<p>সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক সহিংসতা ও সামাজিক বিরোধে গত দুই মাসে সারা দেশে অন্তত ৬২৫ জন নিহত এবং ১০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। নিহতদের বেশির ভাগ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে আগস্ট মাসে নিহত হয়েছে ৫৪১ জন এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৮৪ জন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণপিটুনিতে নিহত হয় ৬৫ জন।</p> <p>অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অন্তত ৯০ জন শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আর সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ৮৩টি সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৬ জন এবং আহত হয়েছে অন্তত ৭০৬ জন। সেপ্টেম্বরে উল্লেখযোগ্য বড় ঘটনার মধ্যে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বাঙালি-পাহাড়িদের মধ্যে সংঘর্ষ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ছয়জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় একজন শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হয়।</p> <p>এ সময় শতাধিক শ্রমিক আহত হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে দেশের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি মাজারে হামলার ঘটনায় আহত হয়েছে আরো শতাধিক মানুষ।</p> <p>সম্প্রতি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) মাসিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পুলিশ সদর দপ্তর ও র‌্যাবের সঙ্গে কথা বলেও প্রায় একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত মাঠ পর্যায়ে পুলিশের  অনুপস্থিতি, সরকার পরিবর্তনের পর পূর্ববিরোধ, দখলবাজি, আইনের তোয়াক্কা না করা, রাজনৈতিক বিরোধসহ সামাজিক নানা বিরোধে সহিংসতার এসব ঘটনা ঘটে।</p> <p>অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দুই মাস পূর্ণ হয়েছে ৮ অক্টোবর। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাধারণ মানুষের প্রধান চাওয়া ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। তবে এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যায়। ফলে দেশে দ্রুত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি বলে মনে করছেন তাঁরা।</p> <p>পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, সরকার পরিবর্তনের পর থানায় হামলার পাশাপাশি অনেক পুলিশ সদস্য নিহত হন। এ কারণে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সক্রিয় থাকতে পারেনি। এতে বাহিনীর সদস্যদের মনোবলও ভেঙে যায়। যার ফলে অপরাধ বেড়ে যায়।</p> <p>পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে  সামাজিক নানা অস্থিরতার কারণে হত্যার পাশাপাশি নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।’</p> <p>সাম্প্রতিক আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মাইজপাড়া এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার অভিযানকালে ডাকাতের ছুরিকাঘাতে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম সরোয়ার নির্জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সম্প্রতি দেশে পিটিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫টি ঘটনায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি ছিলেন।</p> <p>এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, যারা এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তার করে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p> <p><strong>সাম্প্রতিক উল্লেখযোগ্য কিছু হত্যাকাণ্ড</strong></p> <p>গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে যশোরে মাথায় গুলি করে মেহের আলী (৪৫) নামের এক প্রবাসীকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। নিহত মেহের আলী ওই এলাকার আব্দুল মালেক মণ্ডলের ছেলে। তিনি সম্প্রতি কুয়েত থেকে দেশে ফেরেন। তিনি স্থানীয় বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিলেন। স্বজনদের দাবি, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক কোন্দলে এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এর পরপরই গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের বাঁশবাড়ি গ্রামে চোর সন্দেহে মো. ইসরাফিল নামের এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আবার হবিগঞ্জের বাহুবলে ধানক্ষেত থেকে মাসুক মিয়া (৩২) নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ সময়ে পিরোজপুরে এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আর গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গেণ্ডারিয়া এলাকায়  ছুরিকাঘাতে মো. জিন্নাহ (৬০) নামের ব্যাটারিচালিত এক রিকশাচালককে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর খিলক্ষেতের নিকুঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মুনতাকিম আলিফ (২৭) নামের এক যুবক নিহত হন। ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মহাখালীতে নেশার টাকা না দেওয়ায় মশিউর রহমান (৪৫) নামের এক ব্যক্তি আপন ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হন। ২৩ সেপ্টেম্বর বাসায় চুরি করতে গিয়ে দুই চোর নটর ডেম কলেজের অফিস সহকারী লিপিকা গোমেজকে হত্যা করে বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।