<p>হাইকোর্টের ১২ বিচারক বেঞ্চ পাচ্ছেন না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। একই সঙ্গে আগামী ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণসংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ (পুনর্বিবেচনার আবেদন) শুনানির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির সমাবেশে এই ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞা।</p> <p><strong>বিচারক অপসারণের দাবিতে দিনভর যা হলো</strong></p> <p>হাইকোর্টের বিচারকদের পদত্যাগের দাবিতে গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। ওই ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল সকাল থেকে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হতে থাকেন। সর্বোচ্চ আদালতের নিরাপত্তায় আগে থেকেই সুপ্রিম কোর্টের প্রতিটি ফটকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি ছিল। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছিলেন।</p> <p>জমায়েত বাড়লে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও সারজিস আলমের নেতৃত্বে দুপুর ১২টার দিকে মিছিল করতে করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এসে অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। চলতে থাকে মিছিল-স্লোগান। সেখান থেকে ‘দলবাজ, দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দোসর’ বিচারকদের পদত্যাগ বা অপসারণের আলটিমেটাম দেন সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। প্রথমে দুপুর ২টার মধ্যে তাঁদের পদত্যাগ করতে আলটিমেটাম দেওয়া হয়।</p> <p>বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে পদত্যাগ বা অপসারণের ঘোষণা না আসায় এক ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে বিকেল ৩টার মধ্যে পতদ্যাগ বা অপসারণের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের কয়েকজন বিচারককে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে আসতে এবং বের হয়ে যেতে দেখা যায়। নাম-পদবি প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে বলে, ‘প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের ১২ জন বিচারককে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ডেকেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নুরউদ্দিন, বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম এসে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।’</p> <p>দুপুর সোয়া ২টার দিকে প্রধান বিচারপতির দপ্তর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক এস এম মাসুদ হোসেন দোলন ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলামকে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেন। কী জন্য তাঁরা এসেছিলেন সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, ‘সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য আমাদের ডাকা হয়েছিল। সাক্ষাৎ করে গেলাম।’</p> <p>এরপর বিকেল ৩টার দিকে রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভূঞার সঙ্গে বৈঠকে বসেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, আরিফ সোহেলসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। তাঁদের সঙ্গে বিএনপিপন্থী সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীও ছিলেন। বিকেল সাড়ে ৩টায় সারজিস আলমসহ কয়েকজন রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তর থেকে বের হয়ে যান। তখনো রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে বসা ছিলেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহসহ বিএনপিপন্থী কয়েকজন আইনজীবী।</p> <p>কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে বৈঠকে অংশ নেওয়া আইনজীবী এ আর রায়হান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিচারকদের পদত্যাগ ও অপসারণের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে পদত্যাগ বা অপসারণের জন্য সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে কোনো তালিকা দেওয়া হয়নি।’</p> <p>রেজিস্ট্রার জেনারেলের দপ্তরে হাসনাত আবদুল্লাহ ও কয়েকজন আইনজীবীর বসে থাকার মধ্যে রেজিস্ট্রার জেনারেলকে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে যেতে দেখা যায়। বিকেল পৌনে ৪টায় নিজ দপ্তরে ফিরে এসে আজিজ আহমেদ ভূঞা সমন্বয়ক-আইনজীবীদের সঙ্গে ফের বৈঠক করেন। এর কিছুক্ষণ পর সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীদের মাঝে এসে ঘোষণা দেন রেজিস্ট্রার জেনারেল।</p> <p><strong>হাইকোর্টের ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত</strong></p> <p>সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার তাঁর ঘোষণায় বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল হিসেবে আপনাদের যে দাবি, তা নিয়ে আপনাদের যে লিডার তাঁরা আমার চেম্বারে বসেছেন। অনেক্ষণ আলোচনা করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সঙ্গে আমার দুজন সহকর্মীও ছিলেন। আপনারা জানেন, বিচারপতির (সুপ্রিম কোর্টের) পদত্যাগ বা অপসারণের একটা প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এসংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটি (সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মামলার মাধ্যমে) বাতিল করে দিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে সরকার (বিগত আওয়ামী লীগ সরকার) আবার রিভিউ করেছে। আগামী রবিবার ২০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মাননীয় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে আপিল বিভাগে এই রিভিউ আবেদনের শুনানি হবে। ওই দিন এটিকে এক নম্বর আইটেম হিসেবে রাখা হয়েছে।’