জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ বলেছেন, ‘সাহিত্য একক ব্যক্তির কাজ নিভৃত সাধনা। বিপরীতে সাংবাদিকতা হচ্ছে সামষ্টিক উদ্যোগ। গণমাধ্যমের (প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক বা বৈদ্যুতিক) মূলমন্ত্র আমি নয়, আমরা। অতি অবশ্যই এটি একটি টিমওয়ার্ক।
’
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এ বি এম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের ‘আজীবন সম্মাননা প্রদান ও স্মারক বক্তৃতা’ অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি। এ বছর এ বি এম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রবীণ সাংবাদিক আমান উল্লাহ।
অনুষ্ঠানে ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আন্তঃসম্পর্ক’ শীর্ষক স্মারক বক্তব্যে হাসান হাফিজ বলেন, ‘সাহিত্য চিরকালীন, সাংবাদিকতা তাৎক্ষণিক। সাহিত্য কালজয়ী, অন্যদিকে সাংবাদিকতা কাজ করে সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি, তার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রভাব সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে।
সাহিত্যের যে আবেদন, তার যে সৌকুমার্য ও নান্দনিকতা তথা সৌরভ, সেটা মানবমনে দাগ কাটে। গভীর সূক্ষ্ম আলোড়ন তোলে মনের পটে, তা একপ্রকার স্থায়ী আসন করে নিতে সমর্থ হয়।’
আরো পড়ুন
নতুন রাজনৈতিক দলের নাম হচ্ছে ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’
তিনি বলেন, ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্যে মিল যেমন আছে, অমিলও রয়েছে। সহজেই অনুমেয় যে সাহিত্যের উন্মেষ ঘটেছে আগে।
সাংবাদিকতার বিকাশ পরবর্তী কালের ঘটনা। মানুষ যখন লেখাপড়া শেখেনি, কাগজ-মুদ্রণ শিল্পের উদ্ভব ঘটেনি, তখনো সাহিত্য ছিল। সময়ের বাঁকবদলে কালক্রমে মানুষ পড়াশোনা শিখল, সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হলো। প্রসারিত হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চর্চা। গুহাচিত্রের মধ্যেও প্রতিফলন ঘটেছে আদিম সমাজের মানবমণ্ডলীর শিল্পতৃষ্ণার। মানুষ মুখে মুখে ছড়া কেটেছে, ছন্দের দুলুনি অনুরণন তুলেছে তাদের মনে। গল্প বলিয়েরাও রূপকথার বয়ন ও বয়ান করেছেন। মুগ্ধ তন্ময়তা সহকারে মানুষ সেগুলোর কদর করেছে। পরিচয় দিয়েছে সমঝদারিত্বের। এভাবেই দেশে দেশে উদ্ভব ঘটেছে লোকছড়ার, লোকসাহিত্যের। পরম্পরাক্রমে সেই ঐতিহ্য, সেই নান্দনিকতা এসে পৌঁছেছে হালফিল ডিজিটাল বিশ্বে।’
কবি হাসান হাফিজ বলেন, ‘একজন রিপোর্টার চাঞ্চল্যকর, জনগুরুত্বসম্পন্ন কোনো ব্রেকিং নিউজ পেয়ে গেলেও এককভাবে সেটা শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের কাছে তিনি পৌঁছাতে পারেন না। তাকে নির্ভরশীল হতে হয় আরো কয়েকজনের ওপর সম্পাদনার টেবিল, ছাপা বা ব্রডকাস্টিংয়ে নিয়োজিত কর্মীদের ওপর। সাহিত্য হচ্ছে সৃষ্টিশীল কাজ-কবি বা লেখকের নিভৃত সাধনার বিষয়। তাকেও পাঠক-শ্রোতার কাছে পৌঁছাতে হলে অন্যের সহায়তা নিতে হয়। সাংবাদিক যে তথ্য সংবলিত রিপোর্টটি তার টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করে থাকেন- সেই তথ্য কিন্তু একাধিক সাংবাদিকেরও করতলগত হতে পারে। কিন্তু সাহিত্য হচ্ছে মৌলিক বিষয়- সেটি লেখকের মস্তিষ্ক ও মননজাত পণ্য। সেখানে তিনি একক। কোনো অংশীদারির বিষয় নেই। কেউ কেউ হয়তো আপত্তি করতে পারেন পণ্য শব্দটির ব্যবহার নিয়ে। আমরা যদি খতিয়ে দেখি, তাহলে দেখব সেটি তো অন্যকে প্রাণিত, বিনোদিত, উদ্বুদ্ধ উদ্দীপিত করার জন্যই রচিত হয় বা হয়ে এসেছে। সাহিত্যের যে সৃষ্টি, তার সঙ্গে পাঠক যদি নিজের অনুভূতি, চিন্তন, কল্পনার সঙ্গে কিছুটা হলেও সাযুজ্য খুঁজে পান- তাহলে বলা যায় সাহিত্য সৃষ্টি সার্থক ও সফল।’
