‘পুলিশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার নির্দেশিকা-২০২২’ এর সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন ও সময়োপযোগী করে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা- ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে।
জানা যায়, পুলিশ সদস্যদের অবাধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হওয়া, স্পর্শকাতর ও গোপনীয় তথ্য প্রচার ও পাচার এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বাহিনীর সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহারের লাগাম টানতে সম্প্রতি এ নির্দেশিকা জারি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের করণীয় ও বর্জনীয় নির্ধারণ করা এবং ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে এই নির্দেশিকা জারি করা হয়।
পুলিশ সদস্যরা যেভাবে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করবেন : নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল নাগরিকসুলভ আচরণ ও অনুশাসন মেনে চলতে হবে। কনটেন্ট ও ফ্রেন্ড সিলেকশনে সতর্কতা অবলম্বন এবং অপ্রয়োজনীয় ট্যাগ, রেফারেন্স বা শেয়ারিং পরিহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার বা নিজ অ্যাকাউন্টের ক্ষতিকারক কনটেন্টের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হবেন। সেজন্য প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অ্যাকাউন্টের নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে এবং নিরাপত্তার স্বার্থে তা নিয়মিত পরিবর্তন করতে হবে।
নিজের নামে সিম না হলে ব্যবহার করা যাবে না : পুলিশ সদস্যরা নিজ নামে রেজিস্ট্রি করা সিম ছাড়া অন্য কোনো সিম ব্যবহার করতে পারবেন না। প্রচলিত আইন মেনে পুলিশ সদস্যদের সিম কিনতে হবে। হারানো বা সিম চূড়ান্তভাবে অচল ও অকার্যকর করে একই নম্বরের বা ভিন্ন নম্বরের নতুন সিম কেনা যাবে। বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা নম্বরের সিম কার্ড হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে অবশ্যই একই নম্বরের নতুন সিম তুলতে হবে।
নির্দেশিকায় আরো বলা হয়েছে, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিডিও, ছবি, অডিও এবং অন্যান্য তথ্যাদি সহজেই আদান-প্রদান করা যায় বিধায় এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেন অসাবধানতাবশত গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত তথ্যাদি অননুমোদিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর না হয়। প্রশিক্ষণ চলাকালে প্রশিক্ষণস্থলে কোনো প্রশিক্ষণার্থী মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারবেন না। সরকারি মোবাইল ফোন থেকে দাপ্তরিক যোগাযোগ ছাড়া ব্যক্তিগত কল করা যাবে না। দায়িত্বরত অবস্থায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ফোন ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হলো।
কনটেন্ট শেয়ার ও কমেন্ট নিয়ে যে নির্দেশনা : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারি অ্যাকাউন্টে প্রদত্ত কনটেন্ট কিংবা কমেন্ট অবশ্যই বাহিনী অথবা বাহিনী সংশ্লিষ্ট ইউনিটের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। নিজস্ব পোস্টে কনটেন্ট ও কমেন্ট প্রদানের ক্ষেত্রে তা যথার্থ ও নির্ভরযোগ্য হতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্পর্শকাতর কনটেন্ট ও কমেন্ট সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কনটেন্ট ও কমেন্ট প্রদানের ক্ষেত্রে সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ, প্রতিষ্ঠানের গাইডলাইন, আইনগত বাধ্যবাধকতা, গোপনীয়তা প্রভৃতি বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয়াদি সংশ্লিষ্ট কোনো কনটেন্ট দাপ্তরিক অ্যাকাউন্টে/চ্যানেলে পোস্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। দাপ্তরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কনটেন্ট আর্কাইভিং, পুনঃপ্রদর্শন ও শেয়ারিং উৎসাহিত করতে হবে।
পুলিশ সদরদপ্তর আরো জানায়, রাষ্ট্র, সরকার বা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এরূপ কোনো পোস্ট, ছবি, ভিডিও আপলোড, কমেন্ট, ট্যাগিং, রেফারেন্সিং বা শেয়ার করা যাবে না। জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থি কোনো রকম কমেন্ট করা কিংবা কনটেন্ট আপলোড করা যাবে না।
