ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবার যৌক্তিক মূল্য

মো. হাসিবুর রশিদ
মো. হাসিবুর রশিদ
শেয়ার
ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবার যৌক্তিক মূল্য
সংগৃহীত ছবি

বর্তমান বিশ্বে জীবনের অন্যতম মুখ্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে প্রযুক্তি। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রযুক্তির দ্বারা পুরো পৃথিবীটা এখন সবার হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। ব্যক্তিগত জীবনে প্রযুক্তি ব্যবহারের চাহিদা বেড়েই চলেছে।

দেশের  সব শ্রেণীর পেশার মানুষ এখন ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং গ্রাহকের জন্য ইন্টারনেট সেবার সঠিক ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা সময়ের দাবি। 

অন্যান্য ইউটিলিটি সেবার মতো টেলিযোগাযোগ খাতও একটা সময় পর্যন্ত একটি ন্যাচারাল মনোপলি খাত ছিল। আশির দশকে দেশে শুধু একক সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিযোগাযোগ খাতে সেবা প্রদান করতো।

টেলিযোগাযোগ খাতে দ্রুত নতুন নতুন টেকনোলজি আসার কারণে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ব্যক্তি খাত ও বাজার উদারীকরণ করে। 

টেলিযোগাযোগ আইন-২০০১-এর মাধ্যমে এই খাতকে ২০০১ সাল থেকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দিয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে। সুতরাং এই খাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও প্রতিযোগিতা কমিশন সার্বক্ষণিক বাজার পর্যালোচনা করার কথা। বাজারে যথেষ্ট প্রতিযোগিতা থাকলে এবং গ্রাহক সঠিক মূল্য ও গুণগতমানের কাঙ্ক্ষিত পণ্য বা সেবা পেলে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আর মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হয় না।

যেকোনো সেবা বা পণ্যের মূল্যের বিষয়টি সার্বিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে চাহিদা-জোগান ও ক্রেতা-বিক্রেতার মিথস্ক্রিয়ায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার উদ্দেশ্যই হওয়া উচিত টেলিকম অপারেটরদের উৎসাহিত করে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবনীর মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যের নতুন নতুন সেবা বাজারে নিয়ে আসা। বিভিন্ন মানের একই সেবা বাজারে থাকলে গ্রাহক ক্রয়ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে তার পছন্দের সেবাটি গ্রহণ করতে পারে। বর্তমানে অপারেটররা বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের টেলিযোগযোগ সেবা দিয়ে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভয়েস কল এবং ইন্টারনেট বা ডাটা সেবা।

প্রতি মিনিট কল বা প্রতি জিবি (GB) ডাটা চার্জের ব্যাপারটাই অনেক উন্নত দেশে আর নেই। উন্নত দেশে অপারেটররা মাসিক বিলের ভিত্তিতে আনলিমিটেড (with Fair Usage Policy) কল বা ডাটা ভলিউম দিয়ে থাকে। আমাদের মত দেশগুলোতে মাসিক আনলিমিটেড প্যাকেজের পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদের বিভিন্ন মিনিট বা জিবি বান্ডল’ড প্যাকেজ বেশি জনপ্রিয়। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ মাসিক বিল ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ সেবা গ্রহণের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন। এখানে পিরামিডের নীচের দিকের স্বল্প আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি। 

দিন ভিত্তিক বা অস্থায়ী/অনিয়মিত আয় করেন, এমন মানুষের পক্ষে মাসিক বিল ভিত্তিক সেবা ক্রয় সম্ভব নয়। ফলে স্বল্প মেয়াদের, স্বল্প ব্যয়ের, প্যাকেজগুলোর গ্রাহকের সংখ্যাই  তাদের মাঝে বেশি। ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকার মাসিক প্যাকেজ থাকা স্বত্বেও অপারেটরদের এভারেজ রেভিনিউ পার ইউজার (ARPU) বর্তমানে মাত্র ১৪৫ টাকা। বর্তমানে বাজারে ভয়েস কল প্যাকেজ সর্বনিম্ন প্রায় ৮ টাকা এবং ডাটা প্যাকেজ সর্বনিম্ন প্রায় ২৮ টাকা দিয়ে শুরু হয়েছে। এতে বোঝা যায়, দামি প্যাকেজে প্রতি ইউনিটের দাম কম পড়লেও ক্রয় ক্ষমতার স্বল্পতায় প্রতি ইউনিট বেশী দামে, স্বল্প ব্যয়ের ছোট-ছোট প্যাকেজ ক্রয়ে আগ্রহী গ্রাহকের সংখ্যাই বেশী।

ভয়েস কলের মূল্য

বিভিন্ন সময়ে দেওয়া নির্দেশিকাসমূহকে একত্রিত করে ২০১৫ সালে বিটিআরসি বিভিন্ন অপারেটরের কলের মূল্য সংক্রান্ত একটি ট্যারিফ গাইডলাইন প্রকাশ করে। সেখানে মোবাইল কলের চার্জ অন-নেটে (যেমন GP-GP) প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২ টাকা এবং অফ-নেটে(যেমন GP-Robi) প্রতি মিনিট সর্বনিম্ন ৬০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ২ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অপারেটরদেরকে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন কল চার্জের মধ্যে রেখে কল প্যাকেজ তৈরি করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে বিটিআরসি  প্রতি মিনিট কল চার্জ সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে অন-নেট ও অফনেট উভয় ক্ষেত্রেই সর্বনিম্ন ৪৫পয়সা নির্ধারণ করে। 

জাতীয় রাজস্ব বিভাগ এই খাতের গ্রাহকের কাছ থেকে সরাসরি ভোক্তাকর আদায় করে থাকে। সর্বনিম্ন মূল্য ৪৫ পয়সার সাথে সময়ে সময়েমূল্য সংযোজন কর (VAT-১৫%), সম্পূরক শুল্ক (SD-২০%), সারচার্জ(SC-১%) মোট যা প্রায় ৩৯% ((১০০+২০)*১.১৫+১)  যুক্ত হয়। অর্থাৎ ১৩৯ টাকা গ্রাহক অপারেটরকে দিলে ১০০ টাকার কথা বলতে পারে আর ৩৯ টাকা সরাসরি সরকারের কোষাগারে যায়। গ্রাহক পর্যায়ে সর্বনিম্ন প্রায় ৬৩ পয়সা প্রতি মিনিট কলের খরচ পড়ে।প্যাকেজ ভেদে বিভিন্ন অফারে ৬৪ পয়সা থেকে ৮০ পয়সা মিনিটে গ্রাহককে কল চার্জ দিতে হচ্ছে। মোবাইল অপারেটরদেরকে বার্ষিক মোট রাজস্বের উপর ৫.৫%  এবং ১% সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (SOF) বাবদ বিটিআরসিকে দিতে হয়। এছাড়াও মোবাইল অপারেটরদের ৪০-৪৫% কর্পোরেট ট্যাক্স দিতে হয়।

