<p style="text-align:justify">সোনা চোরাচালান মামলার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। ত্রুটিপূর্ণ এজাহার, জব্দ তালিকায় গরমিল, উল্টো সাক্ষ্য দেওয়া, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশসহ নানা কারণে মামলার তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আর বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতার সুযোগে বেশির ভাগ আসামিই জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন। ফলে জড়িতদের কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।</p> <p style="text-align:justify">বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গডফাদাররা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। চোরাকারবারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় প্রতিনিয়তই চোরাচালানের ঘটনা ঘটছে।</p> <p style="text-align:justify">কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানে জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত এক দশকে চোরাচালানের বিপুল সোনা আটক করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস। তবে এসব ঘটনায় থানায় হওয়া মামলাগুলোর প্রায় আসামিই জামিন পেয়েছেন।</p> <p style="text-align:justify">ঢাকা কাস্টম হাউস গত ১০ বছরে চোরাকারবারিদের হাতেনাতে আটক করে থানায় সোপর্দ করে। বড় চালানের দিক থেকে এ সময় অন্তত ৪৬টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ মামলায় আসামিরা কারাগারে আছেন। বাকি ৩৫টি মামলায় আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">রায় হয়েছে একটি মামলায়। এ ছাড়া বাকি ৪৫টি মামলার মধ্যে ১১টি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। বাকি মামলাগুলো ঢাকা মহানগরের স্পেশাল ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন।</p> <p style="text-align:justify">ঢাকা কাস্টম হাউসের দেওয়া তথ্য মতে, সোনা চোরাচালানের ঘটনায় গত এক দশকে প্রতিবছরে ঢাকা কাস্টম হাউস থেকে ৮০৫টি ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ২৭টি, ২০১৪ সালে ১২০টি, ২০১৫ সালে ৯৩টি, ২০১৬ সালে ৫০টি, ২০১৭ সালে ৬২টি, ২০১৮ সালে ১১০টি, ২০১৯ সালে ৭৭টি, ২০২০ সালে ৩২টি, ২০২১ সালে ১০৫টি এবং ২০২২ সালে ১২৯টি মামলা রয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">প্রতিটি মামলাই ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা। একটি মামলাও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে করা হয়নি।</p> <p style="text-align:justify">জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় মামলার ক্ষেত্রেই বিচারের দীর্ঘসূত্রতা পরিলক্ষিত হয়। তবে সোনা চোরাচালান বিষয়টি একটি বিশেষায়িত খাত। সোনা চোরাচালান দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি সোনার ক্ষেত্রে যে নীতিমালা করা হয়েছে তা প্রতিরক্ষামূলক, সেটা প্রতিকারমূলক নয়। চোরাচালান প্রতিরোধে প্রাধান্য দিতে হবে। বিশেষ করে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।’</p> <p style="text-align:justify">চোরাচালান মামলার অভিজ্ঞ আইনজীবী ফারুক আহম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোনা চোরাচালান মামলায় যা (সোনা) জব্দ করা হলো সে সম্পর্কে কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত দেওয়া হয় না। ফলে যা (সোনা) জব্দ করা হলো তা সত্যিই সোনা কি না তা বিচারে এসে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রে সোনাগুলো তদন্ত কর্মকর্তারা দেখেনই না। আর তাঁরা এসে আদালতে সাক্ষ্য দেন, যাঁরা সোনা দেখেননি। ত্রুটিপূর্ণ মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকায় গরমিল এবং সাক্ষীদের উল্টো সাক্ষ্য দেওয়াসহ নানা কারণে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়।’</p> <p style="text-align:justify">মামলার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা জানান, সোনা চোরাচালানের মামলাগুলো সাধারণত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে নিষ্পত্তি হতে বিলম্ব হয়। এ কারণে এসব মামলা তদন্ত শেষ করতে ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি সময় লাগে।</p> <p style="text-align:justify">মামলার নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০২১ ও ২০২২ সালে ঢাকা কাস্টম হাউস উল্লেখযোগ্য সোনার ১২টি চোরাচালান আটক করে। এর মধ্যে একটি মামলায় কোনো আসামি আটক নেই। বাকি পাঁচ মামলায় আসামিরা কারাগারে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০২১ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ছয়টি মামলা করা হয়। এই ছয় মামলার মধ্যে সরোয়ার উদ্দিনের মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলো তদন্তাধীন। এ ছাড়া মামলাগুলোর মধ্যে শুধু মহিন উদ্দিন জামিনে আছেন। অন্য আসামিরা কারাগারে।