<p>মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা ইসলামী মূল্যবোধের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যার সমর্থনে কোরআন ও হাদিসের বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে ইসলামে দেশপ্রেমের ধারণা ভারসাম্যপূর্ণ। ফলে মুসলিমরা দেশের ব্যাপারে উদাসীন হয় না বা উগ্র জাতীয়তাবাদেও আক্রান্ত হয় না; বরং তারা পরম মমতায় তা প্রতিপালন করে। মাতৃভূমির ভালোবাসা উম্মতের প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র উত্তরাধিকার। যুগ যুগ ধরে আলেম ও মুসলিম সমাজের নেতারা যা ধারণ করে এসেছেন।</p> <p><strong>কোরআনে মাতৃভূমির বর্ণনা</strong> : পবিত্র কোরআনে ‘ওয়াতান’ বা (মাতৃভূমির আরবি প্রতিশব্দ) শব্দ শুধু একবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং বহুবচনে। মাতৃভূমি অর্থে নয়, সাধারণ স্থান অর্থে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বহু স্থানে।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ২৫)</p> <p>তবে কোরআনের একাধিক আয়াতে দেশ ও মাতৃভূমির ভালোবাসাকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, কোরআনে মাতৃভূমি ও দেশের কথা স্পষ্টত নেই কেন? অথচ তার ইঙ্গিত রয়েছে একাধিক স্থানে। উত্তর হলো, কোরআনে দেশ ও মাতৃভূমির কথা উল্লেখ করা হয়নি কারণ দেশপ্রেম মানবপ্রকৃতির অংশ। যেমন—কোরআনের একাধিক জায়গায় সন্তানকে মা-বাবার প্রতি উত্তম আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোরআনে সন্তানের প্রতি ভালো আচরণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কেননা সন্তানের ভালোবাসা মানবপ্রকৃতির দাবি।</p> <p><strong>কোরআন-হাদিসে দেশপ্রেমের ধারণা</strong> :</p> <p>কোরআন ও হাদিসে নানাভাবে দেশের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও অনুভূতি জাগ্রত করার প্রয়াস দেখা গেছে। যার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো।</p> <p><strong>১. রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা হত্যার চেয়ে গুরুতর</strong> : কোরআনে আল্লাহ তাআলা এক আয়াতে একজন মানুষ হত্যাকে সব মানুষ হত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং অন্য আয়াতে বলেছেন, ‘যেখানে তাদের পাবে হত্যা করবে এবং যে স্থান থেকে তারা তোমাদের বের করে দিয়েছে তাদেরও সে স্থান থেকে বের করে দেবে। ফিতনা (বিশৃঙ্খলা) হত্যার চেয়ে গুরুতর।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ১৯১)</p> <p>বেশির ভাগ মুফাসসির ফিতনার ব্যাখ্যা রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা দ্বারা করেছেন। তা হলো কাউকে বাস্তুচ্যুত করা। উল্লিখিত আয়াত মানবহত্যা ও মানুষকে বাস্তুচ্যুত করা সমপর্যায়ের অপরাধ বলে ধারণা লাভ করা যায়।</p> <p><strong>২. মাতৃভূমির প্রতি নবীদের ভালোবাসা</strong> : পবিত্র কোরআনের বর্ণনায় একাধিক নবীকে শাস্তি হিসেবে দেশ থেকে বহিষ্কার করার হুমকি দিতে দেখা যায়। যা থেকে প্রমাণিত হয়, নবী-রাসুল (আ.) দেশকে ভালোবাসতেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সম্প্রদায়ের দাম্ভিক নেতারা বলল, হে শোয়াইব! আমরা তোমাকে এবং তোমার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বহিষ্কৃত করবই অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতে হবে। সে বলল, যদিও আমরা তা ঘৃণা করি তবুও?’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৮৮)</p> <p>আয়াতে শোয়াইব (আ.) ও তাঁর অনুসারীদের দেশ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে এবং তারা বলছে, দেশত্যাগ ও শিরককে আমরা ঘৃণা করি।</p> <p>অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা তাদের রাসুলদের বলেছিল, আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে অবশ্যই বহিষ্কৃত করব। অথবা তোমাদেরকে আমাদের ধর্মাদর্শে ফিরে আসতে হবে।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ১৩)</p> <p><strong>৩. দেশান্তর মর্মান্তিক শাস্তি</strong> : মাতৃভূমির প্রতি মানুষের ভালোবাসা স্বভাবজাত। মাতৃভূমির দূরত্ব মানুষের জন্য ভয়ানক শাস্তিস্বরূপ এবং অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের নির্বাসনের সিদ্ধান্ত না করলে তাদেরকে পৃথিবীর অন্য শাস্তি দিতেন।