<p style="text-align:justify">দেশের স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে গঠিত স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের কাছে সাতটি প্রস্তাব পেশ করেছে জাতীয় নাগরিক কমিটি।</p> <p style="text-align:justify">আজ মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডের শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে সংস্কার কমিশনের প্রধান জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদের হাতে এই প্রস্তাব তুলে দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা।</p> <p style="text-align:justify">পরে সাংবাদিকদের কাছে এই প্রস্তাবনা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবনায় শুধু ছোটখাটো পরিবর্তনের সুপারিশ নয়, এটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার রূপরেখা। স্বাস্থ্য খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা চিহ্নিত করে বাস্তবসম্মত, কার্যকর ও সুস্পষ্ট সমাধান তুলে ধরা হয়েছে, যা স্বাস্থ্যসেবা সবার জন্য সহজলভ্য করবে।’</p> <p style="text-align:justify">তাসনিম জারা বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এমন হবে, যেখানে একজন কৃষক আর একজন মন্ত্রী একই মানের চিকিৎসা পাবেন। আমরা ছোটখাটো পরিবর্তনের কথা বলছি না, আমরা এমন এক সংস্কারের কথা বলছি, যা স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তন আনবে; চিকিৎসা খরচ কমিয়ে দেবে, পুরো ব্যবস্থাকে স্বয়ংসম্পন্ন করে তুলবে ও স্বাস্থ্যসেবায় বৈষম্য থাকবে না।’ </p> <p style="text-align:justify">তিনি আরো বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে আমরা সরকার, চিকিৎসক সমাজ এবং সাধারণ নাগরিকদের এই সংস্কার বাস্তবায়নে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং জনসাধারণের সহযোগিতা থাকলে বাংলাদেশে একটি আধুনিক, দক্ষ এবং সমতার ভিত্তিতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।’</p> <p style="text-align:justify">এখনই পরিবর্তনের সময় জানিয়ে ডা. তাসনিম জারা বলেন, ‘আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে আর অপেক্ষা করাটা ঠিক হবে না। রোগীরা কষ্টে, ডাক্তাররা হতাশ, আর দেশের সম্পদ অকারণে নষ্ট হচ্ছে। এই প্রস্তাবনা সমাধানের কিছু বাস্তবসম্মত উপায় দেখিয়েছে। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব নীতিনির্ধারকদের।’</p> <p style="text-align:justify"><strong>স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রস্তাবনায় জাতীয় নাগরিক কমিটির সাতটি প্রস্তাব :</strong></p> <p style="text-align:justify">১. জরুরি স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ও আধুনিক অ্যাম্বুল্যান্স সিস্টেম চালুর কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। অনেক রোগী সময়মতো অ্যাম্বুল্যান্স পান না, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই অনেকে মারা যান। এই প্রস্তাবনায় একটি আধুনিক জরুরি সেবাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অ্যাম্বুল্যান্সে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক থাকবে, যাতে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। এখনকার মতো শুধু রোগী পরিবহনের পরিবর্তে, অ্যাম্বুল্যান্সেই জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা শুরু হবে, যা মৃত্যুহার কমাতে সাহায্য করবে।</p> <p style="text-align:justify">২. একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে। বাংলাদেশের বড় হাসপাতালগুলো রোগীর অতিরিক্ত চাপে বিপর্যস্ত, কারণ অনেক রোগী উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল বাদ দিয়ে সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন। এর ফলে যারা সত্যিকারের জটিল রোগী, তারা প্রয়োজনীয় সময়ে চিকিৎসা পান না। এই প্রস্তাবনায় একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করা হয় এবং রোগীদের সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।</p> <p style="text-align:justify">৩. স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উন্নত কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত করতে হবে। দেশের  চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দীর্ঘ সময় কাজ করেন, কিন্তু তাদের বেতন কম, পদোন্নতির সুযোগ অপ্রতুল, এবং অনেক সময় সহিংসতার শিকার হন। এই প্রস্তাবনায় ন্যায্য বেতন, কর্মজীবনের অগ্রগতি এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসক ও নার্সদের কাজ করতে উৎসাহিত করতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের জন্য কাজের সুবিধাজনক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হাসপাতালে ডে-কেয়ার সুবিধাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতির সুপারিশ করা হয়েছে।</p> <p style="text-align:justify">৪. সারা দেশে ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা (ইএইচআর) চালু করতে হবে। বর্তমানে একজন রোগী যখন এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে যান, তখন তার আগের চিকিৎসার তথ্য নতুন চিকিৎসক জানেন না। ফলে বারবার পরীক্ষা করতে হয়, সময় নষ্ট হয়, আর চিকিৎসায় ভুলের ঝুঁকি বাড়ে। এই সমস্যা দূর করতে একটি জাতীয় ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড (ইএইচআর) ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি রোগীর একটি ডিজিটাল স্বাস্থ্যপরিচয় থাকবে, যা দেশের সকল হাসপাতালে ব্যবহার করা যাবে। এতে চিকিৎসার গতি বাড়াবে ও খরচ কমাবে। পাশাপাশি চিকিৎসাসংক্রান্ত কোনো অনিয়ম ঘটলে তা দ্রুত চিহ্নিত ও সংশোধন করা সম্ভব হবে।</p> <p style="text-align:justify">৫. চিকিৎসার জন্য প্রমাণভিত্তিক জাতীয় গাইডলাইন তৈরির কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, ফলে একজন রোগী একই রোগের জন্য দুই জায়গায় দুই ধরনের চিকিৎসা পান। এই সমস্যার সমাধানে একটি জাতীয় চিকিৎসা গাইডলাইন চালু করা, যাতে দেশের সব চিকিৎসক একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য এই গাইডলাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হবে।</p> <p style="text-align:justify">৬. একটি জাতীয় বায়োব্যাংক স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশে গবেষণার সুযোগ সীমিত, যার ফলে নতুন ওষুধ ও উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন সম্ভব হয় না। একটি জাতীয় বায়োব্যাংক স্থাপন করা হলে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও সংক্রামক রোগের গবেষণা সহজ হবে, যা ভবিষ্যতে আরো উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আসবে। এতে বাংলাদেশ বিদেশের ওপর নির্ভর না করে নিজের চিকিৎসা গবেষণা এগিয়ে নিতে পারবে।</p> <p style="text-align:justify">৭. সরকারি উদ্যোগে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য প্ল্যাটফরম প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অসুস্থ হলে অনেকেই গুগল বা সামাজিক মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ খোঁজেন, যেখানে ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। এর ফলে অনেকে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পান না। এই সমস্যা সমাধানে সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত, নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্ল্যাটফরম চালু করতে সুপারিশ করা হয়েছে। এখানে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য তথ্য ও চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হবে, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন এবং কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত ও নিরাপদ। এই প্ল্যাটফরমটি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গেও যুক্ত থাকবে, যাতে রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারেন।</p>