ভয়েস কলের জন্য এই উচ্চমূল্য সমাজের কোন শ্রেণির লোকজন বেশি দিচ্ছে তা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিটিআরসি তথ্য অনুযায়ী স্মার্ট ফোন গ্রাহক প্রায় ৫৫%। কিন্তু একজন গ্রাহকের একাধিক সিম (SIM) বিবেচনা করলে দেশে স্মার্ট ফোন পেনিট্রেশন কমে প্রায় ৪৫% হবে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করে। এই৪৫% জনগোষ্ঠী স্মার্টফোনে ফিক্সড বা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে দেশে-বিদেশে এ্যাপ-টু-এ্যাপ ফ্রি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। অবশিষ্ট প্রায় ৫৫% গ্রাহক বাটনফোন ব্যবহার করছে। স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্যনেই, শিক্ষাদীক্ষায় পিছিয়ে পড়া এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত সমাজের একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর লোকজনই বাটনফোন ব্যবহার করে। এই বাটনফোন ব্যবহারকারীরা যখন কাউকে কল করে অথবা তাদেরকে যখন কেউ কল করে তখন গ্রাহককে এই উচ্চমূল্যের প্রতি মিনিট কলচার্জ দিতে হচ্ছে। সুতরাং সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উচ্চ করের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।

ফলে বাজারে অধিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টির সুযোগ থাকলেও সর্বনিম্ন মূল্য উচ্চহার নির্ধারণ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপর উচ্চমূল্যের ভয়েস কল এবং ভোক্তা পর্যায়ে করের বোঝা চাপানো হয়েছে। অতিসত্বর এই সর্বনিম্নকল রেট পুনর্বিবেচনা করে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সর্বনিম্ন কল রেট কমিয়ে আনা বা তুলে দেয়া যেতে পারে। ভোক্তা পর্যায়ে করের হার এবং অপারেটরের রাজস্ব শেয়ার কমিয়েও কল চার্জ কমানোর সুযোগ রয়েছে।যথাযথ কস্ট মডেলিং করে সঠিক মূল্য নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্বের মধ্যে পরে। 

ইন্টারনেটের মূল্য

আমরা সাধারণত দুইভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকি। মোবাইল ইন্টারনেট এবং ফিক্সড ইন্টারনেট। মোবাইল অপারেটররা মোবাইল ইন্টারনেট সেবা দেয় আর আইএসপিরা বাসাবাড়িতে, অফিসে ফিক্সড ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। অনেকে ফিক্সড ইন্টারনেটকে ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই ইন্টারনেট বলে থাকে। যদিও এখন ফোরজি টেকনোলজিতে অপারেটররাও মোবাইল ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট দিয়ে থাকে। 

মোবাইল এবং ফিক্সড এই দুই ধরনের ইন্টারনেটের বিল দুইভাবেনির্ধারণ করা হয়ে থাকে। মোবাইল ইন্টারনেট আমরা ডাটার পরিমাণ প্রতি এমবি (MB) বা প্রতি জিবি(GB) তে বিল দেই। অর্থাৎ স্পিড যাইহোক না কেন, আমরা যতটুকু ডাটা ব্যবহার করি ততটুকুই বিল দেই।যদিও ইদানিং অনেক দামি প্যাকেজে মাসিক আনলিমিটেড বা লিমিটলেস ডাটা ভলিউম দেয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে ফিক্সড ইন্টারনেটে আমরা স্পিড বা ডাটা যাওয়া আসার পাইপের সাইজ (এমবিপিএস বা জিবিপিএস) অনুযায়ী মাসিক হারে বিল দিয়ে থাকি। কোন ডাটা ভলিউম ক্যাপ বা ফেয়ার ইউজেজ পলিসি(FUP) নেই। অন্যান্য অনেক দেশে ফিক্সড ইন্টারনেটেও একটা ডাটাক্যাপ ছিল বা এখনও আছে। আনলিমিটেড প্যাকেজ হলেও FUP দিয়েতারা একটা ডাটা ভলিউম ক্যাপ দিয়ে থাকে।

মোবাইল ইন্টারনেট

বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেটের মূল্যের আলোচনায় যাওয়ার আগে দুনিয়ার অন্যান্য দেশে কি হচ্ছে তা একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে। ২০২৩ সালে ২৩৭ টি দেশের প্রায় ৬৫০০ মোবাইল ডাটা প্যাকেজের উপাত্তের ভিত্তিতে www.cable.co.uk সাইটে একটা জরিপ প্রকাশিত হয়। সেই জরিপে দুনিয়াজুড়ে প্রতি জিবি (GB) ডাটার একটা তুলনা করা হয়। প্রতি জিবি ডাটার গ্লোবাল এভারেজ মূল্য ৩০৯.৬০ টাকা। সর্বোচ্চ মূল্য সলোমন আইল্যান্ডে ৫০৭৬ টাকা এবং সর্বনিম্ন ইসরাইলে ২.৪০ টাকা। এশিয়ায় সর্বনিম্ন পাকিস্তানে ১৪.৪০ টাকা এবং ভারতে ১৯.২০ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি জিবি ডাটার গড় মূল্য প্রায় ২৪.০০ টাকার মত। যদি মোবাইল ইন্টারনেট মার্কেটের দিকে নজর দেই, সেখানেও ভয়েসের মত ভোক্তা পর্যায়ে সরাসরি প্রায় ৩৯% রাজস্ব আদায় করা হয়। ২০২৪ এর বাজেটে ভয়েস ও ডাটাসহ সকল মোবাইল সেবার ভ্যাট  ১৫ % করা হয়েছে যেখানে আগে ডাটা তথা ইন্টারনেটের ভোক্তা পর্যায়ে  ভ্যাট  ছিল মাত্র ৫%। অর্থাৎ এখানেও ১৩৯ টাকার ডাটা কিনলে ভয়েসের মত ৩৯ টাকা সরাসরি ভোক্তা রাজস্বে চলে যায়, শুধু ১০০ টাকা গ্রাহক ব্যবহার  করে। মোবাইল অপারেটররা  ১, ৩, ৭ ও ৩০ দিনের মেয়াদে ৫০০ MB থেকে আনলিমিটেড বা লিমিটলেস ডাটা সাইজের সেবা দিয়ে থাকে।

