প্রতি মিনিট কল বা প্রতি জিবি (GB) ডাটা চার্জের ব্যাপারটাই অনেক উন্নত দেশে আর নেই। উন্নত দেশে অপারেটররা মাসিক বিলের ভিত্তিতে আনলিমিটেড (with Fair Usage Policy) কল বা ডাটা ভলিউম দিয়ে থাকে। আমাদের মত দেশগুলোতে মাসিক আনলিমিটেড প্যাকেজের পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদের বিভিন্ন মিনিট বা জিবি বান্ডল’ড প্যাকেজ বেশি জনপ্রিয়। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ মাসিক বিল ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ সেবা গ্রহণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। এখানে পিরামিডের নীচের দিকের স্বল্প আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি।
দিন ভিত্তিক বা অস্থায়ী/অনিয়মিত আয় করেন, এমন মানুষের পক্ষে মাসিক বিল ভিত্তিক সেবা ক্রয় সম্ভব নয়। ফলে স্বল্প মেয়াদের, স্বল্প ব্যয়ের, প্যাকেজগুলোর গ্রাহকের সংখ্যাই তাদের মাঝে বেশি। ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকার মাসিক প্যাকেজ থাকা স্বত্বেও অপারেটরদের এভারেজ রেভিনিউ পার ইউজার (ARPU) বর্তমানে মাত্র ১৪৫ টাকা। বর্তমানে বাজারে ভয়েস কল প্যাকেজ সর্বনিম্ন প্রায় ৮ টাকা এবং ডাটা প্যাকেজ সর্বনিম্ন প্রায় ২৮ টাকা দিয়ে শুরু হয়েছে। এতে বোঝা যায়, দামি প্যাকেজে প্রতি ইউনিটের দাম কম পড়লেও ক্রয় ক্ষমতার স্বল্পতায় প্রতি ইউনিট বেশী দামে, স্বল্প ব্যয়ের ছোট-ছোট প্যাকেজ ক্রয়ে আগ্রহী গ্রাহকের সংখ্যাই বেশী।
ভয়েস কলের মূল্য
বিভিন্ন সময়ে দেওয়া নির্দেশিকাসমূহকে একত্রিত করে ২০১৫ সালে বিটিআরসি বিভিন্ন অপারেটরের কলের মূল্য সংক্রান্ত একটি ট্যারিফ গাইডলাইন প্রকাশ করে। সেখানে মোবাইল কলের চার্জ অন-নেটে (যেমন GP-GP) প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২ টাকা এবং অফ-নেটে(যেমন GP-Robi) প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অপারেটরদেরকে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন কল চার্জের মধ্যে রেখে কল প্যাকেজ তৈরি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে বিটিআরসি প্রতি মিনিট কল চার্জ সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে অন-নেট ও অফনেট উভয় ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন ৪৫পয়সা নির্ধারণ করে।
জাতীয় রাজস্ব বিভাগ এই খাতের গ্রাহকের কাছ থেকে সরাসরি ভোক্তাকর আদায় করে থাকে। সর্বনিম্ন মূল্য ৪৫ পয়সার সাথে সময়ে সময়েমূল্য সংযোজন কর (VAT-১৫%), সম্পূরক শুল্ক (SD-২০%), সারচার্জ(SC-১%) মোট যা প্রায় ৩৯% ((১০০+২০)*১.১৫+১) যুক্ত হয়। অর্থাৎ ১৩৯ টাকা গ্রাহক অপারেটরকে দিলে ১০০ টাকার কথা বলতে পারে আর ৩৯ টাকা সরাসরি সরকারের কোষাগারে যায়। গ্রাহক পর্যায়ে সর্বনিম্ন প্রায় ৬৩ পয়সা প্রতি মিনিট কলের খরচ পড়ে।প্যাকেজ ভেদে বিভিন্ন অফারে ৬৪ পয়সা থেকে ৮০ পয়সা মিনিটে গ্রাহককে কল চার্জ দিতে হচ্ছে। মোবাইল অপারেটরদেরকে বার্ষিক মোট রাজস্বের উপর ৫.৫% এবং ১% সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (SOF) বাবদ বিটিআরসিকে দিতে হয়। এছাড়াও মোবাইল অপারেটরদের ৪০-৪৫% কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয়।
