<p style="text-align:justify">বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে ৪৭৫ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে। প্রশিক্ষণের নামে বিপুল এই অর্থ ব্যয় করা হলেও কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতা দেশের কাজে আসেনি। কারণ প্রশিক্ষণ অনুযায়ী বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়নি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য নেই কোনো কর্মপরিকল্পনা ও সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।</p> <p style="text-align:justify">তার পরও ‘বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের মেয়াদ আবারও বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। গত বুধবার প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। আগামীর উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রকল্পের কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।</p> <p style="text-align:justify">বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, জনপ্রশাসন ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন এবং অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, জনপ্রশাসন সচিব প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সম্মতি দিয়েছেন। এরপর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। </p> <p style="text-align:justify">তবে গত ১৫ বছরে প্রশিক্ষিত দুই হাজার ৩৫৯ জন কর্মকর্তাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে না লাগিয়ে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হলে তার ফল কার্যত শূন্যই থাকবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারকে শক্তিশালী করতে এমন প্রকল্পের জন্য অবশ্যই মহাপরিকল্পনা, জরিপ ও তদারকি প্রয়োজন। এ ছাড়া খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে ক্লাস্টার পদ্ধতি চালু দরকার ছিল। এ জন্যই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও ট্রেনিং (সিপিটি) অনুবিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">কিন্তু বিদেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়া কমকর্তাদের গত ১৫ বছরেও পরিকল্পিতভাবে কাজে না লাগানো দুঃখজনক। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা মোতাবেক কাজে লাগালে দেশের মঙ্গল হতো।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>কাজে লাগেনি অর্জিত জ্ঞান</strong></p> <p style="text-align:justify">জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) শহীদ মোহাম্মদ ছাইদুল হক, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (অ্যাসেসমেন্ট) ও উপসচিব হুমায়ূন কবির, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক মো. মমিন উদ্দিন প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের উপসচিব (প্রত্যাবাসন শাখা) মো. তালুত মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন টেকসই জ্বালানি নীতি নিয়ে। অথচ প্রকৌশলী এই কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন ধরে রাখা হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।</p> <p style="text-align:justify">এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) ও উপসচিব তানজিল্লুর রহমান, জাতীয় উন্নয়ন প্রশাসন একাডেমির পরিচালক ও উপসচিব দেওয়ান মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম মাস্টার্স ডিগ্রি করেছেন পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। কিন্তু তাদের কাউকে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংক্রান্ত পদে পদায়ন করা হয়নি।</p> <p style="text-align:justify">জানা যায়, পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনার বিষয়টি প্রকল্পের ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। প্রকল্প পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বড় বড় কনস্ট্রাকশনের যে পরিবেশগত জটিলতা থাকে, এর মাধ্যমে সেটা নির্ণয় করা যায়। বড় প্রকল্পে এটা ভালোভাবে অ্যাসেস করা হলে পরিবেশগত বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। দেশে এমন বিশেষজ্ঞ খুব জরুরি। দেশে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নেই বললেই চলে। এর পরও এ বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা কর্মকর্তাদের পদায়ন করা হয়েছে সমাজসেবা অধিদপ্তর ও প্রশাসন একাডেমিতে। আরো কয়েক শ কর্মকর্তা ডিগ্রি নিয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, তথ্য-প্রযুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে। অথচ তাদের পদায়ন করা হয়েছে সংস্কৃতি, শ্রম, ধর্ম ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। একইভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্য কর্মকর্তারাও কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই কাজ করছেন বিভিন্ন দপ্তরে।</p> <p style="text-align:justify">সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) ও উপসচিব তানজিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমার অর্জিত জ্ঞান দেশের কাজে লাগলে আমি খুশি হতাম। এতে জনগণের ট্যাক্সের টাকাও কাজে লাগত।’</p> <p style="text-align:justify">প্রকল্প ব্যবস্থাপনার বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি করা জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালক (অ্যাসেসমেন্ট) ও উপসচিব হুমায়ূন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাকে কোথায় পদায়ন করবে, এটা জনপ্রশাসনের সিদ্ধান্ত। তবে বিদেশে ডিগ্রি নেওয়া কর্মকর্তাদের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পদায়ন করা ভালো।’ তিনি বলেন, ‘শুনেছিলাম কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে ক্লাস্টার পদ্ধতি চালু হবে। এখন পর্যন্ত সেটা বাস্তবায়ন হয়নি।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২,৩৫৯ কর্মকর্তা</strong></p> <p style="text-align:justify">গত ১৫ অর্থবছরে (২০০৯-২০২৪) বিসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে বিদেশে পিএইচডি করেছেন ১৩ জন, মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন ৮৭৪ জন, ডিপ্লোমা করেছেন ১৭৬ জন, রিফ্রেশাস কোর্স করেছেন ৪৪ জন সচিব এবং সংক্ষিপ্ত কোর্স করেছেন এক হাজার ২৫২ জন অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিব। এর মধ্যে বেশির ভাগ কর্মকর্তা যুক্তরাজ্যের হার্ভার্ড, ডিউক, আইটিসি-আইএলও, ম্যাকক্যারি, কার্টিন, সাসেক্স, অক্সফোর্ড ও বার্মিংহাম এবং আমেরিকা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়ার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। এ খাতে ১৫ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৪৭৫ কোটি ১৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা।</p> <p style="text-align:justify"><strong>নেই কর্মপরিকল্পনা ও সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার</strong></p> <p style="text-align:justify">জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্য নেই কোনো কর্মপরিকল্পনা ও সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার। যাঁরা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের কর্মপরিধি প্রশিক্ষণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগের কোনো পথরেখাও নেই। দেখা গেছে, একজন কর্মকর্তা ছয় মাস ধর্ম মন্ত্রণালয়ে কাজ করার পর তাঁকে পদায়ন করা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। সেখানে বছর দুয়েক থাকার পর পদায়ন করা হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। এতে কোনো খাতেই বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা তৈরি হচ্ছেন না।</p> <p style="text-align:justify">জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে আমরা পজিটিভ। এগুলো নিয়মিত কাজ। সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ নিতেই হবে।’ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার আজকে থেকে সচিব হওয়ার বয়স ৩০ দিন। এ বিষয়ে জেনে কথা বলতে হবে। খোঁজখবর নেওয়ার পর এ নিয়ে কথা বলব।’</p>