বর্তমানে বিভিন্ন মেয়াদ এবং ডাটা ভলিউমের সমন্বয়ে অপারেটররা প্রায় ৪০টি পর্যন্ত প্যাকেজ করে থাকে । ২০২৩ সালের শেষের দিকে একবার মেয়াদ কমিয়ে ৭ ও ৩০ দিনের নির্ধারণ করা হয়েছিল।কিন্তু মোবাইল অপারেটরদের পর্যবেক্ষণ ছিল স্বল্প মেয়াদের স্বল্প ডাটা ভলিউমের নীচের দিকের প্যাকেজের চাহিদা খুব বেশী। বাংলাদেশের অপারেটরদের প্যাকেজগুলোতে গড় মূল্য প্রতি জিবি ২৪ টাকা হলেও আনলিমিটেড বা লিমিটলেস প্যাকেজ বাদ দিলে প্রতি জিবির মূল্য সর্বনিম্ন প্রায় ৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৫০ টাকা পর্যন্তও প্যাকেজ আছে।

বেশি ভলিউম বা লম্বা কমিটমেন্টে কোন পণ্য বা সেবা কিনলে সেই সেবার প্রতি ইউনিটের দাম ভলিউম বা মেয়াদ বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে। ১ লিটার শ্যাম্পু কিনলে প্রতি এমএল এর দাম যা পড়বে ২০এমএল এর মিনিপ্যাক কিনলে প্রতি এমএল এর দাম কয়েকগুন বেশী পড়বে। তাহলে কি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান শুধু বড় বড় প্যাকেজ রাখবে? সকল স্তরের গ্রাহক কি তা কেনার সক্ষমতা রয়েছে? গ্রাহকের ক্রয় ক্ষমতা বিবেচনায় দেখা যায় স্বল্প আয়ের একটা বড় সংখ্যক গ্রাহকের বড় ভলিউমের প্যাকেজ কেনার সামর্থ্য নেই। সুতরাং স্বল্প আয়ের লোকজন স্বল্প মেয়াদের স্বল্প ভলিউম কেনায় তাদের প্রতি ইউনিটের চার্জ অনেক অনেক বেশী পড়ছে।

মোবাইল ভয়েস কলের মত মোবাইল ইন্টারনেটকেও স্বল্প আয়ের জনগনের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এনে জনপ্রিয় করার জন্য দাম কমাতে হবে। ভোক্তার উপর সরাসরি কর এবং বিভিন্ন পর্যায়ে রাজস্ব ভাগাভাগি এবং সেবাদানকারীর উপর উচ্চ করের চাপ কমাতে হবে।


ফিক্সড ইন্টারনেট

এশিয়ায় বিভিন্ন অপারেটরের ফিক্সড ইন্টারনেট প্যাকেজ তুলনা করলে দেখা যায় দক্ষিন এশিয়াতে তুলনামূলক ফিক্সড ইন্টারনেটের দাম সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে ৩০ এমবিপিএস এর প্যাকেজ আবাসিক সংযোগের জন্য জনপ্রিয় একটি প্যাকেজ। দক্ষিন-এশিয়ার কয়েকটা দেশের টেলিযোগাযোগ কোম্পানির ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় , ভারতের ৩০ এমবিপিএস প্যাকেজের মূল্য প্রতিমাসে প্রায় ১০০০-১২০০ টাকা, পাকিস্তানে প্রায় ১৭০০ টাকা এবং শ্রীলংকায় প্রায় ২০০০ টাকা। বাংলাদেশে ৩০ এমবিপিএস প্যাকেজের দাম প্রায় ১২০০ টাকা। এই প্যাকেজেও ভোক্তা পর্যায়ে ৫% ভ্যাট সংযোজিত আছে। বাসাবাড়ীতে ১২০০ টাকা দিয়ে পরিবারের সকল সদস্য দিনরাত ২৪ ঘন্টা টিভি, ল্যাপটপ ও স্মার্টফোনে ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে কত পরিমাণ ডাটা (GB) ব্যবহার করছে তার কোন হিসাব কেউ করেছে বলে মনে হয় না। সুতরাং বিষয়টি পরিষ্কার যে, ফিক্সড ইন্টারনেটের খরচ মোবাইল ইন্টারনেটের তুলনায় অতি নগণ্য।

পাড়ার ডিশ টিভি সেবাদানকারীকে আমরা মাসে তিনশ’ টাকা দিয়ে অভ্যস্ত। বাসাবাড়ির কোনও সেবার দাম তিনশ’ টাকার বেশী হলেই পারিবারিক মাসিক খরচের উপর একটা বাড়তি চাপ পড়ে বলে মনে করা হয়। একসময় আইএসপিদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় ইন্টারনেটও মাসিক তিনশ’ টাকা খরচে পাওয়া যেত। কিন্তু ২০২১ সালে বিটিআরসি “এক রেট এক দেশ” করার পর থেকে সর্বনিম্ন ৫ এমবিপিএস-এর প্যাকেজ করা হয়েছে পাঁচশ’ টাকা। কিন্তু ৫ এমবিপিএস এর সাথে আইএসপিরা ৩০ এমবিপিএস ইউটিউব, ১৫ এমবিপিএস ফেসবুক ইত্যাদি কন্টেন্ট যোগ করে দিচ্ছে। ইন্টারনেট কন্টেন্টকে ভাগ করলে দেখা যায় ৬০-৭০% কন্টেন্টই ইউটিউব, ফেসবুক এবং কিছু গেমস বাকিটা ইন্টারনেট। 

ভলিউম ভিত্তিক মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ ক্রয়ক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশী হওয়ায় সারা বাংলাদেশে ঘরে ঘরে ফিক্সড ইন্টারনেটের চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। শহর ছাপিয়ে এখন গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইএসপিদের ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