ভয়েস কলের জন্য এই উচ্চমূল্য সমাজের কোন শ্রেণির লোকজন বেশি দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিটিআরসি তথ্য অনুযায়ী স্মার্ট ফোন গ্রাহক প্রায় ৫৫%। কিন্তু একজন গ্রাহকের একাধিক সিম (SIM) বিবেচনা করলে দেশে স্মার্ট ফোন পেনিট্রেশন কমে প্রায় ৪৫% হবে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করে। এই৪৫% জনগোষ্ঠী স্মার্টফোনে ফিক্সড বা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে এ্যাপ-টু-এ্যাপ ফ্রি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। অবশিষ্ট প্রায় ৫৫% গ্রাহক বাটনফোন ব্যবহার করছে। স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্যনেই, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত সমাজের একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনই বাটনফোন ব্যবহার করে। এই বাটনফোন ব্যবহারকারীরা যখন কাউকে কল করে অথবা তাদেরকে যখন কেউ কল করে তখন গ্রাহককে এই উচ্চমূল্যের প্রতি মিনিট কলচার্জ দিতে হচ্ছে। সুতরাং সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্চ করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
ফলে বাজারে অধিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টির সুযোগ থাকলেও সর্বনিম্ন মূল্য উচ্চহার নির্ধারণ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর উচ্চমূল্যের ভয়েস কল এবং ভোক্তা পর্যায়ে করের বোঝা চাপানো হয়েছে। অতিসত্বর এই সর্বনিম্নকল রেট পুনর্বিবেচনা করে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সর্বনিম্ন কল রেট কমিয়ে আনা বা তুলে দেয়া যেতে পারে। ভোক্তা পর্যায়ে করের হার এবং অপারেটরের রাজস্ব শেয়ার কমিয়েও কল চার্জ কমানোর সুযোগ রয়েছে।যথাযথ কস্ট মডেলিং করে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বের মধ্যে পরে।
ইন্টারনেটের মূল্য
আমরা সাধারণত দুইভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি। মোবাইল ইন্টারনেট এবং ফিক্সড ইন্টারনেট। মোবাইল অপারেটররা মোবাইল ইন্টারনেট সেবা দেয় আর আইএসপিরা বাসাবাড়িতে, অফিসে ফিক্সড ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। অনেকে ফিক্সড ইন্টারনেটকে ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই ইন্টারনেট বলে থাকে। যদিও এখন ফোরজি টেকনোলজিতে অপারেটররাও মোবাইল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দিয়ে থাকে।
মোবাইল এবং ফিক্সড এই দুই ধরনের ইন্টারনেটের বিল দুইভাবেনির্ধারণ করা হয়ে থাকে। মোবাইল ইন্টারনেট আমরা ডাটার পরিমাণ প্রতি এমবি (MB) বা প্রতি জিবি(GB) তে বিল দেই। অর্থাৎ স্পিড যাইহোক না কেন, আমরা যতটুকু ডাটা ব্যবহার করি ততটুকুই বিল দেই।যদিও ইদানিং অনেক দামি প্যাকেজে মাসিক আনলিমিটেড বা লিমিটলেস ডাটা ভলিউম দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে ফিক্সড ইন্টারনেটে আমরা স্পিড বা ডাটা যাওয়া আসার পাইপের সাইজ (এমবিপিএস বা জিবিপিএস) অনুযায়ী মাসিক হারে বিল দিয়ে থাকি। কোন ডাটা ভলিউম ক্যাপ বা ফেয়ার ইউজেজ পলিসি(FUP) নেই। অন্যান্য অনেক দেশে ফিক্সড ইন্টারনেটেও একটা ডাটাক্যাপ ছিল বা এখনও আছে। আনলিমিটেড প্যাকেজ হলেও FUP দিয়েতারা একটা ডাটা ভলিউম ক্যাপ দিয়ে থাকে।
