<p>একসময় দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মহিউদ্দিন মহারাজের এখন টাকা ও জমিজমার হিসাব রাখার জন্য একাধিক হিসাবরক্ষক রয়েছে। নিজ পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্য এখন জেলার শীর্ষ ধনীদের তালিকায়। নিজেসহ তিন ভাইয়ের জন্য আওয়ামী লীগের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। আর এই পদের জোরেই আজ টাকার কুমির।</p> <p>এই টাকার জোরেই এমপি হয়েছিলেন। এলাকাবাসীর মতে, তিনি ও তাঁর ভাইয়েরা টাকা খরচ করেন ‘ছেঁড়া পাতার’ মতো, তবে এলাকার উন্নয়নের জন্য নয়, নিজেদের প্রভাব ও সম্পত্তি ক্রয়ে এবং আওয়ামী লীগের পদ টিকিয়ে রাখতে ব্যয় করেছেন।</p> <p>মহিউদ্দিন মহারাজ পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। পিরোজপুর জেলার কাউখালী, ভাণ্ডারিয়া ও নেছারাবাদ উপজেলা নিয়ে এই সংসদীয় আসন।</p> <p>মহিউদ্দিন মহারাজ এবং তাঁর ছোট ভাই মিরাজুল ইসলামের নামে-বেনামে মঠবাড়িয়া, ভাণ্ডারিয়া, কাউখালী ও পিরোজপুর সদরে রয়েছে সম্পদের পাহাড়। তাঁদের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, মালয়েশিয়া, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে রয়েছে বাড়ি ও ব্যবসা। এলাকার টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা। বিদেশে পাচার করেছেন হাজার কোটি টাকা। এলাকায় গড়ে তুলেছেন মাদকের বিশাল হাট।<br /> ভাণ্ডারিয়া শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা মহারাজের প্রভাব ভাণ্ডারিয়াসহ আশপাশের তিন উপজেলায়। তাঁর বিরুদ্ধে কারো টুঁ শব্দ করার সাহস পর্যন্ত নেই কারো। </p> <p>মহারাজের উত্থান যেভাবে : মহারাজের পিতা শাহাদাৎ হোসেন একসময় স্থানীয় জেপি নেতা মনিরুল হক জমাদ্দারের অধীনে কর্মচারী ছিলেন। একসময় তিনি ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।</p> <p>তবে সাবেক মন্ত্রী ও জেপির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর হাত ধরেই উত্থান মহারাজের। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু পরিবেশমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর এপিএস হিসেবে নিয়োগ পান মহিউদ্দিন মহারাজ। মূলত এই সময়ে ভাণ্ডারিয়ায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন এই মহারাজ। একই সময়ে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে দলের উপকমিটির সহসম্পাদক পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ২০১৬ সালে পিরোজপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে জয় পেয়েছিলেন।</p> <p>স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, এই নির্বাচনে তাঁর অনুগত ভোটারদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে দিয়েছিলেন। এ ছাড়া ভোটারদের তাঁদের নিজ বাড়ি থেকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার জন্য আরো পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক। কেউ কেউ বলছে, তিনি পালিয়ে অন্য দেশে চলে গেছেন। পালিয়ে রয়েছেন তাঁর অন্য ভাইয়েরাও। </p> <p>মহিউদ্দিন মহারাজের প্রভাবে তাঁর ছোট ভাই মিরাজুল ইসলামও এলাকায় গডফাদার বনে যান। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা না থাকলেও টাকার জোরে কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করে ভাণ্ডারিয়া উপজেলার সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছিলেন ছোট ভাইকে। প্রভাব খাটিয়ে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও বানিয়েছিলেন। সেজো ভাই শামসুদ্দিন হাওলাদারকে বানিয়েছেন ভাণ্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তেলিখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদও দিয়েছিলেন ছোট ভাইকে।</p> <p>মতের বিরুদ্ধে গেলেই হামলা-মামলা : ভাণ্ডারিয়া উপেজলা নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক এই সংসদ সদস্যের ছোট ভাই মিরাজুল ইসলামকে (মিরাজ) দিয়ে। ভাণ্ডারিয়ার রাজা ছিলেন এই মিরাজ। তাঁর বিরুদ্ধে কারো টুঁ শব্দ করার সাহস ছিল না। বিরোধী মতের কেউ বাড়িতে পর্যন্ত থাকতে পারত না। মামলা দিয়ে এবং পুলিশ দিয়ে হয়রানি করতেন। থানায় ডেকে এনে নির্যাতন করাতেন।