</p> <p>আজিজ আহমেদ ভূঞা বলেন, ‘বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণ সে উদ্যোগও মহামান্য রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে মাননীয় প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থই হলো আগামী ২০ অক্টোবর যে কোর্ট খুলবে (অবকাশ ছুটির পর) তখন তাঁরা (১২ জন বিচারক) আর বিচারকাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আর ওই (ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ) মামলার শুনানি আছে ২০ অক্টোবর। মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল সেটি উপস্থাপন করবেন বলে আশা করছি। এর মাধ্যমে পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে।’</p> <p>তিনি আরো বলেন, ‘আর বিচারপতি অপসারণের সঙ্গে এককভাবে সুপ্রিম কোর্ট জড়িত নন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মাননীয় উপদেষ্টাও জড়িত আছেন। আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। পর্যায়ক্রমে শুনানির মাধ্যমে বাকিগুলো আপনাদের সামনে আসবে।’</p> <p>রেজিস্ট্রার জেনারেলের ঘোষণার পর সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আরিফ সোহেল বক্তব্য দেন। হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘বিচারপতি অপসরাণের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মামলাটি চলমান আছে। আগামী ২০ তারিখ ওই মামলায় যদি সমাধান চলে আসে, তাহলে বিচারপতি অপসারণের দায়িত্ব হচ্ছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের। তাহলে সেদিনই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত বিচারকদের পদত্যাগ করতে হবে। তাঁদের অপসারণ করা হবে। তারা (সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন) আমাদের কথা দিয়েছে। ফলে রবিবার বিকেল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। তাঁদের অপসারণের কী রায় আসে, আমরা তা পর্যবেক্ষণ করব। তারপর আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। রবিবার (২০ অক্টোবর) যদি প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত না আসে, তাহলে সোমবার থেকে পুরো বাংলাদেশ দেখবে। স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই, যদি মেরুদণ্ডহীন বিচারকরা নিজে থেকে পদত্যাগ না করেন কিংবা সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে বা হাইকোর্টের মাধ্যমে তাঁদের অপসারণ করা না হয়, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রপতি পদে যিনি বসে আছেন, তিনি যেন ভুলে না যান কাদের অবদানে তিনি এখনো সেখানে বসে আছেন। খুনি হাসিনার দালাল বিচারপতিদের অপসারণ করতে হবে। যদি না করা হয় তখন কী অ্যাকশন নিতে হয় সেটি ছাত্রসমাজ জানে।’</p> <p>সমন্বয়ক হাসনাত বলেন, ‘আমরা দেখেছি হাইকোর্ট, জজকোর্টসহ আমাদের যতগুলো বিচারালয় আছে, সেখানে দম্ভের সঙ্গে তাঁরা (আওয়ামীপন্থী আইনজীবীরা) শেখ হাসিনার পুনর্বাসনের জন্য মিছিল বের করেছেন। তাঁদের (আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের) অপসারণে সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টের কোনো এখতিয়ার নেই। আমরা ছাত্র-নাগরিকের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দাবি জানাচ্ছি, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের গ্রেপ্তার করবেন।’</p> <p>সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে হাসনাত আরো বলেন, ‘আমাদের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে স্পষ্ট করতে চাই, আওয়ামী লীগের যারা দোসর রয়েছে, আওয়ামী লীগকে যারা সুবিধা দিয়েছে, আওয়ামী লীগের সুবিধা যারা নিয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে তারা অপ্রাসঙ্গিক। তাদের কোনো ধরনের প্রাসঙ্গিকতা নেই। ছাত্র-জনতা যখনই কোনো সংকট দেখবে, দলমত নির্বিশেষে আমরা রাস্তায় নেমে আসব। পরে যত সংকট তৈরি হবে মজলুম পরিচয়ে আমাদের অবস্থান জারি থাকবে।’ হাসনাতের পর সমন্বয়ক আরিফ সোহেল বক্তব্য দেন। এরপর কর্মসূচি সমাপ্তি ঘোষণা করলে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ছেড়ে যান আন্দোলনকারী।</p> <p><strong>যে ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত</strong></p> <p>বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ হাইকোর্টের যে ১২ বিচারককে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের একটি সূত্র থেকে সেই বিচারকদের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন—বিচারপতি নাইমা হায়দার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামান, বিচারপতি আতাউর রহমান খান, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন।</p>