মোবাইল ইন্টারনেট
বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্যের আলোচনায় যাওয়ার আগে দুনিয়ার অন্যান্য দেশে কি হচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ২০২৩ সালে ২৩৭ টি দেশের প্রায় ৬৫০০ মোবাইল ডাটা প্যাকেজের উপাত্তের ভিত্তিতে www.cable.co.uk সাইটে একটা জরিপ প্রকাশিত হয়। সেই জরিপে দুনিয়াজুড়ে প্রতি জিবি (GB) ডাটার একটা তুলনা করা হয়। প্রতি জিবি ডাটার গ্লোবাল এভারেজ মূল্য ৩০৯.৬০ টাকা। সর্বোচ্চ মূল্য সলোমন আইল্যান্ডে ৫০৭৬ টাকা এবং সর্বনিম্ন ইসরাইলে ২.৪০ টাকা। এশিয়ায় সর্বনিম্ন পাকিস্তানে ১৪.৪০ টাকা এবং ভারতে ১৯.২০ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি জিবি ডাটার গড় মূল্য প্রায় ২৪.০০ টাকার মত। যদি মোবাইল ইন্টারনেট মার্কেটের দিকে নজর দেই, সেখানেও ভয়েসের মত ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি প্রায় ৩৯% রাজস্ব আদায় করা হয়। ২০২৪ এর বাজেটে ভয়েস ও ডাটাসহ সকল মোবাইল সেবার ভ্যাট ১৫ % করা হয়েছে যেখানে আগে ডাটা তথা ইন্টারনেটের ভোক্তা পর্যায়ে ভ্যাট ছিল মাত্র ৫%। অর্থাৎ এখানেও ১৩৯ টাকার ডাটা কিনলে ভয়েসের মত ৩৯ টাকা সরাসরি ভোক্তা রাজস্বে চলে যায়, শুধু ১০০ টাকা গ্রাহক ব্যবহার করে। মোবাইল অপারেটররা ১, ৩, ৭ ও ৩০ দিনের মেয়াদে ৫০০ MB থেকে আনলিমিটেড বা লিমিটলেস ডাটা সাইজের সেবা দিয়ে থাকে।
বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদ এবং ডাটা ভলিউমের সমন্বয়ে অপারেটররা প্রায় ৪০টি পর্যন্ত প্যাকেজ করে থাকে । ২০২৩ সালের শেষের দিকে একবার মেয়াদ কমিয়ে ৭ ও ৩০ দিনের নির্ধারণ করা হয়েছিল।কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের পর্যবেক্ষণ ছিল স্বল্প মেয়াদের স্বল্প ডাটা ভলিউমের নীচের দিকের প্যাকেজের চাহিদা খুব বেশী। বাংলাদেশের অপারেটরদের প্যাকেজগুলোতে গড় মূল্য প্রতি জিবি ২৪ টাকা হলেও আনলিমিটেড বা লিমিটলেস প্যাকেজ বাদ দিলে প্রতি জিবির মূল্য সর্বনিম্ন প্রায় ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫০ টাকা পর্যন্তও প্যাকেজ আছে।
বেশি ভলিউম বা লম্বা কমিটমেন্টে কোন পণ্য বা সেবা কিনলে সেই সেবার প্রতি ইউনিটের দাম ভলিউম বা মেয়াদ বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে। ১ লিটার শ্যাম্পু কিনলে প্রতি এমএল এর দাম যা পড়বে ২০এমএল এর মিনিপ্যাক কিনলে প্রতি এমএল এর দাম কয়েকগুন বেশী পড়বে। তাহলে কি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান শুধু বড় বড় প্যাকেজ রাখবে? সকল স্তরের গ্রাহক কি তা কেনার সক্ষমতা রয়েছে? গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় দেখা যায় স্বল্প আয়ের একটা বড় সংখ্যক গ্রাহকের বড় ভলিউমের প্যাকেজ কেনার সামর্থ্য নেই। সুতরাং স্বল্প আয়ের লোকজন স্বল্প মেয়াদের স্বল্প ভলিউম কেনায় তাদের প্রতি ইউনিটের চার্জ অনেক অনেক বেশী পড়ছে।
মোবাইল ভয়েস কলের মত মোবাইল ইন্টারনেটকেও স্বল্প আয়ের জনগনের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনে জনপ্রিয় করার জন্য দাম কমাতে হবে। ভোক্তার উপর সরাসরি কর এবং বিভিন্ন পর্যায়ে রাজস্ব ভাগাভাগি এবং সেবাদানকারীর উপর উচ্চ করের চাপ কমাতে হবে।
