বরং তারা আরো বেশি জিয়াভক্ত হয়েছে, আরো বেশি হারে বিএনপি সমর্থক হয়েছে।</p> <p>এই রাষ্ট্রে ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পর্যালোচনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের রাজনৈতিক ভূমিকা ও অবদানের বেলায় বিপরীতমুখী নজির স্থাপনের প্রমাণ মিলেছে—যার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বোদ্ধা নাগরিকদের মনোযোগী দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।</p> <p>আওয়ামী লীগের প্রথম সরকার একদলীয় বাকশাল সরকারে রূপান্তরিত হয়ে ব্যাপক অনাচার, স্বৈরতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাপনা, অপরিসীম দুর্নীতি, সামাজিক নৈরাজ্য, দেশব্যাপী খুনাখুনির রাজত্ব, কোটি কোটি নিরীহ, শান্তিপ্রিয় দেশবাসীর জন্য নিপীড়নের অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির দ্বারা লাখো মানুষকে অনাহারে প্রাণহানির শিকার বানানো ইত্যাদি কায়েমের মাধ্যমে জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অপরিসীম ঘৃণা ও নিন্দা নিয়ে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন।</p> <p>স্মরণ রাখা দরকার, শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে না ঠেকলে তাঁকে এভাবে সপরিবারে হত্যা বা ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ অসম্ভব ছিল, এটি বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরা হাজারবার বলেছেন। একইভাবে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল (৪ আগস্ট পর্যন্ত) পর্যন্ত টানা সাড়ে ১৫ বছরে চরম ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন কায়েম করে সীমাহীন নাগরিক হত্যা, গুম-খুন, নারী ধর্ষণ, নারী-শিশু নিপীড়ন, লাখ লাখ কোটি টাকা রাষ্ট্র-সম্পদ লুট (প্রায় ৪০ লাখ কোটি টাকার রাষ্ট্র-সম্পদ লুণ্ঠন করেছে আওয়ামী লীগ দস্যু-ডাকাতের দল) করে শেষ পর্যন্ত রাজপথে ন্যায়সংগত আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর গণহত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তাদের প্রায় এক হাজার ৮০০ জন খুন করে কোটি কোটি দেশবাসীর অপরিসীম ঘৃণা সম্বল করে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে বেঁচেছেন।</p> <p>উল্টো দিকে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়া তাঁর ক্ষমতায় আসার অনেক আগেই এ দেশের গণমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রক্ষমতায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। একইভাবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছেন ২০২৪ সালের শিক্ষার্থী-জনতার বিপ্লবী গণ-অভ্যুত্থানে—বাংলাদেশের গণমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে।</p> <p>জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রচণ্ড পরিশ্রম করে, মেধা-মনন দিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি প্রচলনের পক্ষে পর্যাপ্ত যুক্তি জাতির সামনে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।  জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নের একটি মুক্তি সনদতুল্য কর্মসূচি। সেই দফাগুলো :</p> <p>১. সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা;</p> <p>২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা;</p> <p>৩. সব উপায়ে নিজেদের একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা;</p> <p>৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা;</p> <p>৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা;</p> <p>৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ক্ষুধার্ত না থাকে তার ব্যবস্থা করা;</p> <p>৭. দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সবার জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা;</p> <p>৮. কোনো নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা;</p> <p>৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা;</p> <p>১০. সব দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা;</p> <p>১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা;</p> <p>১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান;</p> <p>১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা;</p> <p>১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তিকে উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা; ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা;</p> <p>১৬. সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা;</p> <p>১৭. প্রশাসন ও উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা;</p> <p>১৮. দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা; ১৯. ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সব নাগরিকের পূর্ণ অধিকার সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা।</p> <p>অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনীতির প্রতি সাংঘাতিক ঈর্ষাকাতর থাকার পরও এই ১৯ দফা কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছিল। কারণ ওই দুটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল যে নিপীড়িত গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে রাজনীতি করার সোচ্চার ঘোষণা দিত, ‘সেই ঘোষণার রাজনীতি’ যাতে হালে পানি পায়, সেই উদ্দেশ্যেই তারা জিয়ার গণমানুষের মুক্তির এই ১৯ দফা কর্মসূচি সমর্থন করে। তবে তা দ্বারা তারা জিয়ার রাজনীতির সারবত্তার স্বীকৃতি দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ অনুসারী রাজনীতিকরা নেহাত ঈর্ষাপরায়ণতার কারণে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশি রাজনীতির সব কিছু বিরোধিতা করতেন—শুধু ‘বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার লক্ষ্যে’।</p> <p>সেসব সত্ত্বেও জিয়াউর রহমান তাঁর সাড়ে পাঁচ বছরের (১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের ২৯ মে পর্যন্ত) রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সময়কালে এই রাষ্ট্রটিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েম, অর্থনীতিকে সবল করা, উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ ও দেশবাসীকে সম্পৃক্ত করা এবং তার সঙ্গে মুসলিম বিশ্ব ও চীনের সঙ্গে, জাপান ও এই অঞ্চলের অন্য সব রাষ্ট্রের সঙ্গে, এমনকি প্রবল শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র দুটির সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেন। তাই তিনি সফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান—সারা বিশ্ব সে স্বীকৃতি দিয়েছে।</p> <p><em>লেখক : বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক</em></p>