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৩)</p> <p><strong>৪. শান্তির আশ্রয় মাতৃভূমি </strong>: মাতৃভূমি মানুষের জন্য শান্তির আশ্রয় এবং মাতৃভূমির পরশে যে প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায় তা অনন্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা নামাজ শেষ করবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করবে। যখন নিরাপদ হবে, তখন যথাযথভাবে নামাজ আদায় করবে।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১০৩)</p> <p>কোরআনের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, নিরাপদ হওয়ার অর্থ হলো নিরাপদে মাতৃভূমিতে ফিরে আসা। মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকলে মানসিক অস্থিরতা কাজ করে। তাই স্বভূমিতে ফিরে আসার পর, প্রশান্ত হওয়ার পর মুসল্লিদের একনিষ্ঠ হয়ে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।</p> <p><strong>৫. রাসুলকে জন্মভূমিতে ফেরানোর অঙ্গীকার </strong>: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় মহানবী (সা.) যখন গারে সুর থেকে বের হয়ে মদিনার পথ ধরেন, তখন বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে মক্কার দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হৃদয়ের ব্যাকুলতা দেখে আল্লাহ তাঁকে মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেন। বলেন, ‘নিশ্চয়ই যিনি আপনার জন্য কোরআনকে বিধান করেছেন তিনি আপনাকে অবশ্যই জন্মভূমিতে ফিরিয়ে আনবেন।’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৮৫)</p> <p><strong>৬. মাতৃভূমির জন্য রাসুলের কান্না </strong>: মহানবী (সা.) মাতৃভূমিতে শত অত্যাচার ও অবিচারের শিকার হওয়ার পরও দেশত্যাগের সময় অশ্রু বিসর্জন করেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর শপথ! তুমি (মক্কা) আল্লাহর গোটা জমিনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং দুনিয়ার সব ভূমির মধ্যে তুমি আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয়। আল্লাহর শপথ! তোমার থেকে আমাকে উচ্ছেদ করা না হলে আমি চলে যেতাম না।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩১০৮)</p> <p><strong>৭. নির্বাসনকারীদের প্রতি অভিশাপ</strong> : মহানবী (সা.) মক্কার মুশরিক নেতাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করেন এবং তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন দেশান্তরকে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি শায়বা ইবনু রাবিআ, উতবা ইবনু রাবিআ এবং উমাইয়া ইবনু খালফের প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করুন; যেমনিভাবে তারা আমাদের মাতৃভূমি হতে বের করে মহামারির দেশে ঠেলে দিয়েছে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৯)</p> <p><strong>৮. দেশপ্রেমের অনুরূপ ভালোবাসা প্রার্থনা</strong> : মহানবী (সা.) মাতৃভূমির ভালোবাসাকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে তার অনুরূপ ভালোবাসা প্রার্থনা করেছেন। তিনি দোয়া করেন, ‘হে আল্লাহ! মদিনাকে আমাদের কাছে মক্কার মতো বা তার চেয়েও বেশি প্রিয় করে দিন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৯)</p> <p><strong>৯. স্বদেশকে ভোলেননি মহানবী (সা.) </strong>: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হলেও মাতৃভূমিকে কখনো ভোলেননি তিনি। ইবনে শিহাব থেকে বর্ণিত, মক্কা থেকে উসাইল গিফারি (রা.) মদিনায় এলে তিনি মক্কার অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। তিনি মক্কার অধঃপতিত অবস্থার বর্ণনা শুরু করলে মহানবী (সা.) তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, আমাদের ব্যথিত কোরো না উসাইল এবং তাঁর দুই চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল। (জামিউল আসার, পৃষ্ঠা ২২১২)</p> <p><strong>১০. অনুভবজুড়ে মাতৃভূমির ভালোবাসা</strong> : উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের বর্ণনা ও ভঙ্গি থেকে স্পষ্ট হয়, ইসলাম মাতৃভূমির প্রতি মানুষের স্বভাবজাত ভালোবাসাকেই জাগ্রত করার প্রয়াস পেয়েছে। যেন তাদের অনুভবজুড়ে মাতৃভূমি ও তাঁর প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত থাকে। মহানবী (সা.) মক্কার পাহাড়-পর্বত ও প্রকৃতির সঙ্গেও অন্তপ্রাণ ভালোবাসা পোষণ করতেন। তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমি মক্কার একটি পাথরকে চিনি, যেটি নবুয়ত লাভের আগেই আমাকে সালাম দিত। আমি সেটাকে এখনো চিনি।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৭৭)</p>