</p> <p>এ ছাড়া সম্প্রতি চট্টগ্রামে শাহাদাত হোসেন নামের এক যুবককে চোখ বেঁধে গান গাইতে গাইতে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে গত ১১ সেপ্টেম্বর রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে বিরোধে বগুড়ায় খুন হন দুজন। ৬ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের নাগরপুরে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক ব্যক্তি ও তাঁর ভাতিজাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে খুনের অভিযোগে এক যুবককে আটক করে গণপিটুনি দেয় স্থানীয়রা। এতে তাঁরও মৃত্যু হয়। আবার গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরে গরু চোর সন্দেহে দুজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে।</p> <p>এইচআর এসএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।</p> <p>এর মধ্যে গত সেপ্টেম্বর মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আধিপত্য বিস্তারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনীতে মানুষ হত্যা, রাজনৈতিক মামলা ও গ্রেপ্তার, হামলা, শ্রমিক হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি নির্যাতন ও হত্যা, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেশি ছিল।</p> <p>দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ এবং এইচআর এসএসের সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে দুই মাসের  মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে জানান সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম।</p> <p>প্রতিবেদনে বলা হয়, এর মধ্যে নরসিংদীর পলাশে ও ঢাকার কারওয়ান বাজারে শিক্ষার্থী ও বিএনপির বাজার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রিক সহিংসতায় ৩০ জন আহত হয়েছেন।</p> <p>সেপ্টেম্বর মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে বা হেফাজতে ৯ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে দুজন পাহাড়ি নাগরিক নিহত হন। এ ছাড়া আশুলিয়ায় ৩০ সেপ্টেম্বর পোশাক শ্রমিক কাউসার হোসেন খান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এ মাসে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যে নির্যাতনে চারজন নিহত হন।</p> <p>অন্যদিকে গত ২৫ আগস্ট ছাত্রদের সঙ্গে আনসার বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে আহত গাড়িচালক শাহীন হাওলাদার (৪০) ৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের হেফাজতে সৈয়দ নুরুল করিম নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। এ মাসে অন্তত ১৮টি ঘটনায় ৯০ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন; আহত হয়েছেন অন্তত ২১ জন, লাঞ্ছিত হয়েছেন দুজন, হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন তিনজন ও গ্রেপ্তার হয়েছেন দুজন। এ ছাড়া পাঁচটি মামলায় ৬২ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ মাসে বড় উদ্বেগের বিষয় ‘গণপিটুনির’ ৩৬টি ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে রাজশাহীতে গণপিটুনিতে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) গণপিটুনির শিকার ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের সামনে তোফাজ্জল হোসেন নামের মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।</p> <p>এ ছাড়া ঢাকা, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, নোয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শরীয়তপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মাজারে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯০ জন।</p> <p>সেপ্টেম্বর মাসে ৩৪টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন এবং আহত হয়েছেন অন্তত ১৭৬ জন। এ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪৫টি ঘটনা ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলের কারণে। ২৩টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে, পাঁচটি আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে ও ১০টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে। নিহত ১৬ জনের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে আওয়ামী লীগের একজন ও বিএনপির আটজন নিহত হয়েছেন। বাকি সাতজন নিহত হয়েছেন বিরোধী পক্ষের হামলায়। ১৬ জন নিহতের মধ্যে ১১ জন বিএনপির আর পাঁচজন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক।</p> <p>এ ছাড়া সারা দেশে আধিপত্য বিস্তার ও দুর্বৃত্তের হামলায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের আরো অন্তত আটজনের মৃত্যু হয়। এসব সহিংসতায় কমপক্ষে ২৫০টি ঘরবাড়ি, যানবাহন ও ব্যবসা  প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সেপ্টেম্বর মাসে ১১০ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৪ জন, যাদের মধ্যে ১৫ জন ১৮ বছরের কম বয়সী।</p> <p>এইচআরএসএসের আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়, আগস্ট মাসে কমপক্ষে ৫৪১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭ থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে কমপক্ষে ৪৯টি ‘রাজনৈতিক সহিংসতার’ ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ২২ জন। এ সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত ৫৩৭ জন। এদিকে আগস্ট মাসে অন্তত ১৭৮টি মামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনাকে আসামি করে ১০৮টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ১৪ হাজার ৪৯১ জনকে নাম উল্লেখ করে এবং ৯২ হাজার ৫৯ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়।</p> <p>মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষক নুর খান কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও সামাজিক সহিংসতায় অনেকে হতাহত হয়েছেন। দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।</p>