</p> <p style="text-align:justify">২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয়টি মামলা করা হয়। এসব মামলার মধ্যে একটি মামলা তদন্তাধীন এবং বাকি পাঁচটি মামলা ঢাকা মহানগরের বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলোতে বিচারাধীন। এসব মামলায় আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয়টি মামলা করা হয়। সব কটি মামলায়ই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বিচারাধীন এসব মামলায় আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৮ সালের ৯ জানুয়ারি পাঁচটি মামলা করা হয়। এসব মামলায় এরই মধ্যে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলাগুলো বিচারাধীন। আর আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৭ সালের ৬ মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি মামলা করা হয়। এসব ঘটনায় করা প্রতিটি মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বিচারাধীন মামলাগুলোয় আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচটি মামলা করা হয়। মামলাগুলোর মধ্যে জামিনে গিয়ে পলাতক মজিব সরকারের মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি মামলাগুলো তদন্তাধীন। অন্য আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয়টি মামলা করা হয়। মামলার সব কটির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলাগুলো বিচারাধীন। আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৪ সালের ৫ জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি মামলা করা হয়। চার্জশিট হওয়া এসব মামলা বর্তমানে বিচারাধীন। আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify">২০১৩ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচটি মামলা করা হয়। মামলাগুলো বিচারাধীন। আর আসামিরা জামিনে আছেন।</p> <p style="text-align:justify"><strong>গডফাদারদের ছাড় দিতেই </strong><strong>‘</strong><strong>বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা</strong><strong>’</strong></p> <p style="text-align:justify">সোনা উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হওয়ার কথা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে। অথচ মামলা করা হচ্ছে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে। আর বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা এসব মামলায় চোরাচালানকৃত সোনার উৎস সম্পর্কে তথা দেশ-বিদেশে থাকা সম্পৃক্ত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হলে টাকার উৎস খুঁজে গডফাদারদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব।</p> <p style="text-align:justify">জানতে চাইলে সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, “সোনা চোরাচালান মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তারা শুধু ‘ক্যারিয়ার’ বা বাহকের কাছ থেকে যে পরিমাণ সোনা উদ্ধার করেন তা খুবই সামান্য। আর এটি দৃশ্যমান যে বাহকরা কোথা থেকে সোনা এনেছেন সেই উৎসর দিকে তদন্ত কর্মকর্তারা অজ্ঞাত কারণে যান না। মামলার তদন্ত কার্যক্রম বিলম্বের দায় তদন্তকারী ও তদারককারী কর্মকর্তার। তদারককারী কর্মকর্তা মামলার তদারকি করেন বলে মনে হয় না।”</p> <p style="text-align:justify">সাবেক এই জেলা জজ আরো বলেন, ‘সোনা চোরাচালান আন্তর্জাতিক একটি ব্যাপার। আমাদের দেশের তদন্তকারী কর্মকর্তারা মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে শুধু বাংলাদেশে জড়িতদের নিয়েই তদন্তে ব্যস্ত থাকেন। বিদেশি যারা জড়িত, তাদের তদন্তের আওতায় আনা হয় না। চোরাচালান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সম্পৃক্ত একটি অপরাধ।</p> <p style="text-align:justify">তদন্তকারী কর্মকর্তারা চাইলে সোনা চোরাচালানের মামলাগুলো মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় এনে তদন্ত করা সম্ভব। এতে অর্থপাচারের বিষয়গুলো তদন্তে আরো গুরুত্ব পাবে। আন্তর্জাতিক এই ক্রাইমে জড়িত ক্যারিয়ার থেকে সোনা ইনপুটকারী প্রতিটি চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সোনার সাপ্লাইয়ারকে ধরতে হবে।’</p> <p style="text-align:justify">নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সোনার চালান এলে মূলত ক্যারিয়ার বা বহনকারী ধরা পড়ে। যারা সোনা পাঠাল তাদের ধরতেই তদন্ত করতে হয়। আর গডফাদারদের ধরতে হলে যেতে হবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলায়। তখন অর্থের লিংক ধরে ধরে গডফাদারদের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকে।</p>