ফিক্সড ইন্টারনেট
এশিয়ায় বিভিন্ন অপারেটরের ফিক্সড ইন্টারনেট প্যাকেজ তুলনা করলে দেখা যায় দক্ষিন এশিয়াতে তুলনামূলক ফিক্সড ইন্টারনেটের দাম সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে ৩০ এমবিপিএস এর প্যাকেজ আবাসিক সংযোগের জন্য জনপ্রিয় একটি প্যাকেজ। দক্ষিন-এশিয়ার কয়েকটা দেশের টেলিযোগাযোগ কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় , ভারতের ৩০ এমবিপিএস প্যাকেজের মূল্য প্রতিমাসে প্রায় ১০০০-১২০০ টাকা, পাকিস্তানে প্রায় ১৭০০ টাকা এবং শ্রীলংকায় প্রায় ২০০০ টাকা। বাংলাদেশে ৩০ এমবিপিএস প্যাকেজের দাম প্রায় ১২০০ টাকা। এই প্যাকেজেও ভোক্তা পর্যায়ে ৫% ভ্যাট সংযোজিত আছে। বাসাবাড়ীতে ১২০০ টাকা দিয়ে পরিবারের সকল সদস্য দিনরাত ২৪ ঘন্টা টিভি, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনে ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে কত পরিমাণ ডাটা (GB) ব্যবহার করছে তার কোন হিসাব কেউ করেছে বলে মনে হয় না। সুতরাং বিষয়টি পরিষ্কার যে, ফিক্সড ইন্টারনেটের খরচ মোবাইল ইন্টারনেটের তুলনায় অতি নগণ্য।
পাড়ার ডিশ টিভি সেবাদানকারীকে আমরা মাসে তিনশ’ টাকা দিয়ে অভ্যস্ত। বাসাবাড়ির কোনও সেবার দাম তিনশ’ টাকার বেশী হলেই পারিবারিক মাসিক খরচের উপর একটা বাড়তি চাপ পড়ে বলে মনে করা হয়। একসময় আইএসপিদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ইন্টারনেটও মাসিক তিনশ’ টাকা খরচে পাওয়া যেত। কিন্তু ২০২১ সালে বিটিআরসি “এক রেট এক দেশ” করার পর থেকে সর্বনিম্ন ৫ এমবিপিএস-এর প্যাকেজ করা হয়েছে পাঁচশ’ টাকা। কিন্তু ৫ এমবিপিএস এর সাথে আইএসপিরা ৩০ এমবিপিএস ইউটিউব, ১৫ এমবিপিএস ফেসবুক ইত্যাদি কন্টেন্ট যোগ করে দিচ্ছে। ইন্টারনেট কন্টেন্টকে ভাগ করলে দেখা যায় ৬০-৭০% কন্টেন্টই ইউটিউব, ফেসবুক এবং কিছু গেমস বাকিটা ইন্টারনেট।
ভলিউম ভিত্তিক মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ ক্রয়ক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশী হওয়ায় সারা বাংলাদেশে ঘরে ঘরে ফিক্সড ইন্টারনেটের চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। শহর ছাপিয়ে এখন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইএসপিদের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
বাসাবাড়ির ফিক্সড ইন্টারনেট স্বল্প মূল্যে সস্তা হলেও গুণগত মান নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। আমাদের বাসাবাড়িতে অন্যান্য ইউটিলিটি যেমন পানি, গ্যাস এবং ইলেকট্রিসিটি আন্ডারগ্রাউন্ড বা ওভারহেড স্ট্রাকচারড সিস্টেমে ঢুকলেও ইন্টারনেটের ক্যাবল ঝুলন্ত বেহাল অবস্থা। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মেট্রোর বেশিরভাগ আইএসপি যারা বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে তাদের নেটওয়ার্ক একটা এলাকা পর্যন্ত(Point of Presence) আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার ক্যাবলে যায়। তারপর রাস্তার পাশে বিভিন্ন পোলে ঝুলন্ত তারের মাধ্যমে ওভারহেড ফাইবার ক্যাবলে বাসাবাড়িতে সংযোগ দেয়া হয়। ঢাকার বাহিরে বেশিরভাগ শহরে ওভারহেড ক্যাবলই একমাত্র ভরসা। এই ঝুলন্ত তার প্রায়ই কাটা পড়ে বা অকেজো হয়ে যায়। ফলে ইন্টারনেট সেবা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।