</p> <p>শতাধিক মোটরসাইকেল কিনে এলাকার বখাটে ও সন্ত্রাসীদের কাছে বিলিয়েছেন তিনি। মহারাজ এবং তাঁর ভাইয়েরা ভাণ্ডারিয়াসহ কোথাও গেলে এই মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে যেতেন। তাঁদের কর্মকাণ্ডে এলাবাসী ছিল অতিষ্ঠ।</p> <p>রহিম নামের কাউখালির এক ব্যবসায়ী বলেন, আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো দলের কাউকে পেলেই নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। তাঁর অনুগতরা বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন। গ্রামে গ্রামে গিয়ে জমি দখল করতেন। সালিস বৈঠকের নামে নির্যাতনের আদালত বসাতেন।</p> <p>নামে-বেনামে সম্পত্তি : মহিউদ্দিন মহারাজের দেশে ও দেশের বাইরে কয়েক শ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, তাঁর সম্পত্তি ও নগদ টাকা কয়েক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। টাকা দিতেন পদ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর মার্কেট, আবাসিক ফ্ল্যাট, কৃষি ও অকৃষি জমি রয়েছে। ঢাকার অভিজাত এলাকায় তাঁর দোকান আছে, আছে মার্কেট। ভাণ্ডারিয়ার পাশের উপজেলা তুষখালিতে রয়েছে মার্কেট ও আবাসিক ভবন, তেলিখালি ইউনিয়নে রয়েছে মার্কেট, কারওয়ান বাজারে রয়েছে দোকান।</p> <p>তিনি তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় ঠিকাদারি ব্যবসা থেকে তাঁর আয় ১৫ কোটি টাকা দেখিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক ডিপিএস, পিরোজপুর জেলা পরিষদে দোকান, ঢাকার মগবাজারে একাধিক ফ্ল্যাট, ঢাকার শ্যামপুরে জমি দেখিয়েছেন। স্বর্ণ দেখিয়েছেন ২০০ ভরি। ভাণ্ডারিয়ার বিভিন্ন মৌজায় সাড়ে ১০ একর কৃষিজমি দেখিয়েছেন। সব মিলিয়ে তাঁর জমি রয়েছে ৩৮০ একর বা এক হাজার ১৫০ বিঘা। ২০২৪ সালের নির্বাচনে কৃষি ও অকৃষি জমির তালিকা অনুযায়ী শীর্ষে ছিলেন এই মহিউদ্দিন মহারাজ। অথচ ভূমি আইন অনুযায়ী কারো ১০০ বিঘার ওপর জমি থাকার সুযোগ নেই।</p> <p>এলাকাবাসী জানিয়েছে, এর বাইরেও তাঁর নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। মালয়েশিয়া, দুবাই ও সিঙ্গাপুরেও টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এলাকায় ছিল মাদকের ছড়াছড়ি। উপজেলার বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাঁর অনুগতরা মাদকের হাট বসাতেন। রহমান নামের এক তরুণ জানান, তরুণ ও যুবকরা মাদকে আসক্ত হয়েছিল। </p> <p>বিভিন্ন সময়ে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে ম্যানেজ করে অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ এনে আত্মসাৎ করতেন। এতে সহায়তা করতেন পিরোজপুর ও ভাণ্ডারিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলীরা।</p> <p>পারিবারিক জমিতে জলবায়ু ট্রাস্টের প্রকল্পের অনুকূলে ইকোপার্কের নামে রিসোর্ট বানিয়ে দখল করেন মহিউদ্দিন মহারাজ এবং তাঁর ভাই মিরাজুল ও শামসুদ্দিন। সরকারি ভবন নিজেদের বসতবাড়ির মতো ব্যবহার করতেন।</p> <p>জব্বার মিয়া নামের এক ব্যক্তি বলেন, মিরাজুল ইসলাম এবং তাঁর অনুগত আওয়ামী লীগ নেতা এহসাম হাওলাদার, ভিটাবাড়িয়ার সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মশিউর রহমান মৃধা এবং ধাওয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান টুলু তাঁর দুর্নীতির সহযোগী।</p> <p>বিএনপি ও জামায়াতে যোগদানের গুঞ্জন : আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে টেন্ডার বাণিজ্য করে বিত্তবৈভবের অধিকারী এই মহিউদ্দিন মহারাজ এখন বিএনপিতে যোগ দিতে চাইছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মহারাজ বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে চান, এমন প্রস্তাব দিয়েছেন। এ খাতে অর্থ ব্যয়েরও চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বলছে, রাতের অন্ধকারে তিনি বিভাগীয় ও জেলা বিএনপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। অতীতের বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তোলা ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করছেন। এ ছাড়া মহারাজের অন্য এক ভাই জামায়াতে যোগদানের চেষ্টা করছেন।</p>