<p>বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে যে কয়েকটি দিবস ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, তার মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী দিবস অন্যতম। মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ, মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কর্মরত প্রায় ২৬ হাজার সুপ্রশিক্ষিত বাঙালি অফিসার ও সদস্য বিদ্রোহ করেন এবং মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেন। এর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথমে পাঁচটি ও পরবর্তীতে নব প্রতিষ্ঠিত আরো তিনটি ব্যাটালিয়ন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।</p> <p>জাগ্রত মুক্তিসেনাদের সম্মিলিত আক্রমণে যখন পাক হানাদার বাহিনী নাস্তানাবুদ ও কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল, তখন কর্ণেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ওসমানী ও কিছু অসীম সাহসী সামরিক কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনী গঠনের এক দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। গণপ্রতিরোধ রূপ নেয় সশস্ত্রযুদ্ধে। সশস্ত্রযুদ্ধের চূড়ান্তক্ষণে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি কনভেনশনাল বা প্রথাগত যুদ্ধ শুরু করার জন্য ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিমান বাহিনী সম্মিলিতভাবে জল-স্থল ও আকাশপথে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র এক সমর যুদ্ধের নব সূচনা করে। সে কারণে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে স্মরণ করা হয়।</p> <p>স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল পরবর্তী সময় থেকে ২১ নভেম্বরকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এর পূর্বে ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী, ১০ ডিসেম্বর নৌবাহিনী এবং ২৮ সেপ্টেম্বর বিমান বাহিনী স্বতন্ত্রভাবে তাদের নিজস্ব বাহিনী দিবস পালন করত। স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিকামী গণজনতার আজীবন লালিত স্বপ্নকে গোটা সশস্ত্র বাহিনী তাদের সুনিপুণ পরিকল্পনা, অদম্য সাহস ও আত্মত্যাগের যে অসাধারণ ইতিহাস রচনা করেছে তাকে স্মরণ রাখতে স্বতন্ত্রভাবে উদযাপন বাদ দিয়ে সম্মিলিতভাবে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অবদানকে দেশের জনগণের আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে দেখা হয়।</p> <p>১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ, সেই ভয়াল কাল রাতে যখন পাকিস্তানি হায়েনারা নৃশংস গণহত্যা শুরু করে, ঠিক তখনই বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাঁচটি ইউনিট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদের বাঙালি সদস্যরা। যুদ্ধ ঘোষণা করেন সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তসহ বাঙালি মুক্তিকামী হাজার হাজার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক। মুক্তির সংগ্রাম রূপ নেয় সশস্ত্র সংগ্রামে। সংগ্রাম তখন এগিয়ে চললেও প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় একটি সম্মিলিত সংগঠিত সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বের। সেই প্রয়োজন থেকেই ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমায় (বর্তমানে জেলা) মাধবপুর থানার তেলিয়াপাড়ায় কর্ণেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা মিলিত হয় এক নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়ে।</p> <p>লে. কর্ণেল রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মোশাররফ, লে. কর্ণেল সালাহউদ্দিন মো. রেজা, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর রফিকুল ইসলাম, মেজর এ এস এম নুরুজ্জামান, উইং কমান্ডার এম কে বাশার, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর নাজমুল হক, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর এম এ জলীল, মেজর জয়নাল আবেদিন, মেজর এম এ মঞ্জুর, মেজর এম এ আবু তাহের এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র এক যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন।</p> <p>বৈঠকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ, মুক্তিযুদ্ধ মনিটরিং সেল গঠন, সামরিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, কমান্ডার নিয়োগ ও দায়িত্ব বণ্টনের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বৈঠকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোর কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বৈঠকে সেদিন থেকেই বাংলাদেশর সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলোকে ‘মুক্তিবাহিনী’ নামে অভিহিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। মেজর সফিউল্লাহকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া-সিলেট অঞ্চল, মেজর খালেদ মোশাররফকে কুমিল্লা-নোয়াখালী অঞ্চল, মেজর জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রাম ও পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এলাকার দায়িত্ব দিয়ে কমান্ডার হিসেবে মনোনীত করা হয়। বৈঠক শেষে কর্ণেল (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ওসমানী সবাইকে দেশ স্বাধীনের শপথ বাক্য পাঠ করান।