<p style="text-align:justify">দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর সব সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। ন্যায় ও নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে সব কিছু। শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এই প্রত্যাশা আরো বেড়ে গিয়েছিল। আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, সুদিন ফিরবে শিগগির। মানুষের এই প্রত্যাশা ও বিশ্বাস ভাঙতে শুরু করেছে। বাস্তবে তারা দেখছেন, কোথাও শৃঙ্খলা নেই। সরকার এখন এই শৃঙ্খলা ফেরানোর কঠিন পরীক্ষায়।</p> <p style="text-align:justify">সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, আদালত, আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনপ্রশাসন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সড়ক-ট্রাফিক সবখানেই বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। এসব খাতের অনেকগুলোতেই বিশৃঙ্খলা চরমে উঠেছিল বিগত সরকারের আমলে। প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তা তো ঘটেনি, বরং কিছু খাতে বিশৃঙ্খলা আরো বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে নতুন কোনো বিনিয়োগ আসছে না। অনেক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হচ্ছে। শুধু হয়রানির উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই হত্যা মামলায় সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আস্থার অভাবে শিল্প-কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। এর বাইরে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্যাংকিং খাতে মূলধন সংকট এখনো রয়ে গেছে। বিগত সরকারের আমলে শুরু হওয়া ডলার সংকট ও আমদানি জটিলতাও কাটেনি। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট ছিল আগেও। পেমেন্ট পরিশোধসহ নানা কারণে এখন আরো অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার প্রথম দিকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠক করলেও সেখানে দেশের সব ব্যবসায়ীর অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। সাধারণ ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দল-মত-নির্বিশেষে সব ব্যবসায়ীর কথা শুনবেন। বৃহত্তর পরিসরে তাদের সংকট ও সমস্যা সমাধানে একটি কাঠামোগত উদ্যোগ নেবেন। এ ধরনের উদ্যোগের পরিবর্তে বরং ব্যবসায়ী নন, এমন আমলাদের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে আরো বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। </p> <p style="text-align:justify">বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, এখন যেভাবে চলছে, এতে অনেক ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা নিজেদের অবহেলিত মনে করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের ডেকে তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে সরকারের মধ্যে প্রচেষ্টার অভাব দেখা যাচ্ছে। এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, দেশের সব ব্যবসায়ী ব্যাংক লুটেরা নন, সব ব্যবসায়ী অর্থ পাচার করেননি। এর বাইরেও ছোট-বড় অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যাদের ওপর শিল্প-কারখানার উৎপাদন ও অর্থনীতি নির্ভর করে। অর্থনীতির বিশৃঙ্খলা কাটাতেই এখানে আরো বেশি সংযোগ রক্ষা করা উচিত ছিল সরকারের।</p> <p style="text-align:justify">বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে জনপ্রশাসন তথা প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়েও। নিয়োগ-পদোন্নতি ও বেতন-ভাতার বৈষম্য নিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিস্তর অভিযোগ। ৯ দফা দাবি নিয়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে সমাবেশের ডাক দিয়েছেন খোদ সরকারি কর্মচারীরা। পুলিশ প্রশাসনেও নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি নিয়ে খোদ পুলিশের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ন্যায়বিচারের জন্য মানুষ যে আদালতের দ্বারস্থ হবে, সেখানেও বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এত বেশি অবনতি ঘটেছে যে খোদ আদালত প্রাঙ্গণও নিরাপদ মনে করছেন না বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী জনগণ। সম্প্রতি চট্টগ্রামে একজন আইনজীবীকে আদালত প্রাঙ্গণে কুপিয়ে মারা হয়েছে। এমনকি একজন বিচারককেও ডিম ছুড়ে মারার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। আর মামলা, শুনানি, জামিন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের উকিলদের মধ্যে হরহামেশাই চলছে হাতাহাতি, মারামারির ঘটনা।</p> <p style="text-align:justify">আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির সুযোগে শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও অরাজকতা শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। ‘ভুল চিকিৎসায়’ এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের জেরে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালান ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শত শত শিক্ষার্থী গিয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা চালান। এর আগে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর এবং ঢাকার সাত কলেজের অধিভুক্তি ইস্যুতেও বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে।</p> <p style="text-align:justify">দেশের স্বাস্থ্য খাতেও চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক কর্মকর্তার ব্যানারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাগাতার ঘেরাও, মৌন মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে। অনেকে এই সুযোগে নেমেছেন পদ ও চেয়ার দখলে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল-বিএমঅ্যান্ডডিসি মেডিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টদের নিবন্ধন দিয়ে নতুন বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর ক্যাডার ও নন-ক্যাডারদের দুটি বিপরীতমুখী আদেশ জারি হওয়ায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার এবং পরিবার পরিকল্পনা কর্মীরা দাবি আদায়ে পথে নেমেছেন। </p> <p style="text-align:justify">শৃঙ্খলা নেই সড়কেও। যানজট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টা পুলিশসহ বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিলেও কোনো কাজে আসেনি। উপরন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধে আদালতের নির্দেশনার বাস্তবায়ন নিয়ে আরো বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে রিকশাচালকদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার পর বন্ধের নীতিতে পিছু হটেছে সরকার। এই সুযোগে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠেছেন। তারা এখন মূল সড়কে বিপজ্জনকভাবে বড় যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন।</p> <p style="text-align:justify">বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে গণমাধ্যম নিয়ে। দেশের দুটি প্রধান সারির জাতীয় দৈনিকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে প্রতিবাদকারীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই দেড় শর বেশি গণমাধ্যমকর্মীর অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমন-পীড়নের ব্যাপক নিন্দা জানিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)।</p> <p style="text-align:justify">বাংলাদেশ নিয়ে যে আশার জায়গা দেখা দিয়েছিল, সেটি এখন উদ্বেগে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে কমনওয়েলথ অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপ-এপিপিজি। সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের আমলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হলেও তোষামোদি, দুর্নীতি ও মানবাধিকারে হতাশাজনক পরিস্থিতি ছিল। নিজেদের অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে,  সরকারি প্রতিষ্ঠান, গণতন্ত্র এবং মুক্ত মিডিয়ার প্রশ্নে আস্থার অভাব রয়েছে। আমরা এমন প্রমাণ পেয়েছি, যা নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতির অবসান ঘটানো এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখা জরুরি হয়ে পড়েছে। এসব করতে ব্যর্থ হলে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর ভালো প্রভাব পড়বে না।’</p> <p style="text-align:justify">সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন </p>