বাসাবাড়ির ফিক্সড ইন্টারনেট স্বল্প মূল্যে সস্তা হলেও গুণগত মান নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। আমাদের বাসাবাড়িতে অন্যান্য ইউটিলিটি যেমন পানি, গ্যাস এবং ইলেকট্রিসিটি আন্ডারগ্রাউন্ড বা ওভারহেড স্ট্রাকচারড সিস্টেমে ঢুকলেও ইন্টারনেটের ক্যাবল ঝুলন্ত বেহাল অবস্থা। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মেট্রোর বেশিরভাগ আইএসপি যারা বাসাবাড়িতে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে তাদের নেটওয়ার্ক একটা এলাকা পর্যন্ত(Point of Presence) আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার ক্যাবলে যায়। তারপর রাস্তার পাশে বিভিন্ন পোলে ঝুলন্ত তারের মাধ্যমে ওভারহেড ফাইবার ক্যাবলে বাসাবাড়িতে সংযোগ দেয়া হয়। ঢাকার বাহিরে বেশিরভাগ শহরে ওভারহেড ক্যাবলই একমাত্র ভরসা। এই ঝুলন্ত তার প্রায়ই কাটা পড়ে বা অকেজো হয়ে যায়। ফলে ইন্টারনেট সেবা চরমভাবে বিঘ্নিত হয়।এছাড়াও ছোট ছোট আইএসপিদের ব্যান্ডউইথ ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে এলাকা ভিত্তিক বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রায় ২৭০০ লাইসেন্সধারী আইএসপি রয়েছে। ফলে গ্রাহককে ভালো সেবা দিয়ে ধরে রাখার জন্য এই অপারেটরগুলোর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা বিরাজমান। সুতরাং নিরবচ্ছিন্ন ফিক্সড ইন্টারনেট সেবা দামে সস্তা এবং এখানে একটা যথাযথ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র রয়েছে। ফিক্সড ইন্টারনেটের গুণগত মান আরও বৃদ্ধি করার জন্য সস্তায় আরও বড় ব্যান্ডউইথের প্যাকেজ বাজারে নিয়ে আসতে হবে। ওভারহেড নেটওয়ার্ক কীভাবে আরও সুশৃঙ্খল করা যায় সেই উপায় বের করতে হবে। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ পোলের উপর দিয়ে অপটিক্যাল ফাইবার কেবল বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির সাথে ভাড়া দেয়ার চুক্তি করা যেতে পারে যাতে স্ট্রাকচারড নেটওয়ার্ক তৈরি করা যায়।
আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার নেটওয়ার্ক আরও বিস্তৃত করতে হবে। ঢাকামেট্রোসহ বড় শহরগুলোর সব বিল্ডিং না হলেও বড় বড় বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনগুলোকে আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবারের আওতায় আনতে হবে। ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি বা ব্যান্ডউই্ডথের দাম আরও কমাতে হবে।মেট্রো এবং লং ডিসট্যান্স ট্রান্সমিশনের দাম প্রতি এমবিপিএস থেকে পরিবর্তন করে পয়েন্ট টু পয়েন্ট FE (100 mbps), GE (1000 Mbps), 10Gig (10,000 Mbps) এবং 100Gig করলে ব্যান্ডউইথ ব্যবহার কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে।

ইলন মাস্কের ষ্টারলিংক বাংলাদেশে আসলে হয়তো বাসাবাড়িতেও ডিটিএইচ স্যাটেলাইট টিভির (যেমন আকাশ) মত ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। তবে ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের খরচ অনেক বেশি হওয়ার কথা। দূরবর্তী স্থানে, যেখানে কোন নেটওয়ার্ক নেই, সেখানে কর্পোরেট সংযোগের জন্য হয়তো ফিজিবল হবে। কিন্তু বি-টু-সি (B2C) সেগমেন্টে অদূর ভবিষ্যতে কম খরচে স্যাটেলাইট ব্যান্ডউইথ জনপ্রিয় করা বেশ কষ্টসাধ্য হবে বলেই ধারণা করা যায়। তবে বাজার বিশ্লেষণ করে যদি তারা জনগণের জন্য খরচ কমিয়ে আনতে পারে তাহলে হয়তো তাদের ইন্টারনেট সেবা জনপ্রিয় হতে পারে।

জাতিসংঘ ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করেছে।বাংলাদেশেও অন্যান্য সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের সাথে ইন্টারনেটকেও মৌলিক অধিকার ঘোষণার দাবি উঠেছে। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ঘরে ঘরে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে সহজলভ্য স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের অধিকতর প্রসার দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিঃসন্দেহে অপরিসীম ভূমিকা রাখবে।


প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইন্টারক্লাউড লিমিটেড

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সূর্যসন্তানরা কি পথ হারিয়েছেন?

    অদিতি করিম
শেয়ার
সূর্যসন্তানরা কি পথ হারিয়েছেন?
ফাইল ছবি

বাংলাদেশে অভূতপূর্ব একটি জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন জুলাই বিপ্লবের সূর্যসন্তানরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কয়েকজন অকুতোভয় তরুণ অসম্ভবকে ‘সম্ভব’ করেছিলেন। এ দেশ নিয়ে অনেকেই আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ চিরস্থায়ীভাবে একটা স্বৈরাচারের কবলে থাকা দেশে পরিণত হবে এমন শঙ্কায় যারা নীরবে নিভৃতে হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন, তাদের জন্য সঞ্জীবনী হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন জুলাই বিপ্লবের যোদ্ধারা।

কোটা আন্দোলন থেকে আস্তে আস্তে পরিকল্পিতভাবে অমিত সাহস আর ঝুঁকি নিয়ে তারা একটি প্রচণ্ড ক্ষমতাবান স্বৈরাচার সরকারকে হটিয়েছিলেন। ৫ আগস্টের এ গণ অভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর ৮ আগস্ট একটি নতুন সরকার যাত্রা করে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রসংগঠনের নেতারা নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তাঁরা বাংলাদেশের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, শান্তিতে নোবেলজয়ী ড . মুহাম্মদ ইউনূসকে এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন।
উপদেষ্টাম লীতে রাখা হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যোগ্য আলোচিত এবং স্বনামধন্য ব্যক্তিদের। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘোষণা করেন, যাঁরা জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের প্রতিনিধিদেরও উপদেষ্টাম লীতে থাকতে হবে। এটিও ছিল উপদেষ্টাম লীর একটি চমক।

দেশবাসীর প্রত্যাশা তরুণরা তাঁদের স্বপ্নের মতো করে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবেন। তরুণরা বাংলাদেশ তাঁদের মতো করে সাজাবেন। তাঁরা সবাইকে পথ দেখাবেন। আমরা যদি বাংলাদেশের ইতিহাস দেখি তাহলে দেখব যে তরুণরাই বারবার এ দেশের ইতিহাসের বাঁক বদল করছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থান এবং চব্বিশের বিপ্লব সবকিছুই আসলে তরুণদের অবদান।

