<p>অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তকে নির্দিষ্ট কিছু বাজারকে ‘প্রতিযোগিতামূলক বাজার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কোনো বিক্রেতা বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না; বাজারমূল্য নির্ভর করে সরবরাহ ও চাহিদার ওপর।</p> <p><strong>প্রতিযোগিতামূলক বাজারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে :</strong></p> <p>ক. বাজারে প্রচুর ক্রেতা-বিক্রেতা থাকতে হবে,<br /> খ. সরবরাহ বা চাহিদার পরিবর্তনের কারণে বাজারমূল্য পরিবর্তন হবে,<br /> গ. নতুন বিক্রেতা সহজে বাজারে প্রবেশ করতে পারবেন এবং<br /> ঘ. ক্রেতা-বিক্রেতা সহজে প্রয়োজনীয় তথ্য জানতে পারবেন।</p> <p>বাংলাদেশে শাক-সবজি, মুরগি, ডিম ও মাছের মতো কৃষিপণ্যের বাজার প্রতিযোগিতামূলক। হাজার হাজার কৃষক প্রতিদিন পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে এই পণ্যগুলো বিক্রি করেন। পাইকারি ব্যবসায়ীরা হাজারো খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করেন একই পণ্য। শহরের বাজারমূল্য গ্রামের বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি হয়, যে কারণে ব্যবসায়ীরা গ্রাম থেকে শহরে পণ্য পরিবহন করেও লাভে বিক্রি করতে পারেন।<br /> প্রত্যেক পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা কম দামে পণ্য কিনতে চান। সুতরাং কোনো কৃষক যদি তার এলাকার অন্যদের চেয়ে বেশি মূল্য দাবি করেন, তাহলে কোনো পাইকারি ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে পণ্য কিনবেন না। একইভাবে যদি কোনো পাইকারি ব্যবসায়ী অন্যদের তুলনায় বেশি মূল্য দাবি করেন, তাহলে তার কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতা কিনবেন না।</p> <p>গত দুই বছরে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) অভিযোগ করেছে যে পোলট্রি কম্পানি যোগসাজশ করে ডিম ও মুরগির দাম বাড়িয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশন কিছু কম্পানিকে কোটি কোটি টাকা জরিমানা করেছে, তবে হাইকোর্ট এই জরিমানার আদেশ স্থগিত করেছেন।<br /> একটি তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিযোগিতা কমিশন বলেছে, কাজী ফার্মস এবং অন্যান্য ডিম উৎপাদনকারী কম্পানি একসঙ্গে তাদের বিক্রয়মূল্য বাড়িয়েছে (জুলাই ২০২৩ মাসে) এবং বলেছে যে এতে যোগসাজশ প্রমাণিত হয়। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছে যে পোলট্রি কম্পানিগুলো ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা এসএমএস পাঠানোর মাধ্যমে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। বিষয়টি বিশদভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন।</p> <p>(ক) যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রচুর বিক্রেতা থাকেন।<br /> ডিমের বাজারে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এই বাজারে রয়েছেন প্রচুর বিক্রেতা এবং কোনো বিক্রেতাই মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার মতো বাজার শেয়ার রাখেন না। কাজী ফার্মস ২০২২ সালে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লাখ ডিম উৎপাদন করছিল। তখন কাজী ফার্মসের ডিমের বাজারে শেয়ার ছিল ২.৫% থেকে ৩%। বাজারে এত কম শেয়ার থাকা সত্ত্বেও একটি কম্পানির বিরুদ্ধে মূল্য নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ করা অযৌক্তিক।</p> <p>(খ) একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার পরিবর্তনের সঙ্গে বাজারমূল্য ওঠানামা করে।<br /> ডিমের বাজারে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বিভিন্ন মৌসুমে ডিমের দাম ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করা হয় তা বোঝা যায়। ডিমের দাম সাধারণত শীতকালে কমে যায়, যখন শীতের শাক-সবজি পাওয়া যায়। অনেক ভোক্তা তখন ডিমের পরিবর্তে শাক-সবজি কেনেন। তাই শীতকালে ডিমের চাহিদা কমে যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই দাম কমে যায়।</p> <p>গ্রীষ্মকালে গরমে মুরগি কম ডিম পাড়ে, যার ফলে ডিমের সরবরাহ কমে যায় এবং বাজারমূল্য বেড়ে যায়। দেশে বন্যা হলে ডিমের দাম সাধারণত বাড়ে। একটি এলাকা প্লাবিত হলে কৃষক তার মুরগি বিক্রি করে উৎপাদন বন্ধ করে দেন। তাই বন্যায় ডিমের সরবরাহ কমে যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে যায়।</p> <p>২০২৩ সালে গ্রীষ্মের তাপ ও বন্যার কারণে ডিমের দাম বেড়েছিল; ২০২৪ সালেও এর পুনরাবৃত্তি হয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশন ২০২৩ সালে পোলট্রি কম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ করেছিল; কিন্তু সংকটের কারণে দাম বেড়েছিল, যোগসাজশের কারণে নয়। </p> <p>সরকারি কর্মকর্তারা প্রমাণ ছাড়াই বলেছেন, কাজী ফার্মস ডিমের দাম বাড়ালে সারা দেশের ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম বাড়ায়। এটি সঠিক নয়। ১৪ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে কাজী ফার্মসের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রতিটি ডিম ১১.০১ টাকায় বিক্রি হয়েছে (কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের দ্বারা নির্ধারিত সর্বোচ্চ পাইকারি মূল্য)। তবে সেই তারিখে ঢাকায় প্রতিটি ডিমের খুচরা মূল্য ছিল প্রায় ১৪.