সাংবাদিকের ভাষাগত জ্ঞান বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করে হাসান হাফিজ বলেন, ‘এখন সাংবাদিকতায় শৈথিল্য এসেছে। এখন অনেক রিপোর্ট, এমনকি সম্পাদকীয়তেও ভাষাগত ভুল পাওয়া যায়। ভাষাগত অজ্ঞতা ও অস্পষ্টতা লেখাকে অসচ্ছ করে। ভালো সাংবাদিক তার লেখার জন্য পাঠায় করে নেন।’
তিনি আরো বলেন, একজন সাংবাদিকের চোখ শুধু সংবাদের দিকেই থাকে না। সংবাদের পেছনে অনেক কিছুই তার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আসে। এক সময়ে মানুষ, সাংবাদিকদের তাদের পক্ষের অধিকারকর্মী বিবেচনা করত। যারা মানুষের ও প্রকৃতির বিপন্নতার সময় তাদের পক্ষে কলম ধরবে।’
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা একে অপরের পরিপূরক উল্লেখ করে হাসান হাফিজ বলেন, ‘সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্যে কোনো বৈরিতা নেই। সাংবাদিকতার ঘটনাকে উপজীব্য করেও কালজয়ী সাহিত্য রচনা হতে পারে। সাংবাদিকতা যদি সাহিত্য আশ্রিত হয়, তবে তা সার্থকতা মণ্ডিত করে তোলা সম্ভব।’
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, ‘মূসা ভাই একজন তুখোড় রিপোর্টার ও সম্পাদক ছিলেন। সেই মানের সাংবাদিক ও সম্পাদক এখন আমরা পাই না। সেতারা মূসা দৈনিক জনতাসহ অনেক পত্রিকায় কাজ করেছেন। সেই সময় সাংবাদিকতা করা ছিলো, নারীদের জন্য খুব সাহসী কাজ। সেতারা মূসা সাংবাদিকতা করার পাশাপাশি নারী সাংবাদিকদের সংগঠিত করেছিলেন।’
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট এ বি এম মূসার ৯৪তম এবং নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত সেতারা মূসার ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আমান উল্লাহকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন এ বি এম মূসা-সেতারা মূসা ফাউন্ডেশনের সভাপতি মরিয়ম সুলতানা মূসা রুমা।
এ সময় আমান উল্লাহ বলেন, ‘কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এ বি এম মূসা নিজেকে একজন সফল সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। এ দেশের সাংবাদিকতা জগতে তিনি ছিলেন এক অনন্য প্রতিভা, কিংবদন্তি ও সাংবাদিকতার দিকপাল। বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এ বি এম মুসা পরিস্থিতি ও সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করতেন। তার মধ্যে ছিল সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকের প্রতি দূঢ় অঙ্গীকার ও দায়িত্ববোধ। সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। তিনি অর্জন করতে পেরেছিলন বড়দের সমর্থন ও ছোটদের আনুগত্য। নির্ভীক, দূঢ়চেতা ও বলিষ্ট চরিত্রের অধিকারী সব ধরনের বৈরিতাকে ঘৃণাভরে উপেক্ষা করে বীরের মতো চলে গিয়েছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরো বক্তৃতা করেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য কাজী রওনক হোসেন, ফাউন্ডেশনের কোষাধ্যক্ষ ব্যারিস্টার আফতাব উদ্দিন ও নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক ড. শারমিন মূসাসহ জেষ্ঠ্য সাংবাদিকগণ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মৃদুলা সমদ্দারের কণ্ঠে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়।