<p>আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকা ৪৬ জন বাংলাদেশি আসামি এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। দূরদেশে থেকেও বেশির ভাগ আসামি হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক তৎপরতায় লিপ্ত বলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে।</p> <p>ইন্টারপোলে রেড নোটিশে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যার পলাতক আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের নাম। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে।</p> <p>বাংলাদেশ ইন্টারপোলের সদস্য হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এ দেশের ৬৩ জন আসামির নামে তারা রেড নোটিশ জারি করেছে। এর মধ্যে ১৭ জনকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও অন্যরা এখনো অধরা। আলোচিতদের মধ্যে আরাভ ছাড়াও মতিঝিলে আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যা মামলার আসামি জিসান আহমেদ ও মানিক রয়েছেন। তাঁরা বিদেশে অবস্থান করে বিভিন্ন অপরাধের পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বলে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।</p> <p>১৯৭৬ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশ ইন্টারপোলের সদস্য হয়। দুর্নীতি, যুদ্ধাপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানবপাচার, অস্ত্র চোরাচালান, মাদক পাচার, সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, শিশু সহিংসতাসহ ১৭ ধরনের অপরাধ তদন্তে ইন্টারপোল তার সদস্য দেশগুলোকে সহায়তা দিয়ে থাকে।</p> <p>ইন্টারপোলের আট ধরনের নোটিশের মধ্যে রেড নোটিশ জারির অর্থ হলো ওই ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার ও বিচার বিভাগ বিচারের মুখোমুখি করতে বা দণ্ড কার্যকর করতে খুঁজছে। সদস্য দেশগুলো ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতক আসামি সম্পর্কে তথ্য বিনিময় করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের এ ধরনের চুক্তি নেই। ফলে রেড নোটিশ জারি করা হলেও আরাভসহ অন্য আসামিদের ফেরাতে হলে কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর জোর দিতে হবে।</p> <p>২৪ মার্চ ইন্টারপোল বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আরাভ খানের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ ইস্যু করে। তাঁকে দুবাইয়ে আটকের গুজব উঠলেও পরে শোনা যায় যে তিনি দুবাই ছেড়েছেন। এ ক্ষেত্রে দ্বৈত পাসপোর্ট জটিলতা মূল ভূমিকা রেখেছে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আরাভ খানকে দেশে ফেরাতে ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল করতে হবে। তিনিসহ ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকা ৪৬ জন বাংলাদেশির বেশির ভাগের রয়েছে একাধিক পাসপোর্ট। বিভিন্ন ছদ্মনাম ব্যবহার করে তাঁরা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে নিজ নিজ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।</p> <p><strong>যাঁদের ফেরত আনা হয়েছে </strong></p> <p>পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত ১৮ বছরে শুধু ১৭ জন পলাতক বাংলাদেশি আসামিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের ৯ জুন ঢাকার মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যার অন্যতম প্রধান আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসাকে ইন্টারপোলের মধ্যস্থতায় ওমান থেকে ফিরিয়ে আনে এনসিবি ঢাকা।</p> <p>এর আগে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকার পরও ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ নামের এক অপরাধীকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যার আসামি। ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর ইন্টারপোলেরর মাধ্যমে কামরুল নামের এক হত্যা মামলার আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।</p> <p><strong>অন্যরা কে কোথায় </strong></p> <p>এনসিবি ও পুলিশের গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দুই কর্মকর্তা খুনের আসামি তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদকে ২০১৯ সালে আটক করে আমিরাতের পুলিশ। জিসানকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে নানাভাবে চেষ্টা করার পরও শেষ পর্যন্ত ফেরত দেয়নি দুবাই। তাঁর সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী মানিকও বিদেশে পলাতক।</p> <p>ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান মো. হারুন অর রশীদ বলেন, টিপু হত্যা মামলার আসামি মুসাকে ফিরিয়ে আনার পর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি এ হত্যায় জিসান ও মানিকের জড়িত থাকার কথা বলেন। এ দুজনের বিরুদ্ধে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকাসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকায় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও রাজনীতিসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। </p> <p>ইন্টারপোলের রেড নোটিশে থাকা বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, মোসলেম উদ্দিন ও এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে কবে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে, এ বিষয়ে জানাতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। অন্য অভিযুক্তরা অন্য দেশে। তাঁদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বিভিন্ন সময়ে আবেদন জানালেও দেশগুলোর সরকারের সাড়া মেলেনি।