বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন এবং হুমকি দিয়েছে, যা যুদ্ধাপরাধের শামিল হতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফর্টিফাই রাইটস-এর প্রতিবেদনে এ দাবি করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১৮ মার্চ) সকাল ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদন প্রকাশকালে এ দাবি করা হয়।
‘বাংলাদেশ : রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের যুদ্ধাপরাধের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনুন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সাথে সহযোগিতা করুন’ শির্ষক সংবাদ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির পরিচালক জন কুইনলি, সিনিয়র অ্যাডভোকেসি স্পেশালিস্ট পেট্রিক ফংসাথর্ন ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাভিন মুর্শিদ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠির নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ড যুদ্ধাপরাধের আওতায় পড়ার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে। এসব অপরাধমূলক ঘটনা ও মিয়ানমারে চলমান সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট যোগসূত্র বিদ্যমান।
যুদ্ধাপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনটি অপরিহার্য উপাদান উপস্থিত থাকতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এরমধ্যে রয়েছে- এক. একটি সশস্ত্র সংঘর্ষ বিদ্যমান থাকতে হবে। দুই. একটি নিষিদ্ধ কার্যকলাপ অবশ্যই এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হতে হবে, যিনি সশস্ত্র সংঘর্ষে সক্রিয়ভাবে জড়িত নন এবং তিন. সশস্ত্র সংঘর্ষ ও সংঘটিত কার্যকলাপের মধ্যে অবশ্যই একটি যোগসূত্র থাকতে হবে। বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে সংগঠিত অপরাধগুলোতে এসব উপাদান বিদ্যমান থাকার যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি আছে। ফলে অন্ততপক্ষে চলমান যুদ্ধাপরাধের সম্ভাবনা নিয়ে আরও তদন্ত করা উচিত।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি আরসা এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘর্ষে জড়িত। তারা উভয়ই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিয়ানমার জান্তার পক্ষে লড়াই করছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তাদের সশস্ত্র অভিযান জোরদার করার জন্য তারাই বাংলাদেশে শরণার্থীদের অপহরণ করেছে এবং তাদের মিয়ানমারে যুদ্ধ করতে বাধ্য করেছে। যা যুদ্ধের আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে তদন্ত করা উচিত। সংস্থাটি আরসা ও আরএসও-এর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে এবং তাদের অপরাধের স্বীকারোক্তি নথিভুক্ত করেছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা রোহিঙ্গা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে বছরের পর বছর ধরে সহিংসতা ও হত্যার শিকার হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে মোহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে বিদ্রোহী সহিংসতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। শরণার্থী শিবিরভিত্তিক বিদ্রোহীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে সংখ্যা ২০২১ সালে ২২টি, ২০২২ সালে ৪২টি, ২০২৩ সালে ৯০টি এবং ২০২৪ সালে কমপক্ষে ৬৫টি রিপোর্ট করা হয়েছে।
জন কুইনলি বলেন, ‘রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে প্রায় সম্পূর্ণ দায়মুক্তির সঙ্গে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধ সাধারণত সশস্ত্র সংঘাতের প্রত্যক্ষ ক্ষেত্রেই সংঘটিত হয়। তবে এই ক্ষেত্রে, বাংলাদেশে সংঘটিত নির্দিষ্ট অপরাধগুলো মিয়ানমারের যুদ্ধে সরাসরি সংযুক্ত এবং যুদ্ধাপরাধের শামিল।’
তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করা উচিত।’
তিনি আরো বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা জরুরি। এর জন্য যারা দায়ী, বিশেষ করে আরসা ও আরএসও সদস্যদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। দাতা সরকারগুলোর উচিত ঝুঁকিতে থাকা শরণার্থীদের সহায়তায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করা। যার মধ্যে রয়েছে সুরক্ষিত স্থান, চলাচলের স্বাধীনতা এবং তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের জন্য আরো বিকল্প প্রদান।’
শরণার্থী শিবিরে চলমান সহিংসতা নিয়ে ১১৬ জনের সাক্ষাতকার নিয়ে ৭৭ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের উপর অমানবিক নির্যাতন, হুমিকি ও ভয় ভীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রোহিঙ্গা নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী থেকে রক্ষা করতে ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বহু বছর ধরে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের অস্তিত্ব ও কার্যক্রমের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এর ফলে ভুক্তভোগী শরাণার্থী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের সুযোগ ও যথাযথ প্রতিক্রিয়ার অভাব দেখা দেয়।’
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সাম্প্রতিক মার্কিন সরকারি তহবিল কাটছাঁটের ফলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের জন্য আরও বেশি সুযোগ তৈরি হচ্ছে। যা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে আরও খারাপ করবে। এছাড়াও রোহিঙ্গা শিবিরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় এবং বাংলাদেশে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ রোধে বেশ কিছু প্রতিকার উল্লেখ করা হয়।