<p>বাংলাদেশে জলবায়ু তহবিলের অর্থ নানাভাবে নয়-ছয় হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সড়কবাতি স্থাপন, পার্ক তৈরি, পুকুরের ঘাট বাঁধানোসহ নানা কাজে এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি জলবায়ুর টাকায় ভবন বানিয়ে ব্যক্তিগত রিসোর্টে পরিণত করারও নজির আছে।</p> <p>পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলার তেলিখালি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইকো রিসোর্টের নামে ১০০ বিঘা জমিতে একটি ব্যক্তিগত রিসোর্ট ও পার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। সরকারি খাস জমির ওপর এই পার্ক করা হয়েছে জলবায়ু তহবিলের টাকায়।</p> <p>ভান্ডারিয়া উপজেলা সদরের রিজার্ভ পুকুরের চারপাশে ওয়াকওয়ে, ঘাটও বানানো হয় জলবায়ুর টাকায়। ওই পুকুরে রঙিন মাছ, পানির ফোয়ারাও বানানো হয়েছে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট লবণাক্ত পানির কারণে ফসলি জমি নষ্ট হওয়ার কোনো প্রতিকার করা হয়নি।</p> <p>একইভাবে জলবায়ু ট্রাস্টের তহবিলে খুলনায় গড়ে তোলা হয়েছে শেখ রাসেল ইকো পার্ক। খুলনার রূপসা এলাকায় প্রায় ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ওই পার্ক তৈরি করা হয়।</p> <p>খুলনার তিন উপজেলায় এই তহবিলের টাকায় লাগানো হয়েছে সৌরবাতি। কিন্তু ওই এলাকায় এই ধরনের কোনো প্রকল্পই ছিল না। ছিল সুন্দরবন এবং আশপাশের উপজেলায় সুপেয় পানির প্রকল্প।</p> <p>ভোলার চরফ্যাশনে একইভাবে জলবায়ু ট্রাস্টের টাকায় তৈরি করা হয়েছে সুউচ্চ ‘জ্যাকব টাওয়ার’ ও ইকোপার্ক। ভোলার চর কুকরি-মুকরিতেও জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় করা হয়েছে বিনোদন কেন্দ্র।</p> <p>২০২০ সালে জলবায়ু তহবিলের টাকায় কেনা চারটি বাস আগারগাঁও পরিবেশ অধিদপ্তরে পড়ে থেকে ধুলোবালিতে নষ্ট হয়ে গেছে। ওই বাস চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিবেশ সচেতনতার কাজে লাগানোর কথা ছিল।</p> <p><strong>ক্ষতিগ্রস্তদের কথা</strong></p> <p>সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু। ওই এলাকার মানুষ খাবার পানির সংকটে আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও আরো পাঁচটি ইউনিয়নে চলছে খাবার পানির হাহাকার।</p> <p>পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, ‘এলাকায় কোনো সুপেয় পানি নেই। সরকারের দিক থেকেও উদ্যোগ তেমন নেই। অনেক কষ্টে বহু দূর থেকে পানি এনে জীবন চলছে।’</p> <p>তিনি জানান, পানির সংকটের কারণে উপজেলার অনেক মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। নারী ও শিশুদের ৭০ শতাংশই নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। ফসলি জমিও লবণ পানির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।</p> <p>ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা সামিউল মনির বলেন, ‘লবণ পানির কারণে এখানে গবাদি পশুর খাদ্যেরও সংকট রয়েছে। অনেকেই কাদাপানির মধ্য দিয়ে সুপেয় পানি সংগ্রহের চেষ্টা করেন। তারা কাদাপানি সংগ্রহ করেন। পরে তা থিতিয়ে ওপর থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়।’</p> <p>শ্যামনগর উপজেলার জলবায়ু পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ আশেক ই ইলাহী বলেন, ‘জলবায়ু ট্রাস্টের কোটি কোটি টাকা থাকলেও তা আমাদের জন্য এতদিন খরচ হয়নি। এই এলাকায় কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। সুপেয় পানির কোনো উৎস তৈরি করা হয়নি।’</p> <p><strong>জলবায়ু তহবিল</strong></p> <p>জলবায়ু তহবিলের টাকায় ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩২২টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০৯টি সড়কবাতি বসানোর প্রকল্প, যা মোট প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ। এসব প্রকল্পে বরাদ্দ ৩৩৮ কোটি টাকা। ২৩টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে নর্দমা নির্মাণের জন্য। এতে ব্যয় ৪১ কোটি টাকা। আর ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত তহবিলটির মাধ্যমে ৯৬৯টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা।</p> <p>গত বছরের ১৮ জুন সংসদে জানানো হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ওই সময় পর্যন্ত সর্বমোট তিন হাজার ৮৫২ কোটি টাকা জলবায়ু তহবিলে বরাদ্দ করা হয়েছে। এই অর্থ দিয়ে ৮৫০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।</p> <p>গত ২০ অক্টোবর প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে তখন দেশে জলবায়ু খাতে কোনো ঋণ ছিল না। গত ১৫ বছরে এ খাতে জনপ্রতি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৭৯.৬১ ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ৯ হাজার ৪৮৫ টাকা। ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ১৪. ৪৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে, যা মোট ঋণের ৯.৭ শতাংশ।</p> <p>জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকার শীর্ষ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। অলাভজনক সংস্থা জার্মান ওয়াচের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে সাত নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ।</p> <p><strong>বিশ্লেষকরা যা বলছেন</strong></p> <p>পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ইনামুল হক বলেন, ‘আসলে এই খাতে নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার কোনো সম্পর্ক নেই। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ খরচ করা হয়েছে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার সময়ে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে যে, জলবায়ুর জন্য অনেক কাজ হচ্ছে। আসলে জনস্বার্থে কোনো কাজ হয়নি। যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেগুলো নিয়ে এখন তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’</p> <p>বুয়েটের অধ্যাপক এবং জলবায়ু ও পরিবেশবিদ ড. আহসান উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের এখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে আসলে পরিকল্পনামাফিক কোনো কাজ হয়নি। এর কোনো চেষ্টাও হয়নি। আর যখন ফান্ড তৈরি করা হলো তখন তার জন্য জাতীয় প্রয়োজনে কোনো নীতিমালা বা নির্দেশনাও তৈরি করা হয়নি।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘এখানে ট্রাস্ট গঠনের পর খেয়ালখুশি মতো অর্থ খরচ করা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজ করা হয়নি।’</p> <p>এ বিষয়ে কথা বলার জন্য গত সরকারের সময়ে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের দায়িত্বে থাকা পিকেএসএফ-এর সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদকে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।</p>