</p> <p>১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় দ্বিতীয় বৈঠকে সারা দেশকে চারটির স্থলে ছয়টি সামরিক অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিনকে। বৃহত্তর রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলা নিয়ে গঠিত অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর নাজমুল হককে। পরবর্তীতে ১২-১৫ জুলাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তর কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশর সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে বাংলাদেশ ফোর্সেস সদর দপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোর অনুমোদন দেওয়া হয়। কর্নেল এম এ জি ওসমানী (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল)-কে বাংলাদেশ ফোর্সেসের কমান্ডার-ইন-চিফ (কেবিনেট মিনিস্টার মর্যাদাসহ) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়াও সভায় লে. কর্নেল (অব.) এম এ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্তি দেওয়া হয়। কর্নেল ওসমানী (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) মুক্তিবাহিনীর সব বিচ্ছিন্ন সংগঠনকে কেন্দ্রীয় কমান্ডারের আওতায় নিয়ে আসেন এবং ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে অপারেশনাল নির্দেশনার প্রণয়ন করেন।</p> <p>পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বিদ্রোহ বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য এবং তৎতকালীন ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও নির্বাচিত সাধারণ জনতার সমন্বয়ে গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনী বা ‘মুক্তিবাহিনী’। অপরদিকে সাধারণ ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিক, স্বেচ্ছাসেবী এবং আপামর জনসাধারণকে নিয়ে গেরিলা পদ্ধতির আদলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠন করা হয় ‘গণবাহিনী’। তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সব বাহিনীকেই তাঁদের সদস্যদের ও প্রচলিত অর্থে মুক্তিবাহিনী এবং ক্ষেত্র বিশেষে ‘মুক্তিফৌজ’ নামে অভিহিত করা হতো। কমান্ডারদেরকে তাদের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বুঝিয়ে দেওয়ার পরই শুরু হয় সুশৃঙ্খলভাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ।</p> <p>একই সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ লাভ করে একটি সুসজ্জিত রূপ। পেশাদার সামরিক কর্মকর্তারা ১১টি সেক্টরে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। ১১টি সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয় একেকজন সুপ্রশিক্ষিত পেশাদার সামরিক কর্মকর্তাকে। গঠিত হয় জেড ফোর্স, এস ফোর্স ও কে ফোর্স নামক তিনটি নিয়মিত ব্রিগেড। দীর্ঘ ৮ মাস প্রতিরোধের পর ২১ নভেম্বর চূড়ান্তভাবে স্থল, নৌ ও আকাশ পথে শুরু হয় ত্রিমুখী আক্রমন। এই আক্রমনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে পর্যুদস্ত হতে থাকে। ক্রমশই পশ্চাৎপসারণে যেতে থাকে পরাজিত বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিকামী জনতার চূড়ান্ত আক্রমণে পর্যুদস্ত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী। অবশেষে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমার্পনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালি মুক্তিকামী জনতার বিজয়। স্বাধীন হয় প্রিয় মাতৃভূমি। জন্ম হয় বাংলাদেশ নামে একটি দেশের।</p> <p>১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী গঠিত হয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিল। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সম্মিলিত অংশগ্রহণে মুক্তিযুদ্ধের চিত্রই পাল্টে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের প্রাথমিক প্রতিরোধে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এ ডিভিশনের ব্রিগেডসমূহের অধীনে পাঁচটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন পূর্ব পাকিস্তানে মোতায়েন ছিল। যার মধ্যে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে, ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর রাজবাড়িতে, ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাসে, ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় অবস্থান করছিল। অপারেশন ‘সার্চ লাইটের’ গুপ্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালিদের ওপর আক্রমণ হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে এ আশঙ্কায় নানা অজুহাতে মার্চের শুরু থেকেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।</p> <p>১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ঐতিহাসিক সেক্টর কমান্ডারদের কনফারেন্সের ঘোষনা মোতাবেক বাংলাদেশ নৌ বাহিনী আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ভারত থেকে প্রাপ্ত ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নামের ছোট দুটি গানবোট এবং ৪৯ জন নাবিক নিয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে এ সমস্ত নাবিকরা শত্রুর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধ ও গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হন। পাশাপাশি ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামে নির্ভীক ডুবুরিদল সমুদ্র ও নদী বন্দরগুলো বিধ্বংসী আক্রমণ পরিচালনা করেন। এতে হানাদার বাহিনীর ২৬টি জাহাজ ধ্বংস হয় ও সমুদ্র পথ কার্যতঃ অচল হয়ে পড়ে। নৌ বাহিনীর অপারেশনের মধ্যে হিরণ পয়েন্টের মাইন আক্রমণ (১০ নভেম্বর ১৯৭১), মার্কিন ও ব্রিটিশ নৌযান ধ্বংস (১২ নভেম্বর ১৯৭১), চালনা বন্দরে নৌ হামলা (২২ নভেম্বর ১৯৭১) চট্টগ্রাম নৌ অভিযান (০৫ ডিসেম্বর ১৯৭১) এবং পাকিস্তান নৌ ঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর অভিযান (১০ ডিসেম্বর ১৯৭১) উল্লেখযোগ্য।