আর সে কারণেই রাষ্ট্রে তরুণদের অংশীদারি বা অংশগ্রহণ থাকাটা জরুরি ছিল, সেই জরুরি কাজটা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পন্ন করেছেন। তরুণ এবং প্রবীণের মিশ্রণ এ উপদেষ্টাম লী বাংলাদেশকে একটি স্বপ্নের দেশ বিনির্মাণের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেশবাসীর প্রত্যাশা একটি নতুন বাংলাদেশ। কিন্তু এ বিপ্লবের পর আমরা লক্ষ করছি গত সাত মাসে চব্বিশের আন্দোলনের কিছু কিছু তরুণ লড়াকু সৈনিক এবং বীর যোদ্ধার মধ্যে অতি আত্মবিশ্বাস এবং নানা রকম বিভ্রান্তি। ফলে জুলাই বিপ্লবের সূর্যসন্তানরা নানাভাবে বিতর্কিত হচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ যেন পথ হারিয়েছেন। গত সাড়ে সাত মাসে তাঁদের কার্যক্রম দেখে বঙ্কিম চট্টোপাধ্যায়ের কপালকু লা উপন্যাসের সেই উক্তি মনে পড়ে। যেভাবে কপালকু লা নবকুমারকে বলেছিল, ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’ ঠিক তেমনিভাবে যেন জনগণ মনে করছে জুলাই বিপ্লবের সূর্যসন্তানরা কি পথ হারিয়েছে?

আমরা জুলাই বিপ্লবের পরপর দেখলাম যে তারুণ্য রাষ্ট্র সংস্কার এবং দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করল। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে তাদের অভিযাত্রা অব্যাহত রাখল। এ পদক্ষেপগুলো অধিকাংশ মানুষ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু হঠাৎ সংবিধানের বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে সোচ্চার হলো কিছু তরুণ। বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় রাষ্ট্রপতি হলেন আলংকারিক প্রধান। তিনি রাষ্ট্রের প্রথম ব্যক্তি। তাকে একটি বৈধ প্রক্রিয়া ছাড়া অপসারণ করা যায় না। এ ধরনের অপসারণ একটি বড় ধরনের সাংবিধানিক সংকট তৈরি করতে পারে। তা ছাড়া ড. ইউনূসসহ উপদেষ্টাম লীকে শপথবাক্য পাঠ করিয়েছেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি। কাজেই রাষ্ট্রপতির বৈধতা স্বীকার করে নেওয়ার পর আবার তাকে অপসারণের চিন্তা একটি সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ কয়েকটি একটি বড় দল দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করে। তারা তরুণদের শেষ পর্যন্ত বোঝাতে সক্ষম হয় যে এটি সাংবিধানিক পন্থা নয়। এরপর তরুণরা ফিরে আসে। এ নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। এ ধরনের অতি আবেগ আর যা-ই হোক রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ইতিবাচক নয়। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় ধীরস্থিরভাবে। আইন এবং সংবিধান মেনে। সেখানে অতি উৎসাহ বা আবেগের জায়গা নেই। একটি বিপ্লব আবেগনির্ভর আকাক্সক্ষা। সেখানে জীবন বাজি রেখে সবকিছু করা যায়। কিন্তু যখন রাষ্ট্র পরিচালনার কাজটি সমঝোতা এবং বিধিবিধানের মধ্যে থেকে করতে হয়। জুলাই বিপ্লবের তরুণদের বোঝানোর দরকার ছিল। কিন্তু যারা তাদের অভিভাবক তারা এ বাস্তবতা তরুণদের ঠিকমতো বোঝাতে পারেননি। এরপর হঠাৎই ডিসেম্বরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি উত্থাপিত হয়। তারা সমাজমাধ্যমে নাও অর নেভার বলে ঘোষণা দিয়ে ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আনুষ্ঠানিকভাবে জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে বলে জানালেন। সে সময় তাদের এ তৎপরতা আবার জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। আবার দেশে কী হতে যাচ্ছে, অস্থিতিশীলতা হচ্ছে কি না এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এ বিভ্রান্তির প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের আবার বোঝানো হয়। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং যোগাযোগের পর শেষ পর্যন্ত জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র করা হয়নি। তারা সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর সরকার এখন এটিকে রাজনীতির মাঠে নিয়ে গেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকার এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক ধারার বাইরে গিয়ে দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র দেওয়ার পক্ষে নয়। ফলে রাজনৈতিকভাবেই জুলাই ঘোষণাপত্রের মৃত্যু ঘটেছে। ছাত্রদের সংগঠন এনসিপিও এ নিয়ে তেমন জোরালো দাবি এখন আর করে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। বিপ্লবের আকাক্সক্ষার ধারকদের নেতৃত্বে একটি রাজনৈতিক দল গঠন হতেই পারে। সেটি ইতিবাচক। আমরা তরুণদের নেতৃত্বে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এ রাজনৈতিক দল গঠনের পরপরই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক তৈরি হচ্ছে। তাদের কিছু কিছু অপরিপক্বতা এবং ছেলেমানুষি নতুন রাজনৈতিক দল সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে। যেমন জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, তারা প্রথমে গণপরিষদ নির্বাচন চান। গণপরিষদ নির্বাচন কেন হবে, কীভাবে হবে জাতির কাছে এটা একটি বড় প্রশ্ন। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। একটি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোড অব কন্ডাক্ট বা নিয়মতান্ত্রিক বিধিবিধান থাকে। একটি রাজনৈতিক দলের সবাই সব কথা বলতে পারেন না। একটি গণতন্ত্র এবং বিধিবদ্ধ নিয়মকানুনের অধীনেই রাজনৈতিক দলকে চলতে হয়। কিন্তু গত এক মাসে আমরা লক্ষ করেছি জাতীয় নাগরিক পার্টির অফুরন্ত সম্ভাবনার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো তাদের সবাই কথা বলছেন। যে-যার মতো ফ্রিস্টাইলে কথা বলছেন। একটি রাজনৈতিক দল এভাবে নেতৃত্বহীন অবস্থায় থাকতে পারে না। যে-যার মতো করে কথা বলতে পারে না। জাতীয় নাগরিক পার্টির দুজন অন্যতম নেতা সেনানিবাসে গিয়েছিলেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা বলতে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা দলের কেন্দ্রীয় কমিটি বা শীর্ষ নেতার অনুমতির বাইরে গিয়ে কি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? এটি কি দলের শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল নয়? এ ধরনের বৈঠকের পর তিনি দলীয় ফোরামে আলোচনা না করে ফেসবুকে পুরো ঘটনার বিবরণ দিলেন তাঁর মতো। যে বিবরণটি পুরোপুরি সত্য নয় বলে জানালেন তাঁরই সহকর্মী। যিনি জাতীয় নাগরিক পার্টির একজন নেতা। একটি দলের ভিতরে অন্যতম শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে এ রকম পাল্টাপাল্টি অবস্থান সমাজমাধ্যমে দলের ইমেজ বৃদ্ধি করবে, নাকি এটি দলকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে?

