<p>দালালের হাত ধরে ইউরোপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে দেশ ছাড়েন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যুবক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বসনিয়ায় পৌঁছেন তিনি। ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তের কাছে বসনিয়ার উনা-সানা ক্যান্টন এলাকায় অস্থায়ী অভিবাসী ক্যাম্পে তিনি আছেন এখন। অবৈধ পথে ইউরোপের উদ্দেশে ঝুঁকিপূর্ণ এ দীর্ঘ যাত্রায় অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে পড়া মাইনুদ্দিন বলেন, ‘বাস্তবতা বেশ কঠিন। এর চেয়ে বাংলাদেশে ভিক্ষুকের জীবনও অনেক ভালো।’</p> <p>শুধু মাইনুদ্দিনই নন, কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টা করছেন। অনেকে গন্তব্যে পৌঁছতে পারলেও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অস্থায়ী ক্যাম্পে আটকে আছেন অনেক বাংলাদেশি। সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বসনিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করছেন ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক। বসনিয়ার লিপা ক্যাম্পে তাঁদের কথা হয় মাইনুদ্দিনের সঙ্গে।</p> <p>মাইনুদ্দিন ওই ক্যাম্পে পৌঁছেন আট মাস আগে। তিনি বলেন, ‘আমার কাছ থেকে যদি মেসেজ নিতে চান, আমি মনে করি বাংলাদেশের ভিক্ষুকের জীবনও অনেক ভালো, যারা বাই রোডে আসে তাদের চেয়ে। আসলে বাস্তবতা অনেক কঠিন। আপনি পাহাড়ে চড়লেন। পুলিশের চেক আছে। পানি নেই। পাহাড়ে উঠতে অনেক কষ্ট হয়। খাবার থাকলেও পানির জন্য খাবার খেতে পারবেন না। তখন কেমন লাগে? আসলে যারা বাস্তবতার সম্মুখীন হয়, তারাই বলতে পারবে কষ্টটা কেমন। ’</p> <p>জানা গেছে, বসনিয়ার লিপা ক্যাম্পে পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন। মাইনুদ্দিন জানান, এই ক্যাম্পে বর্তমানে ১০ জন বাংলাদেশি আছেন। তাঁদের অনেকেই বসনিয়ার পাশের দেশ ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছার চেষ্টা করছেন।</p> <p>অভিবাসন বিষয়ে ইউরোপের সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টসের তথ্য মতে, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা।</p> <p>বাংলাদেশ থেকে বসনিয়ায় পৌঁছার বর্ণনা দেন মাইনুদ্দিন। তিনি জানান, দালালদের হাত ধরে তাঁর ভাষায় ‘জিয়ারত ভিসায়’ প্রথম ইরাকে যান তিনি। বলেন, ‘ইরাকে পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমি ইরান হয়ে তুরস্ক যাই। কিন্তু তুরস্কে আয়-রোজগারের পথ খুব একটা ভালো নয়। তাই সেখান থেকে গ্রিস, আলবেনিয়া হয়ে বসনিয়া এসে পৌঁছি। ’</p> <p>ওই ক্যাম্পে থাকা আরেক বাংলাদেশি যুবক মোহাম্মদ সালাউদ্দীন বলেন, ইতালি যাওয়ার ইচ্ছা তাঁর। সে ইচ্ছা থেকেই তিনি বাংলাদেশ থেকে দুবাই, এরপর ইরান হয়ে তুরস্কে যান। তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে সার্বিয়া এবং সার্বিয়া থেকে বসনিয়ায় পৌঁছেন।</p> <p>এভাবে আসতে অনেক কষ্ট হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় আট-নয় মাস ধরে বসনিয়ায় আছি এবং ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। ’</p> <p>দীর্ঘ এ যাত্রায় নানা ধরনের কষ্টের মুখে পড়ার কথা জানান এ দুই বাংলাদেশি। তাঁরা বলেন, রাতের পর রাত জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পানি ও খাবারের অভাবে কষ্ট করে তাঁরা এখানে এসে পৌঁছতে পেরেছেন।</p> <p>বাংলাদেশ থেকে বসনিয়া পর্যন্ত পৌঁছতে চার বছর লেগেছে মাইনুদ্দিনের। তিনি বলেন, ইউরোপ অনেক সহজ মনে হয়েছিল। পাহাড়ে চড়তে হয়, সেই সঙ্গে থাকে পুলিশের পাহারা। মাসের পর মাস এভাবে চলতে অনেক কষ্ট হয়। এ ছাড়া ক্যাম্পে তাঁদের খাবারের কষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভাত নিয়মিত খেতে পাওয়া যায় না। রুটি খেয়ে থাকতে হয়। ’</p> <p>সালাউদ্দীন বলেন, ‘এখানে আসার পর যে কষ্ট হয়, তা আগে জানলে এভাবে আসার চেষ্টা করতাম না। ’</p> <p>অর্থনৈতিক বিষয়ে মাইনুদ্দিন জানান, দালালদের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে টাকা আনাতে হয়। টাকা আনাতে হলে অনেক টাকা দালালদের দিতে হয়। বলেন, ‘দালালদের মাধ্যমে যদি আপনি ১০ হাজার টাকা আনাতে চান, তাহলে আপনার খরচ পড়বে ১৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ চার হাজার টাকা দালালদের দিতে হয়। ’</p> <p>ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টাকে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা বলেন ‘গেম মারা’। গত আট মাসে সালাউদ্দীন বেশ কয়েকবার গেম মেরেছেন। কিন্তু ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে পুলিশের নজর এড়াতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ভয়ানক নির্যাতন সইতে হয়। ’</p> <p>মাইনুদ্দিন জানান, প্রায় মাসখানেক আগে তিনি সর্বশেষ ‘গেম মারার’ চেষ্টা করেছেন। গেম মারার বিষয়ে দালালরা সহযোগিতা করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়ার পুলিশ তো অনেক মারধর করে। মারধর মানে তারা এমন মার দেয় যে ফিল্মের মারকে হার মানাবে।’</p> <p>সূত্র : ডয়চে ভেলে</p>