</p> <p>পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে আসা বাঙালি অফিসার, ক্যাডেট ও বিমান সেনারা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মোট প্রায় ৩৫ জন অফিসার ও ক্যাডেট এবং প্রায় ৫০০ বিমানসেনা পাকিস্তান পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। এই সব বিমান বাহিনীর সদস্যরা যদিও স্থলযুদ্ধে খুবই বীরোচিত ভূমিকা রাখছিলেন তবু তাঁদের মধ্যে একটি স্বাধীন বিমান বাহিনী গঠনের চেতনা খুব প্রবলভাবে কাজ করছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এর মাঝামাঝি আমেরিকায় অস্থায়ী তৈরি একটি পুরনো ডিসি-৩ বিমান, কানাডার তৈরি একটি অটার বিমান এবং ফান্সের তৈরি একটি অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার নিয়ে গঠিত হয় একটি স্বাধীন বিমান বাহিনী। এর সঙ্গে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে একটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরিত্যাক্ত রানওয়ে ব্যবহারের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত হয় তারা। এই সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। সারা দেশের আনাচে কানাচে সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যদের পরিকল্পিত আক্রমণ, বিএনএস পদ্মা ও বিএনএস পলাশ যুদ্ধজাহাজ নিয়ে নৌ বাহিনীর অমিত বিক্রম যাত্রা এবং মাত্র তিনটি বিমান নিয়ে বিমান বাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে।</p> <p>স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর অবলুপ্ত হয় এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের অধীনে গঠিত হয় তিন বাহিনীর জন্য পৃথক পৃথক সদর দপ্তর। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এখন একটি সুসজ্জিত, সুদক্ষ বাহিনী হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে সমাদৃত। শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকাণ্ড সমানভাবে সমাদৃত, যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনী শান্তি রক্ষার পাশাপাশি ঐ সব দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে।</p> <p>প্রতিবছর ভাবগম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন করা হয়। প্রতি বছর দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, সরকার প্রধান ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ঢাকা সেনানিবাসের শিখা অর্নিবানে ‘পুষ্প অর্পনের’ মধ্য দিয়ে এ দিবসের সূচনা করেন। এরপর ঢাকার সেনাকুঞ্জে একটি মতবিনিময়ের আয়োজন করা হয়। সেখানে রাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বিদেশী কুটনৈতিকবৃন্দ, রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ, সুধী সমাজের ব্যক্তিবর্গ, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সবাই উপস্থিত হয়ে কুশলাদি বিনিময় করেন। এছাড়াও দেশের সব সেনানিবাসে অত্যন্ত ভাবগম্ভীর্যের সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের তাৎপর্য ও গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রিক মিডিয়া এ দিনটি উপলক্ষে নানান আয়োজন করে থাকে, তাছাড়া, বিভিন্ন প্রিন্ট এবং ইলেকট্রিক মিডিয়ায় এ দিনটিকে কেন্দ্র করে সংবাদ প্রচার এবং নানা লেখা প্রকাশিত হয়।</p> <p>মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতির অহংকার। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেই জাতিকে এগিয়ে যেতে হবে। ১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সম্মিলিত হয়েছিল বাংলার জনগণের সঙ্গে। জনযুদ্ধের ভেতরে জন্ম বলেই এ দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, চেতনা সবকিছুর সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অর্থাৎ জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর পারস্পারিক সুসম্পর্ক ও একাত্মতা আমাদের বর্তমান প্রজম্মের জন্য অত্যন্ত অনুপ্রেরণাময় উদাহরণ। সশস্ত্র বাহিনী দিবস স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের স্বাধীনতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়া প্রয়োজন।</p> <p>মনে করিয়ে দেয়, তিন বাহিনীর যৌথতা, সমন্বয়, ভ্রাতৃত্ববোধ ও একাত্মতার কথা। প্রতিবার দিবসটি আমাদের পুনরুত্থানের পরম লগ্ন হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং জাতির স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ও জনতার চরম ত্যাগ তিতিক্ষার কথা স্বরণ করিয়ে দেয়। এটি আমাদের অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন এবং আমাদের জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতার মূর্ত প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। আগামী দিনেও মাতৃভূমির অখণ্ডতা রক্ষায় তথা জাতীয় যে কোনো প্রয়োজনে আমারদের সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকবে। রাষ্ট্র, দেশ ও সশস্ত্র বাহিনী সবার, সমগ্র জাতির সম্পদ। সুতরাং সব বিতর্কের উর্ধ্বে থেকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী দেশমাতৃকার সেবায় সদা সর্বত্র অতন্দ্র প্রহরীর মতো জাগ্রত থাকবে। এই হোক সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অঙ্গীকার ও প্রতিজ্ঞা।</p> <p><em>লেখক: সেনা কর্মকর্তা</em></p>