আমরা লক্ষ্য করলাম হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং সারজিসের ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে দলের ভিতরেই নানা রকম মতামত এবং ক্ষোভ। অর্থাৎ দলের ভিতরেই বিষয়টি নিয়ে এখন নেতিবাচক আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে হাসনাত আবদুল্লাহর এ অতিকথন এবং অতিবিপ্লব একদিকে যেমন রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির ম্যাচুরিটি বা পরিপক্বতা ক্ষুণ্ন করেছে, তেমন নেতা হিসেবে হাসনাত বা সারজিস কিংবা অন্যরা কতটুকু প্রস্তুত সে প্রশ্নটিও উঠেছে। কারণ একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য থাকবে তারা নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসবে। ক্ষমতায় এলে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম অংশ হলো সশস্ত্র বাহিনী, দেশে সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীকে সব বিতর্ক থেকে দূরে রাখাটা রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার। রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। সবকিছু নিয়ে দায়িত্বহীন মন্তব্য কোনো রাজনৈতিক নেতার কাজ না। কিন্তু এখানে হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সারজিস যেভাবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন তা দুর্ভাগ্যজনক। দ্বিতীয়ত. একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জায়গায় যাবেন, বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন এবং সেসব অনানুষ্ঠানিক কথাগুলো কোনো সময় অযাচিতভাবে প্রকাশ করা উচিত নয়। তাহলে পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন বা রাজনৈতিক দরকষাকষি সম্ভব হয় না। রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মেশেন এবং বিভিন্ন ধরনের দরকষাকষি করেন। এখন কেউ যদি দরকষাকষির হিসাবটা জনগণের কাছে প্রকাশ করে দেন, তাহলে কেউ কি তাদের বিশ্বাস করবে? সেনানিবাসের ঘটনা নিয়ে হাসনাত এবং সারজিস যে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন তা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঘাটতি সৃষ্টি করবে। এর ফলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তাদের সঙ্গে নিশ্চিন্তে খোলা মনে কথা বলতে রাজি হবেন না। এটি জাতীয় নাগরিক পার্টিরও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে একটি বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে। তৃতীয়ত. একটি রাজনৈতিক দলকে সবার সঙ্গে সহাবস্থান এবং সমতা নিয়ে চলতে হয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনো বিপ্লবী সংগঠন না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল। যে দলটি সবে কাজ শুরু করেছে। কাজেই এ রাজনৈতিক দলকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে। সবার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তারা যেভাবে সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিছেন, যেভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করছেন তা একটি বাজে দৃষ্টান্ত। এর ফলে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা অনাস্থা এবং দূরত্ব তৈরি হবে। এটি বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রের জন্য কখনোই ইতিবাচক নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো এ ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা এখন পর্যন্ত মূলধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দেশ পরিচালনার জন্য কতটুকু সক্ষম এবং যোগ্য সে প্রশ্নটি সামনে নিয়ে এসেছেন। সাধারণ মানুষ মনে করে তারা জুলাই বিপ্লব করেছেন এজন্য তাদের স্যালুট করতে হবে; কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে ধরনের বিচক্ষণতা দরকার তাদের তা আসতে অনেক বাকি। আমার মনে হয় জুলাই বিপ্লবের পর সূর্যসন্তানরা কেউ কেউ দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন। এখনো সময় আছে তাদের বুঝতে হবে তাদের সামনে দীর্ঘ পথ রয়েছে। তাদের অনেক শিখতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং তার পরে তারা জাতীয় রাজনীতিতে একটা অবদান রাখতে পারবেন। নইলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে জুলাই বিপ্লবের সূর্যসন্তানদের স্বপ্ন।

অদিতি করিম : নাট্যকার ও কলাম লেখক

Email : auditekarim@gmail.com

মন্তব্য

একাত্তর থেকে চব্বিশ : সমরে-সগর্বে শহীদ জিয়া

    অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান
শেয়ার
একাত্তর থেকে চব্বিশ : সমরে-সগর্বে শহীদ জিয়া

সদ্যপ্রয়াত কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় বলেছেন, -‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে আমি আর লিখব না বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা। কথা ছিল একটি পতাকা পেলে ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস, ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, -পেয়েছি, পেয়েছি’। এই কবিতায় খুবই সহজ করে হেলাল হাফিজ স্বাধীনতার মূল যে চেতনা তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর মতে স্বাধীনতা সাধারণের মধ্যে এক অসামান্য প্রাপ্তি।

চব্বিশের ৫ আগস্টের পর এই বোধটুকুই যেন নতুন করে অনুভূত হলো। একটি সাধারণ প্রত্যাশাকে প্রাপ্তিতে রূপ দিতে গিয়ে যে অসামান্য ত্যাগ ও আত্মবলিদানের ইতিহাস রচিত হলো তার সুখানুভূতির প্রকাশ ঘটানো মোটেই সহজ কাজ নয়।

২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথ বেয়ে উপমহাদেশের জনগণ পেয়েছিল পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্র। এরপর শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক বাঙালিদের নতুন করে শোষণ ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বেঁধে রাখার ষড়যন্ত্র। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তান।
’৪৮-এ বাংলা ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পথ বেয়ে ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণ অভ্যুত্থানের পর আসে সেই ঐতিহাসিক দিন। একাত্তরের ২৬ মার্চ আসে স্বাধীনতার ডাক। আগের দিন ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি জাতির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে তারা ভেবেছিল মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে এ দেশের মানুষকে। কিন্তু তাদের সেই কল্পনার ধ্বংসস্তূপ থেকে যে মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সৃষ্টি হবে- তা তারা বুঝতে পারেনি।

বলা হয়, প্রকৃতি তার শূন্যস্থান পূরণ করে নেয়। সেটি সময় কিংবা মানুষ দিয়ে। মার্চ ২৫ কালরাতেই মুজিবের শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসেন সেনাবাহিনীর একজন মেজর। তাঁর নাম জিয়াউর রহমান। এদিন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তিনি। এর আগের দিন চট্টগ্রাম শহরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। অস্ত্রবোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগানো হয় বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১টায় চট্টগ্রামের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া আকস্মিকভাবে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে নির্দেশ পাঠান এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য।

