<p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">লন্ডনঘেঁষা ছোট্ট শহর নিউইংটনে বাস করেন জর্জ রিবো। একটা বই বাঁধাইয়ের দোকান আছে তাঁর। একেবারে মন্দ চলে না ওটা। একদিন দোকানে বসে আছেন রিবো। বছর তেরোর একটা ছেলে এসে দাঁড়ায় তাঁর সামনে। চেহারায় দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। ছেলেটা কাতর গলায় বলে, ‘আমাকে একটা কাজ দিন স্যার। নইলে না খেয়ে মারা পড়ব।’</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">রিবোর বড্ড মায়া হয়। ছেলেটাকে রেখে দিলেন তাঁর দোকানে। খুব বেশি দিন লাগে না ছেলেটার, কাজ শিখতে। এক সময় এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠে বাঁধাইয়ের কাজে, রিবো নিশ্চিন্তে তার ওপর দোকানের ভার ছেড়ে দিয়ে নিজে অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারেন।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">খুব সামান্য লেখাপড়া করেছিল ছেলেটা। সেটাকে ঠিক লেখাপড়া বলে না। বাবা পেশায় কামার, খাবারই জোটে না দুবেলা, ছেলেকে পড়াশোনা করাবেন কী। সন্তানও তো একটা নয়, চার-চারজন। সুতরাং ছেলেটাকে একটা কিছু করতেই হতো। সুতরাং বাঁধাইখানার শ্রমিক হিসেবেই শুরু হয় কর্মজীবন।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">বাঁধাইখানায় বাঁধাই হতে আসে বিচিত্র সব বই। এগুলোর কিছু কিছু ভালো লাগে ছেলেটার। সেগুলো পড়ে ফেলে।</span> <span style="font-family:Kalpurush">একদিন কেউ একজন এনসাইক্লোপিডিয়া বাঁধাই করতে দিয়ে যায়। ছেলেটা সেটা উল্টোপাল্টে দেখে। এক জায়গায় এসে চোখ আটকে যায়। বিদ্যুৎ নিয়ে লেখা হয়েছে সেখানে। বিদ্যুৎ জিনিসটা তাকে ভারী আকর্ষণ করে। যদি আজকাল বাসাবাড়িতে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়, তখনো সেটা আবিষ্কার হয়নি। শুধু বিদ্যুৎ নয়, বিজ্ঞান, বিশেষ করে রসায়নের কোনো বই পেলে একনিশ্বাসে পড়ে ফেলে।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">এভাবেই কেটে যায় ৭টি বছর। একদিন দোকানে বসে আছে ছেলেটি, অচেনা এক ভদ্রলোক এলেন একটা কার্ড হাতে। রিবোকে খুঁজলেন। না পেয়ে কার্ডটা দিয়ে গেলেন ছেলেটার হাতে। কার্ডটা ছিল লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল সোসাইটির এক বিজ্ঞান বক্তৃতার আমন্ত্রণপত্র। বক্তব্য দেবেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">রিবো ব্যবসায়ী মানুষ, তার অত সময় কোথায় বিজ্ঞান বক্তৃতা শোনার! কার্ডটা তিনি ছেলেটাকে দিয়ে বললেন, সে যদি যেতে চায় তো রিবো আপত্তি করবেন না। ছেলেটা মহা উৎসাহে লন্ডনে গেল।</span> </span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">পকেটে কাগজ আর কলম। সবাই যখন বক্তৃতা শুনছে মনোযোগ দিয়ে, ছেলেটা তখন বক্তৃতার খুঁটিনাটি নোট করছে। তারপর দোকানে ফিরে কাজের ফাঁকে ফাঁকে পুরো বক্তৃতাটা লিখে ফেলে কাগজে। তারপর সেগুলো বাঁধাই করার পর দেখা যায়, ঢাউস একটা বইয়ে পরিণত হয়েছে। ছেলেটা সেই বই পাঠিয়ে দেয় ডেভির কাছে, রয়্যাল সোসাইটির ঠিকানায়।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">ডেভি তো সেটা পড়ে মুগ্ধ। শুধু একবার শুনেই যে ছেলে বিজ্ঞানের গুরুগম্ভীর বিষয়গুলো এত সুন্দর করে গুছিয়ে লিখতে পারে, সে সাধারণ কেউ নয়। তিনি ছেলেটাকে ডেকে পাঠালেন। দেখা হলো, কথাও হলো কয়েক মিনিট। ব্যস এটুকুই। কয়েক দিন যেতে না যেতেই ডেভি চিঠি লিখে ছেলেটাকে ডেকে পাঠালেন আবার। ওকে একটা চাকরি দিতে চান। বেতন সপ্তাহে মাত্র ২৫ শিলিং। তাতেই ছেলেটা রাজি। আসলে বিজ্ঞানীদের কাছাকাছি গিয়ে, তাঁদের গবেষণাগুলো খুব কাছ থেকে দেখার তার প্রচণ্ড ইচ্ছা। সেই ছেলেটার নাম মাইকেল ফ্যারাডে। সর্বকালের সেরা বিজ্ঞানীদের একজন। তাই একদিন হামফ্রে ডেভি বলেছিলেন, তাঁর জীবনের সেরা আবিষ্কার মাইকেল ফ্যারাডে!</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">ডেভি তখন খনিশ্রমিকদের জন্য নিরাপদ বাতি তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তাঁর একান্ত সহকারী ফ্যারাডে। ডেভি দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, ছায়ার মতো তাঁর সঙ্গে যাচ্ছেন ফ্যারাডে। সেসব জায়গায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন তরুণ ফ্যারাডে।