১৬ বছরেরও বেশি সময়ের কর্পোরেট ক্যারিয়ারে আমি দেখেছি, এই পথচলাটা সহজ নয়। তবে একবার যদি নিজের লক্ষ্য স্থির করে নেওয়া যায়, তবে সবকিছু সম্ভব।
আমরা ছোটবেলা থেকেই শিখি—স্কুলে প্রথম হতে হবে, পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করতে হবে। কর্মক্ষেত্রেও সেই দৌড় থামে না। তবে প্রশ্ন হলো—আমরা কী জন্য ছুটছি? কিসের জন্য এই প্রতিযোগিতা?
একজন নারী হিসেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। আপনি হয়তো কর্মজীবন শুরু করেছেন, কিন্তু সংসার বা সন্তান আসার পর সবকিছু বদলে গেছে। হয়তো সমাজের চাপ আপনাকে বলে দেয় 'তোমার তো এখন সংসারে মন দেওয়া উচিত'। কিন্তু নিজের অগ্রাধিকার আপনি ছাড়া কেউ ঠিক করতে পারবে না।
আপনি কী চান? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা সবচেয়ে জরুরি। একজনকে দেখলাম প্রতি বছর পদোন্নতি পাচ্ছেন, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করে বেতন দ্বিগুণ করছেন। এগুলো আপনার ধ্যান-জ্ঞান হলে অন্য বিষয়। কিন্তু অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা করতে গিয়ে এসব প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়া আপনার শান্তিই নষ্ট করবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, একজন নারী যদি চায় তাহলে সে একইসঙ্গে একজন দক্ষ কর্মী, আদর্শ মা, দায়িত্বশীল মেয়ে এবং সফল উদ্যোক্তা হতে পারে। তবে তার জন্য পরিকল্পনা থাকতে হবে, ধৈর্য রাখতে হবে এবং সবচেয়ে বড় কথা—নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে।
নারীর মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব
নারী হওয়া মানেই প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করার দৌড়ে থাকা। কিন্তু এই দৌড়ে আমরা প্রায়শই নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভুলে যাই। পৃথিবীতে কেউ-ই সমস্যা ছাড়া চলতে পারেন না। কিন্তু একজন নারীকে তার দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে শরীর, মন ও আবেগগত পরিবর্তনগুলোর সঙ্গেও মানিয়ে নিতে হয়।
একজন পুরুষ কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারবে না—পিরিয়ডজনিত অসুবিধা, সন্তান জন্মের পর হরমোন পরিবর্তন, ওজন বৃদ্ধির দুশ্চিন্তা, নিদ্রাহীন রাতের কষ্ট, কিংবা মেনোপজের প্রভাব। এগুলোর মধ্য দিয়েও একজন নারী নিজের কাজ, সংসার, সমাজের প্রত্যাশা সবকিছু সামলে নেয়।
তবে এই কঠিন পথচলায় নারীদের একে অপরের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। সহকর্মী নারীকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববেন না—বরং তাকে বন্ধু ভাবুন। আপনার জীবনে কোনো না কোনো সময় এমন কেউ আসবে যে আপনার পাশে দাঁড়াবে, আপনাকে বুঝবে। আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে চাপে থাকি, তাই নিজেদের পারস্পরিক সমর্থন দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবার আগে নিজেকে ভালো রাখতে হবে—আপনার নিজের জন্য, আপনার পরিবারের জন্য।
আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবস
প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। এর পেছনে লুকিয়ে আছে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস।
১৮৫৭ সালে নিউইয়র্কে সুতা কারখানার একদল নারী শ্রমিক মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টার নির্দিষ্টতা এবং অমানবিক কাজের পরিবেশের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিলেন। এরপর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়।
কিন্তু নারী দিবস কি শুধুই একটি দিন? এই দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সমান অধিকার এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। নারীরা এখনো কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন, গৃহস্থালির দায়িত্ব এককভাবে পালন করেন, সামাজিক ও পারিবারিক চাপ সামলান। বাংলাদেশে ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন: নারী ও কন্যার উন্নয়ন”। এটি শুধুই একটি স্লোগান নয়—এটি আমাদের বাস্তবতা গঠনের আহ্বান। নারীরা যেন তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন, যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীরা অযাচিত-অনাকাঙ্ক্ষিত বাধার মুখোমুখি না হন, সেটি নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এখন সময় এসেছে, আমরা নারীরা নিজেদের শক্তি ও সক্ষমতাকে উপলব্ধি করি।
* যখন আপনি কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্বে থাকেন-নিজের সিদ্ধান্তে আত্মবিশ্বাসী হোন।
* যখন আপনি সংসার সামলান—নিজের কাজের মূল্য সম্পর্কে সচেতন হোন।
* যখন আপনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন—নিজেকে মনে করিয়ে দিন, আপনি পারেন|
নারী দিবস মানে কেবল ফুল আর শুভেচ্ছা বিনিময় নয়, এটি নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, সমান অধিকারের দাবি এবং ভবিষ্যতের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া।
আমরা সবাই যদি নিজেদের অবস্থান থেকে নারীদের অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করি, তাহলে আমাদের সমাজে নারীরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন, নিজেদের জায়গা তৈরি করতে পারবেন। কারণ নারী মানেই শক্তি, নারী মানেই সম্ভাবনা।
লেখক: সিনিয়র ম্যানেজার, এন্টারপ্রাইজ বিজনেস সল্যুশন, বাংলালিঙ্ক