এরপর মেজর জিয়া অষ্টম ব্যাটালিয়নের অফিসার, জেসিও জওয়ানদের জড়ো করেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে, তখন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিট। তিনি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ডাক দিলেন। উচ্চারণ করলেন, ‘ডব জবাড়ষঃ’। উপস্থিত সহযোদ্ধাদের সামনে যুদ্ধের পরিকল্পনা উপস্থাপন করেন তিনি।

২৭ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে যান মেজর জিয়া। বেতারকর্মীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কী বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। এদিকে বেতারকর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন, আর পনেরো মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ভাষণ দেবেন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। ইথারে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘোষণাটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতারে ধরা পড়ে এই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। বিশ্ব ও দেশবাসী জেনে যায় বাংলাদেশ নামক এক নতুন দেশের কথা। এই ঘোষণাটি কয়েক দিন ধরে কিছুক্ষণ পরপর প্রচারিত হতে থাকে।

মূলত এটি ছিল মেজর জিয়ার বুদ্ধিদীপ্ত সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্ত। সেদিন তিনি এভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে সাধারণ মানুষ প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। তিনি যদি সেদিন ‘উই রিভোল্ট’ বলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিদ্রোহের ডাক না দিতেন তা হলে প্রেক্ষাপট ভিন্নও হতে পারত। অথচ রাজনৈতিক কারণে এখন অনেকেই তাঁর সেই সাহসী সিদ্ধান্ত আর স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত বোধ করেন।

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। পৃথিবীর বুকে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় ঘটে। লাল-সবুজের পতাকায় শোভিত হয় ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ভূখন্ড। তারপর দেশপ্রেমিক জিয়াউর রহমান আবার ফিরে যান সামরিক ব্যারাকে।

এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য তা হলো, যুদ্ধে যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হতো তাহলে নিশ্চিত ফাঁসিতে ঝুলতে হতো জিয়াউর রহমানকে। যাঁর ডাকে সাত কোটি জনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এটিই হতো তাঁর ফাঁসির জন্য একমাত্র কারণ। জিয়াউর রহমান বুঝেশুনেই সেদিন এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন। একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধার জীবনে এর চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর কিছুই হতে পারে না। রাজনীতি ও ইতিহাস গবেষকরা বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের পর মুহূর্তে মেজর জিয়ার দুঃসাহসিক এই আত্মপ্রকাশই একটি স্বাধীন দেশের জন্য প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে। সেদিন তিনি যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার স্বীকৃতি রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর গোপন দলিলেও। তিনি যেভাবে যে ভাষায় বক্তব্যটি দিয়েছিলেন সিআইএ সেভাবেই সেটি সংরক্ষণ করে। পরবর্তী সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ভারতের রাষ্ট্রপতি মোরারজি দেশাইও জিয়াউর রহমানকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া তাঁর এই কীর্তির কথা নথিবদ্ধ রয়েছে ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডেও। জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মতো লন্ডনের গার্ডিয়ানসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সংবাদমাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রাখে। এমনকি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির এক সেমিনারে বক্তৃতার এক স্থানে বলেন, ‘শেখ মুজিব এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান, যার সুযোগ এখনো আছে।’ ‘ইন্ডিয়া সিকস’ (ওহফরধ ঝববশং) নামক বইতে ইন্দিরা গান্ধীর এ বক্তব্যটি সংকলিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে ভারত সফরকালে দিল্লিতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি জিয়াকে বলেন, ‘সর্বপ্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা আপনার’। যুদ্ধদিনের সফল সমাপ্তির পর দেশের ক্ষমতার মসনদে বসেন শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ৯ মাস দেশের বাইরে থেকে তিনি যুদ্ধদিনের বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারেননি। তাই তো ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে তিনি অনেকটা বেসামাল হয়ে পড়েন। খুব দ্রুতই তার চারপাশে সুবিধাবাদী আর অসৎ লোকে ছেয়ে যায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির একটি ছোট্ট দেশকে দুর্নীতিবাজরা অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে। শুরু হয় লুটপাটের মহোৎসব। অর্থব্যবস্থা মুখথুবড়ে পড়ে। চারদিকে শুরু হয় শোষণ আর নির্যাতনের নতুন অধ্যায়। একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল কায়েম করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পাশাপাশি কেড়ে নেওয়া হয় মানুষের রাজনৈতিক অধিকারও। যে শোষণ-নির্যাতন আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রাম সেটি যেন মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে যায় শেখ মুজিবুর রহমানের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশ রাতারাতি পরিচিতি পায় ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র দেশে।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এখানেও ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ঘটনার পথপরিক্রমায় তিনি এ দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। এর পরের ইতিহাস একটি বৈপ্লবিক বাংলাদেশের। গণতন্ত্র আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার পর তিনি দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে গতিশীল করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর সবুজবিপ্লব দেশের কোটি কোটি অভুক্ত মানুষের মুখে হাসি ফোটায়। ফিরে সেই মাঠ ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরুর সোনালি সময়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জিয়ার পরিচিতি গড়ে ওঠে একজন ‘ভিশনারি লিডার’ হিসেবে। একটি উন্নত অগ্রগামী বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বপ্নদ্রষ্টা তিনি।

নিবন্ধটি শেষ করতে আবারও আসতে হলো কবি হেলাল হাফিজের পতাকার কাছে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর আমরা একটি স্বাধীন ভূখন্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা অর্জন করলাম। সেই থেকে আজ ২০২৫ সাল। মাঝখানে কেটে গেছে ৫৫ বছর। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশ তার গন্তব্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে।

সর্বশেষ কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেনের পরম্পরায় হাসিনার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হলে সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেসের সেই পাওয়ার আনন্দটুকুও যেন হারিয়ে যায়। গুম-খুন আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ আখ্যান রচনা করেন  শেখ মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা। অবশেষে নাগরিকের মর্যাদা হারিয়ে প্রজা বনে যাওয়া এ দেশের কোটি কোটি মানুষের ঘুম ভাঙে চব্বিশের মধ্য জুলাইয়ে। নিপীড়ক রাষ্ট্রে গড়ে ওঠে প্রতিরোধের অপ্রতিরোধ্য দেয়াল। জিতে যায় জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। হেরে যায় শোষক শ্রেণি। দেশ ছেড়ে আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা পালিয়ে যায়। এই পালিয়ে যাওয়া মানে পরাজয়। একাত্তর ও চব্বিশের পালিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীর প্রতি এ দেশের সাধারণ মানুষের সীমাহীন ঘৃণা থাকবেই।

♦ লেখক : অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
দৃষ্টিপাত

এবার কি সত্যিই বদলাবে পরিস্থিতি?