</p> <p>২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে গ্রেপ্তার হন ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ। সে সময় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাঁকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে আর ফেরত আনা হয়নি।</p> <p>২০২০ সালে লিবিয়ায় পাচার হওয়া ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ছয়জনের নামে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের জাফর ইকবালকে ইতালিতে গ্রেপ্তার করে দেশটির পুলিশ। ২০২১ সালের ১০ জানুয়ারি এনসিবিকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করে এনসিবি রোম। পুলিশের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, জাফরকে ফিরিয়ে আনতে সর্বোচ্চ ৪০ দিন লাগতে পারে। তবে সেই আসামিকে আজও ফিরিয়ে দেয়নি ইতালি সরকার।</p> <p>২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। আদালতে জামিনে মুক্তি পেয়ে নেপালে গিয়ে গ্রেপ্তার হন তিনি। নেপালের কারাগার থেকে পালিয়ে কলকাতায় ফেরেন বাইন। ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর সেখানে গ্রেপ্তার হন তিনি। অন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদত হোসেনও ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেয়নি ভারত।</p> <p>মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এম এ জাহিদ ওরফে খোকন ওরফে খোকন মাতুব্বর সুইডেনে পলাতক। তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা কয়েক বছর ধরেই সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও এ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। একই অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি জামায়াতে ইসলামীর রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধেও ইন্টারপোলের রেড নোটিশ রয়েছে। ফাঁসির রায় হওয়ার আগেই ২০১২ সালে সবার চোখ এড়িয়ে দেশ ছাড়েন এই যুদ্ধাপরাধী। সে সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ভারত হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গেছেন বাচ্চু রাজাকার। এখনো পাকিস্তানেই তিনি গাঢাকা দিয়ে আছেন বলে জানা গেছে।</p> <p>মডেল তিন্নি হত্যা মামলার প্রধান আসামি গোলাম ফারুক অভি। আশির দশকের এই ছাত্রনেতার ওপর ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ। অভি কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। তাঁকেও দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।</p> <p>২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের পলাতক নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন আহমেদকে গ্রেপ্তারে ২০০৭ সালে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে।</p> <p>গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত বাংলাদেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বেশির ভাগ ভারতে অবস্থান করছেন। তাঁদের মধ্যে আব্দুল জব্বার ওরফে মুন্না, নবীন হোসেন ওরফে নবী, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, খোরশেদ আলম, শাহাদাৎ হোসেন ওরফে শাহাদাত, দীপু ওরফে নুরুল, রফিকুল ইসলাম ওরফে কাজল, নাসিরউদ্দিন রতন, হারুন শেখ, শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, মকবুল হোসেনসহ বেশ কিছু শীর্ষ সন্ত্রাসী রয়েছেন।</p> <p>তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার তৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার পাশাপাশি বিভিন্ন সূত্রে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, এসব অপরাধীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকাসহ আইনি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক জটিলতার কারণে দেশে আনা যাচ্ছে না তাঁদের। ফলে মুখোমুখি করা যাচ্ছে না বিচারের।</p> <p>এঁদের বিচার ও দণ্ডাদেশ কার্যকর করতে বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনতে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ১১ সদস্যের নতুন টাস্কফোর্সের সভাপতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী। তবে এত দিনেও এসব আসামিকে ফিরিয়ে আনতে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।</p> <p>পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এনসিবি) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত বাংলাদেশি অপরাধীদের অবস্থান শনাক্ত করে দেশে ফেরানোর চেষ্টা চলছে।</p> <p>পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, রেড নোটিশভুক্ত বাংলাদেশি অপরাধীদের অবস্থান শনাক্তের পর গ্রেপ্তার করে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রতিনিয়ত ইন্টারপোল সদর দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। এ বিষয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আরাভসহ বিদেশে পলাতক আসামিদের আটক করে দেশে ফিরিয়ে আনার কূটনৈতিক চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।<br />  </p>