৭৫ টাকা। খুচরা মূল্য বেশি ছিল, কারণ ডিমের সংকট ছিল। খুচরা মূল্য ডিমের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে, কাজী ফার্মসের বিক্রয়মূল্যের ওপর নয়।</p> <p>যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক বাজারে প্রত্যেক বিক্রেতা ‘মূল্য গ্রহণকারী’ হন। যখন উৎপাদন চাহিদার চেয়ে কম হয়, তখন বাজারে মূল্য বেশি হয় এবং সব বিক্রেতা উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে সক্ষম হন। যখন চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়, তখন বাজারমূল্য কম হয় এবং সব বিক্রেতা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এভাবেই একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাজ করে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সব বিক্রেতা কাছাকাছি দামে বিক্রি করবেনই, এতে যোগসাজশ প্রমাণিত হয় না।</p> <p>(গ) একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নতুন ব্যবসায়ী প্রবেশে কোনো বাধা থাকে না।<br /> ডিমের বাজারে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যে কেউ মুরগির ঘর নির্মাণ করে, লেয়ার মুরগির বাচ্চা কিনে ডিম উৎপাদন শুরু করতে পারে। যখন ডিমের মূল্য কম থাকে, অনেক ডিমের খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন খামারিরা তাদের মুরগি বিক্রি করে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হন। এতে ডিমের সরবরাহ কমে যায় এবং ডিমের মূল্য বেড়ে যায়। মূল্য বেড়ে যাওয়ার পর বেশির ভাগ ডিমের খামার লাভজনক হয়ে ওঠে।</p> <p>যখন ডিমের মূল্য বেশি থাকে, তখন বন্ধ খামারগুলোতে লেয়ার মুরগির বাচ্চা কিনে আবার ডিম উৎপাদন শুরু করেন খামারিরা। কিছু খামারি নতুন ডিমের খামারও নির্মাণ করেন। ধীরে ধীরে ডিমের সরবরাহ বেড়ে যায় এবং দাম কমে যায়।</p> <p>দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ডিমের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে। মাঝে মাঝে সংকট দেখা দেবে এবং সংকটের কারণে ডিমের উচ্চমূল্য হয়। ডিমের সংকটের সময় ডিমের উচ্চমূল্য দেখে খামারিরা উৎপাদন বাড়াতে উৎসাহিত হন। যদি সরকার সংকটের সময় ডিমের মূল্য বাড়াতে না দেয়, তাহলে খামারিদের উৎপাদন বাড়ানোর কোনো আগ্রহ থাকবে না এবং সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে।</p> <p>সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ডিম উৎপাদনকারীদের জন্য ডিমপ্রতি ১০.৫৮ টাকা সর্বোচ্চ মূল্য ঘোষণা করেছে। এত কম মূল্যে ডিম বিক্রি করে অতি নগণ্য মুনাফায় খামারিরা একসময় পোলট্রি ব্যবসায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন, নতুন কেউ ডিমের খামারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহীও হবেন না। এটি একটি অদূরদর্শী নীতি।</p> <p>(ঘ) প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জন্য মূল্য সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সহজ।<br /> ডিমের বাজারে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। একজন ব্যবসায়ী গাজীপুরের খামার থেকে ডিম কিনে তা গাজীপুরের পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে পারেন অথবা ঢাকার পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে পারেন। দুই বাজারের দাম তার প্রতিদিন জানতে হবে। পাইকারি ব্যবসায়ী গ্রামাঞ্চলের খামার থেকে ডিম কেনেন, যেখানে দাম কম। সেই ডিম শহরের বাজারে বিক্রি করেন, যেখানে দাম বেশি। পাইকারি ব্যবসায়ী ডিম কেনার আগে প্রতিদিন বিভিন্ন খামারির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ডিম বিক্রি করার আগে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ ধরনের যোগাযোগ ছাড়া ঢাকার মতো বড় বাজারে ডিমের ঘাটতি দেখা দেবে।</p> <p>বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা প্রায়ই এসএমএসের মাধ্যমে দামের তথ্য আদান-প্রদান করেন। বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন যে এসএমএস বার্তার মাধ্যমে দামের কারসাজি হয়। সরকারি কর্মকর্তারা বুঝতে পারেননি যে দামের তথ্য সহজে পাওয়া গেলে সেটা প্রতিযোগিতামূলক বাজারের লক্ষণ। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা সবারই মূল্যের তথ্য জানার অধিকার আছে। সব ক্রেতা-বিক্রেতা যদি একই তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করেন, তারা অনেক সময় একই সিদ্ধান্ত নেবেন। যে জেলায় সরবরাহ বেশি সেখানে কম মূল্যে কিনবেন এবং যে শহরে চাহিদা বেশি সেখানে বেশি মূল্যে বিক্রি করবেন। সরবরাহ কমলে দাম বাড়ে, এতে যোগসাজশ প্রমাণিত হয় না।</p> <p>ডিমের মূল্যবৃদ্ধি দেখে প্রতিযোগিতা কমিশন এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) কোনো অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করেই ভিত্তিহীন ধারণা করে ফেলেছে যে যোগসাজশ করে দাম বাড়ানো হয়েছে। প্রতিযোগিতা কমিশনের উচিত পেশাদার অর্থনীতিবিদ নিয়োগ করা। যোগসাজশের ভিত্তিহীন অভিযোগ পোলট্রি শিল্পে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করেছে। বিনিয়োগ না হলে ডিমের বর্তমান ঘাটতি থেকে যাবে।</p> <p><strong>লেখক :</strong> কাজী ফার্মসের একজন পরিচালক।</p>