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
এবার কি সত্যিই বদলাবে পরিস্থিতি?
প্রতীকী ছবি

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবার শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব সচিব, বিভাগীয় প্রধান, মহাপরিচালক, নির্বাহী পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সিদ্ধান্তের পর ২০ মার্চ এই নির্দেশনা জারি করা হয়। চিঠিতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কে জনমনে দুর্নীতিবাজ হিসেবে ধারণা রয়েছে এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনে যাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। তবে শুধু নির্দেশনা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঠিক বাস্তবায়নও জরুরি।

দুর্নীতি একটি দেশের উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, সমাজের নৈতিক ভিত্তিকেও দুর্বল করে দেয়।

সরকারি দপ্তর-সংস্থাগুলোতে দুর্নীতির সংস্কৃতি যেন একটি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে জনগণের সম্পদ লুটপাট করে চলেছে। তাদের এই অপকর্মের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সরকারি সেবা পাওয়ার জন্য মানুষকে ঘুষ দিতে হয়, অনিয়মের শিকার হতে হয়।
এই অবস্থার অবসান ঘটানো এখন সময়ের দাবি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে শুধু নির্দেশনা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতি প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

সরকারি দপ্তর-সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে নৈতিকতা ও সততার চর্চা বাড়াতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

এই উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করবে এর বাস্তবায়নের ওপর। যদি নির্দেশনা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে এর কোনো মূল্য থাকবে না। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়, সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু বরখাস্ত করাই যথেষ্ট নয়, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নিতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এ ধরনের ব্যবস্থা নিলেই কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা যাবে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। তবে শুধু সরকারের একার পক্ষে এই লড়াই জয় করা সম্ভব নয়। এই লড়াইয়ে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সরব হতে হবে, তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। শুধু সরকারি নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে আমাদেরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

সরকারের এই উদ্যোগ যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে দেশে দুর্নীতির মাত্রা কমবে, সরকারি সেবার মান বাড়বে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার এই সংকল্পে আমরা সবাই একযোগে কাজ করব—এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

মন্তব্য
দৃষ্টিপাত

আর কতদিন এমন বর্বরতা চলবে?

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

আনিসুর বুলবুল

শেয়ার
আর কতদিন এমন বর্বরতা চলবে?
প্রতীকী ছবি

ঢাকা থেকে পঞ্চগড়গামী একতা এক্সপ্রেসে পরিচয় হয়েছিল এক তরুণী ও রিফাত নামে এক যুবকের। হয়তো মেয়েটি বিশ্বাস করেছিল, সে নিরাপদ। হয়তো মনে করেছিল, এই ছেলেটি তার বন্ধু হতে পারে। কিন্তু সেই বিশ্বাস যে এক ভয়ঙ্কর ফাঁদ, তা সে টের পায়নি।

রিফাত তাকে কথা দিয়ে ভুলিয়ে এক স্টেশনে নামায়। সেখানে অপেক্ষায় ছিল তার আরও দুই বন্ধু। তিনজন মিলে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যায় এক অন্ধকার, গোপন জায়গায়। সারারাত ধরে চলে পাশবিক নির্যাতন।

তাদের নৃশংসতা এখানেই থামেনি—ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তার দেহ। 

মৃত্যুর ঠিক আগে পর্যন্ত মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল, সে আর ফিরবে না। তার কষ্ট, তার চিৎকার, তার শেষ আর্তনাদ—কেউ শোনেনি। বরং সেই বিভীষিকাময় রাতের ভিডিও তারা গর্বের সঙ্গে মোবাইলে তুলে রাখে।

ভোরের আলো ফোটার আগেই নিথর হয়ে যায় মেয়েটি। ঠান্ডা, নিস্তেজ শরীরটা তাদের কাছে তখন আর কিছুই না—একটা ঝামেলা। সেই ঝামেলা সরিয়ে ফেলতে তারা লাশটি রেললাইনে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, এক চুরির ঘটনায় অপ্রত্যাশিতভাবে ফাঁস হয়ে যায় তাদের পৈশাচিক কাহিনি।

রিফাত ধরা পড়ে ইজিবাইক চুরির অভিযোগে।

উত্তেজিত জনতা তাকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। আর দশটা সাধারণ চুরির ঘটনায় যা হয়, এখানেও তা-ই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু থানায় নিয়ে গিয়ে যখন পুলিশ তার মোবাইল ঘাটে, তখনই তাদের রক্ত হিম হয়ে যায়।

সেখানে সংরক্ষিত ছিল সেই রাতের ভয়ংকর ভিডিও—এক অসহায় মেয়েকে বেঁধে রেখে নির্যাতনের দৃশ্য!

রিফাত প্রথমে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু পুলিশের চাপ বাড়তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক লোমহর্ষক সত্য।

পরদিন পুলিশ রেললাইন থেকে যে ছিন্নভিন্ন দেহ উদ্ধার করেছিল। একটি পরিবার, যাদের মেয়ে নিখোঁজ ছিল, তারা সেটি নিজেদের মেয়ের লাশ মনে করে দাফন করেছিল। কিন্তু এখন জানা গেছে, সেটি তাদের মেয়ের দেহ ছিল না।

তাহলে, আসল মেয়েটি কোথায়? আর যে মেয়েটিকে দাফন করা হলো, সে কে?

প্রতিদিন হারিয়ে যায় কত মেয়ে, কত শিশু, কত মানুষ! রেললাইন, নদী, সড়কের পাশে পড়ে থাকে কত নামহীন লাশ, যার জন্য কেউ কাঁদে না।

এই ঘটনা শুধু একটি হত্যার গল্প নয়। এটি আমাদের সমাজের ভয়ঙ্কর এক আয়না। যেখানে বিশ্বাস প্রতারণা হয়ে যায়, যেখানে মানুষত্ব হিংস্রতায় মিশে যায়, যেখানে অসংখ্য পরিবার অপেক্ষা করে—ফেরার কোনো আশাই না রেখে।

একটি মেয়ে বিশ্বাস করেছিল, সে নিরাপদ। কিন্তু সেই বিশ্বাস ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, রেললাইনের ওপর ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা এক দেহের মতো।

আর কত? আর কতদিন এমন বর্বরতা চলবে?

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