এছাড়াও ছোট ছোট আইএসপিদের ব্যান্ডউইথ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রায় ২৭০০ লাইসেন্সধারী আইএসপি রয়েছে। ফলে গ্রাহককে ভালো সেবা দিয়ে ধরে রাখার জন্য এই অপারেটরগুলোর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা বিরাজমান। সুতরাং নিরবচ্ছিন্ন ফিক্সড ইন্টারনেট সেবা দামে সস্তা এবং এখানে একটা যথাযথ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র রয়েছে। ফিক্সড ইন্টারনেটের গুণগত মান আরও বৃদ্ধি করার জন্য সস্তায় আরও বড় ব্যান্ডউইথের প্যাকেজ বাজারে নিয়ে আসতে হবে। ওভারহেড নেটওয়ার্ক কীভাবে আরও সুশৃঙ্খল করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ পোলের উপর দিয়ে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির সাথে ভাড়া দেয়ার চুক্তি করা যেতে পারে যাতে স্ট্রাকচারড নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায়।
আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার নেটওয়ার্ক আরও বিস্তৃত করতে হবে। ঢাকামেট্রোসহ বড় শহরগুলোর সব বিল্ডিং না হলেও বড় বড় বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনগুলোকে আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবারের আওতায় আনতে হবে। ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি বা ব্যান্ডউই্ডথের দাম আরও কমাতে হবে।মেট্রো এবং লং ডিসট্যান্স ট্রান্সমিশনের দাম প্রতি এমবিপিএস থেকে পরিবর্তন করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট FE (100 mbps), GE (1000 Mbps), 10Gig (10,000 Mbps) এবং 100Gig করলে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।
ইলন মাস্কের ষ্টারলিংক বাংলাদেশে আসলে হয়তো বাসাবাড়িতেও ডিটিএইচ স্যাটেলাইট টিভির (যেমন আকাশ) মত ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। তবে ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের খরচ অনেক বেশি হওয়ার কথা। দূরবর্তী স্থানে, যেখানে কোন নেটওয়ার্ক নেই, সেখানে কর্পোরেট সংযোগের জন্য হয়তো ফিজিবল হবে। কিন্তু বি-টু-সি (B2C) সেগমেন্টে অদূর ভবিষ্যতে কম খরচে স্যাটেলাইট ব্যান্ডউইথ জনপ্রিয় করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে বাজার বিশ্লেষণ করে যদি তারা জনগণের জন্য খরচ কমিয়ে আনতে পারে তাহলে হয়তো তাদের ইন্টারনেট সেবা জনপ্রিয় হতে পারে।
জাতিসংঘ ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করেছে।বাংলাদেশেও অন্যান্য সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের সাথে ইন্টারনেটকেও মৌলিক অধিকার ঘোষণার দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘরে ঘরে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সহজলভ্য স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের অধিকতর প্রসার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিঃসন্দেহে অপরিসীম ভূমিকা রাখবে।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইন্টারক্লাউড লিমিটেড