এ ছাড়া নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, পুলিশ সদস্যরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে এমন বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিপন্থি কোনো কমেন্ট বা কনটেন্ট আপলোড করতে পারবে না। রাজনৈতিক মতাদর্শ, জঙ্গি কর্মকাণ্ড অথবা ধর্মীয় উগ্রবাদ সংশ্লিষ্ট কোনো কমেন্ট বা কনটেন্ট আপলোড নিজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করতে পারবেন না পুলিশ সদস্যরা। এ ছাড়া বাংলাদেশে বসবাসকারী কোনো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক, বিদ্বেষমূলক বা হেয় প্রতিপন্নকারক কমেন্ট বা কনটেন্ট আপলোড করা যাবে না।
নির্দেশিকায় বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণামূলক কমেন্ট বা কনটেন্ট প্রদান করা যাবে না। জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো লেখা, অডিও ও ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না।
পুলিশ সদরদপ্তর জানায়, চিহ্নিত অপরাধী বা বিতর্কিত কার্যক্রমে জড়িত ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলা এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে পারবে না পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিংবা ইউনিট প্রধানের অনুমতি ছাড়া তদন্তাধীন ও বিচারাধীন বিষয়ে কোনো ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও বা তথ্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারবেন না। ভিকটিমের প্রাইভেসি বিঘ্নিত হয় এমন কোনো তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। সর্বোপরি ভিকটিমের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে, পুলিশ সদস্যরা পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরায় যথেচ্ছভাবে অপারেশনাল কার্যক্রমের ভিডিও, স্থিরচিত্র বা অডিও ধারণ করতে পারবে না। তবে অবৈধ মাদক, অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ইত্যাদি উদ্ধার এবং ক্রাইমসিনের ভিডিও বা স্থিরচিত্র ধারণ করা যেতে পারে। কোনো অবস্থাতেই কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি ছাড়া এ সকল তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড, শেয়ার বা পোস্ট করা যাবে না। গোপনীয়, গুরুত্বপূর্ণ বা কর্মকৌশলের সঙ্গে সম্পর্কিত স্পর্শকাতর স্থাপনা ও সরঞ্জামাদি সংক্রান্ত (যেমন- অস্ত্রাগার ও অস্ত্রশস্ত্র) ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও বা তথ্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না।
আরো বলা হয়েছে, অননুমোদিত কোনো ব্যক্তির সঙ্গে এ ধরনের কৌশলগত কোনো তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা যাবে না। কারণ, অসাধু ব্যক্তি কর্তৃক এ সকল স্পর্শকাতর ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও বা তথ্যাদি অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ইউনিফর্ম পরিহিত কোনো ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় অথবা সাদা পোশাক পরিধান করে টিকটক বা লাইকির মতো ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নাচ, গান, অভিনয় ইত্যাদি উপস্থাপন করা থেকে বিরত থাকতে হবে পুলিশ সদস্যদের।
অন্যদিকে, ইন্টারনেটে সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করার সময় অপ্রীতিকর কোনো কিছু সার্চ করা বা নিষিদ্ধ কোনো সাইটে প্রবেশ করা (বিশেষ করে অফিশিয়াল ডিজিটাল সরঞ্জাম ব্যবহারের মাধ্যমে), ডার্ক ওয়েভ ব্যবহার করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতে হবে বলে নতুন নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে।
নির্দেশিকা পালন হচ্ছে কি না মনিটরিং করা হবে : পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিট প্রধানরা অথবা তার মনোনীত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজ নিজ ইউনিটে কর্মরত সকল পুলিশ ও নন-পুলিশ সদস্য এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করা সদস্য কর্তৃক ‘বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০২৫’ যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে কি না তা নিয়মিতভাবে মনিটর করবেন। কোনো সদস্য এ নির্দেশনা প্রতিপালনে কোনো ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন মর্মে প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্ট ইউনিট প্রধান তথ্য-উপাত্ত যথাযথভাবে সংরক্ষণপূর্বক তাৎক্ষণিক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার নির্দেশিকা-২০২২’ এর সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন ও সময়োপযোগী করে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা- ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। তাই পুলিশ সদস্যরা যাতে ঝুঁকিতে না পড়েন তাই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। এ জন্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সব পুলিশ সদস্যকে নির্দেশিকা প্রতিপালনের অনুরোধ করা হয়েছে।