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">লন্ডনে তখন ফিলোসফিক্যাল সোসাইটি নামে একটা ক্লাব দাঁড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে আলোচনা করেন ক্লাবের সদস্যরা। সেই ক্লাবে ভর্তি হলেন ফ্যারাডে। বিজ্ঞান আলোচনায় আরও শাণিত হলো ডিগ্রিহীন ফ্যারাডের জ্ঞান। কম-বেশি ডেভির গবেষণাতেও সহযোগিতা করছেন। ডেভি ল্যাবরেটরিতে যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, সেসব দেখে দেখে শিখে ফেলেন ফ্যারাডে। সে সময় ডেনিশ পদার্থবিদ হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেলেন।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">ওয়েরস্টেড একদিন বিদ্যুৎপ্রবাহের ওপর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিল ছিল একটা তড়িৎ বর্তনী আর একটি শলকা চুম্বক বা কম্পাস। কম্পাস ছিল কেন এ বিষয়টা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। দর্শকদের বিদ্যুৎ বর্তনী সম্পর্কে বোঝাচ্ছিলেন। তখন ওই বর্তনীর ভেতর বিদ্যুৎপ্রবাহ চলছিল। কোনো এক কারণে বিদ্যুৎ বর্তনীটা কম্পাসের খুব কাছে চলে আসে, সঙ্গে সঙ্গে কম্পাসের কাঁটা ঘুরে যায়! ওয়েরস্টেড বিষয়টা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন। বর্তনীতে বিদ্যুৎপ্রবাহের দিক বদলে দিলেন। দেখলেন, কম্পাসের কঁাঁটাও ঘুরে গেল। প্রথমবার কম্পাসের কাঁটা যেদিকে ঘুরেছিল, এবার ঘুরছে তার উল্টো দিকে। ওয়েরস্টেড নিশ্চিত হলেন বিদ্যুৎ ও চুম্বকের মধ্যে সম্পর্ক আছে। এ ঘটনা ফ্যারাডের কানে আসে। তিনি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে সুযোগ এসে যায় একদিন।</span> </span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী উইলিয়াম ওয়ালস্টোন ডেভির ল্যাবরেটরিতে ওয়েরস্টেডের পরীক্ষাটা করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সফল হননি। ওয়ালস্টোন ব্যর্থ হয়ে বিদায় নিলে ফ্যারাডে চেষ্টা করলেন এবং সফল হলেন। বের করে ফেললেন এর পেছনের কারণও। কারণটা ব্যাখ্যা করে একটা প্রবন্ধ লিখে পাঠিয়ে দিলেন পাক্ষিক <em>জার্নাল অব সায়েন্স</em>-এ।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">ওয়ালস্টোন সেটা নিয়ে আপত্তি করলেন। অভিযোগ করলেন তাঁর আবিষ্কার মেরে দেওয়ার। কিন্তু ডেভি চাক্ষুষ দেখেছেন ফ্যারাডের কাজ। ওয়ালস্টোনের অভিযোগ তাই ধোপে টিকল না। এরপর শুধু ফ্যারাডের তরতর করে এগিয়ে যাওয়ার পালা। কিন্তু যে ডেভি ফ্যারাডেকে আবিষ্কার করেছিলেন, তিনিই ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েন একসময়।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">ফ্যারাডে রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। তাতে আঁতে ঘা লাগে ডেভির। তিনি এর বিরোধিতা করেন। সঙ্গে ওয়ালস্টোন। শেষমেশ ফ্যারাডে ওয়ালস্টোনকে বোঝাতে সক্ষম হলেও ডেভি বিরোধিতা করেছিলেন শেষ পর্যন্ত। কিন্তু ভোভুটিতে জয় হয় ফ্যারাডেরই, ডেভি ছাড়া আর কেউ তাঁর বিপক্ষে ভোট দেননি।</span></span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">এরপর তরতর করে এগিয়ে যায় তাঁর গবেষণা। ক্লোরোকার্বন আবিষ্কার করেন। একসময় রয়্যাল ইনস্টিটিউট ল্যাবরেটরির পরিচালক পদেও নিয়োগ পান। আবিষ্কার করেন তড়িৎবিশ্লেষণের সূত্র।</span> </span></span></p> <p><span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">আধুনিক ড্রাইসেলেরও অন্যতম আবিষ্কারক ফ্যারাডে। তাঁর সবচেয়ে বড় আবিষ্কার বৈদ্যুতিক জেনারেটর। এটা আবিষ্কার না হলে আজকের পৃথিবী যে বিদ্যুতের ঘাড়ে চেপে চলছে, তার কী হতো কে জানে!</span></span></span></p> <p><br /> <span style="font-size:12pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif""><span style="font-family:Kalpurush">সূত্র: দ্য ইলেকট্রিক লাইফ অব মাইকেল ফ্যারাডে, মাইকেল এইচ. রিশফেল্ড</span></span></span></p> <p> </p>