<p>ব্যবসা-বাণিজ্যে ইসলাম কতগুলো সুনির্দিষ্ট নীতি মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে। আর্থিক লেনদেনে সততা, স্বচ্ছতা, অঙ্গীকার পূরণ করা, জাকাত দেওয়া এবং ভালো গ্রাহকসেবা প্রদান করার ওপর ইসলামী শরিয়া গুরুত্ব আরোপ করেছে। ইসলাম ব্যবসায় ধোঁকা, প্রতারণা, মজুতদারি, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, মাপে কম দেওয়া, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা ইত্যাদি বিষয়কে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। একইভাবে ফটকাবাজি, সুদ, জুয়া, গোষ্ঠীবিশেষের বাজার নিয়ন্ত্রণ, একচেটিয়া কারবার, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা, মিথ্যা শপথ করা ইত্যাদি নেতিবাচক কাজকেও ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে।</p> <p>ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইসলাম যেসব নীতি অনুসরণের নির্দেশ দেয় তার কটি নিচে উল্লেখ করা হলো—</p> <p><strong>ব্যবসায় প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি থেকে বিরত থাকা</strong></p> <p>ইসলামে ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তম কাজ হলেও এর মধ্যে প্রতারণা ও ধোঁকাবাজি কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং ইসলামে এর বিরুদ্ধে কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। পণ্যদ্রব্যে ভেজাল, ভালো পণ্যের সঙ্গে খারাপ পণ্য মেশানো, পণ্যের দোষত্রুটি গোপন করা ইত্যাদি যাবতীয় ধরনের প্রতারণা ইসলামে হারাম। নবী করিম (সা.) কেনাবেচার ক্ষেত্রে পণ্যের বিবরণ, মূল্য, মূল্য পরিশোধের সময় সুস্পষ্ট করতে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে লেনদেনের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা না দেয় এবং ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি না হয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘এবং যদি তুমি কোনো সম্প্রদায় থেকে খিয়ানতের (চুক্তি ভঙ্গের) আশঙ্কা করো, সে ক্ষেত্রে তোমার চুক্তি তুমি একইভাবে বাতিল করবে। কারণ আল্লাহ খিয়ানতকারীদের পছন্দ করেন না। ’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৫৮)</p> <p>ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার বিষয়ে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা কোরো না, পরস্পর ধোঁকাবাজি কোরো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ কোরো না, একে অন্যের পেছনে শত্রুতা কোরো না, একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা কোরো না। তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দাহ হিসেবে ভাই ভাই হয়ে যাও। এক মুসলিম ওপর মুসলিমের ভাই। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৬৪)</p> <p><strong>ওজনে কম দেওয়া নিষিদ্ধ</strong></p> <p>ব্যবসা-বাণিজ্য একটি মহৎ পেশা। সততা ও ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমে ব্যবসায় পরিচালিত হলে সেখানে অন্যায়-অনিয়ম ঠাঁই পেতে পারে না। এতে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই লাভবান হবে। আল-কোরআন ও সুন্নাহতে ওজনে কম দেওয়াকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, নিন্দনীয় ও পরকালীন দুর্ভোগের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মাপে কম দেয়, তাদের জন্য ধ্বংস। এরা লোকের কাছ থেকে মেপে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় মেপে নেয় এবং যখন অন্যদের মেপে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না যে তারা পুনরুত্থিত হবে সেই মহাদিবসে? যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে। ’ (সুরা আল মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৬)</p> <p>অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যখন মেপে দেবে পূর্ণ মাপে দেবে এবং ওজন করবে সমান-সঠিক দাঁড়িপাল্লায়, এটাই উত্তম এবং পরিণামের দিক থেকে কল্যাণকর। ’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৫)</p> <p><strong>ইসলামে মজুদদারি নিষিদ্ধ</strong></p> <p>ইসলামে বাজারব্যবস্থা উন্মুক্ত, অবারিত এবং তা চাহিদা ও জোগান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কোনো অসৎ ব্যবসায়ী যদি মজুদদারিতে লিপ্ত হয় এবং কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, তাহলে এটি বাজারমূল্য প্রভাবিত করে। এতে গ্রাহকের সমস্যা তৈরি হয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ক্রেতা জুলুমের শিকার হয়। একটি ইনসাফপূর্ণ বাজারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাই ইসলাম মজুদদারি, খাদ্যদ্রব্য বাজার থেকে তুলে নিয়ে দাম বাড়ানো এবং অধিক মুনাফার প্রত্যাশা করাকে অবৈধ করেছে। কেননা মজুদদারি, পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং অনেক মানুষ দুর্ভোগ ও অশান্তিতে পতিত হয়। এ ধরনের কাজ মানুষের দুঃখ-কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। তাই ইসলাম এ ধরনের কাজকে হারাম ঘোষণা করেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যবসায়ী পণ্য আবদ্ধ ও স্তূপ করে সে গুনাহগার। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৬০৫)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পণ্য গুদামজাত করে সে পাপী। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস ৪২০৭)</p> <p><strong>পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো হারাম</strong></p> <p>ইসলামের দৃষ্টিতে খাদ্যদ্রব্য, পণ্যসামগ্রী ও পানীয়তে ভেজাল মেশানো একটি মারাত্মক অপরাধ। কেননা খাদ্য ও পানীয় ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। যারা এসবে বিষ দেয় ও ভেজাল মেশায় তাদের ভাবা উচিত, দুনিয়ায় মানুষকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও মহান আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। আল-কোরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষকে তাদের জিনিসপত্র কম দিয়ো না। ’ (সুরা আশ-শোয়ারা, আয়াত : ১৮৩)</p> <p>পণ্যের দোষত্রুটি গোপন রাখা সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যবসায়ীর জন্য উচিত নয় কোনো জিনিস বিক্রি করা এবং তার ভেতরের দোষত্রুটির কথা বর্ণনা না করা। ’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭, ৪৫১)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার একজন শস্য ব্যবসায়ীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। সে সময় তিনি তার শস্যের স্তূপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলেন। তখন ভেতরের শস্যগুলোতে তিনি কিছু আর্দ্রতা অনুভব করলেন। আল্লাহর রাসুল জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? ওই ব্যবসায়ী জবাব দিলেন, বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছিল। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ভেজা অংশটা ওপরে রাখলে না কেন? তারপর আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘যারা আমাদের ধোঁকা দেয় তারা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১০২)</p> <p><strong>ব্যবসায় রিবা বা সুদ বর্জন</strong></p> <p>ব্যবসায়-বাণিজ্যের মাধ্যমে মুনাফা অর্জিত হয়। এতে সম্পদ বা মূলধন বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধি ইসলামে উৎসাহিত করা হলেও সুদের ভিত্তিতে মূলধনের বৃদ্ধি হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর মানুষের ধন-সম্পদে বৃদ্ধি পাওয়ার উদ্দেশে তোমরা যে সুদ নিয়ে থাকো, তা আল্লাহর দৃষ্টিতে অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধি করে না। তবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যে জাকাত তোমরা দিয়ে থাকো তা-ই বৃদ্ধি পায় এবং তারাই সমৃদ্ধিশালী। ’ (সুরা রুম, আয়াত : ৩৯)</p> <p>সুদকে নিষিদ্ধ করে আল্লাহ আরো বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসা-বাণিজ্যকে বৈধ করেছেন, আর সুদকে করেছেন নিষিদ্ধ। ’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত : ২৭৫)</p> <p><em>লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও ইসলামী ব্যাংকার। সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। বর্তমানে কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ডার্ড (ইসলামী) ব্যাংক লিমিটেড</em></p>