<p>১৯২৭ সাল থেকেই আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিকসের বিরোধিতা শুরু করেন। বিশেষ করে অনিশ্চয়তা নীতিটা নিয়েই তাঁর আপত্তি ছিল। তখনকার তরুণ, প্রবীণ প্রায় সব বিজ্ঞানীই কোয়ান্টামের প্রেমে মজেছেন, মেনে নিয়েছেন অনিশ্চয়তা তত্ত্ব। শুধু আইনস্টাইন বিষয়টা মানতে পারছেন না। অবশ্য একজনকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। এরউইন শ্রোডিঙ্গার। অথচ দেখেছি শ্রোডিঙ্গার আর হাইজেনবার্গের তত্ত্ব মিলেমিশে কীভাবে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের জন্ম দিল। কিন্তু এর শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। শ্রোডিঙ্গার-আইনস্টাইন, কেউই হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা মানতে পারেননি। অন্যদিকে হাইজেনবার্গও মানতে পারেননি শ্রোডিঙ্গারের তরঙ্গ বলবিদ্যা। বিরোধ তুঙ্গে উঠল একসময়। আইনস্টাইনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, ইলেকট্রন এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে লাফ দেয় কীভাবে?</p> <p>সে কথা তিনি বর্নের কাছে জানতে চাইলেন। বর্ন যে জবাব দিয়েছিলেন, তাতে আইনস্টাইনের মনে হয়েছিল এই জবাব সত্যি হলে তাঁর ব্যাখ্যা করা ফটো তড়িৎ ক্রিয়াও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। ফোটনের আঘাতে কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া ইলেকট্রন নাকি নিজেই ঠিক করবে সে কোন দিকে যাবে। আইনস্টাইনের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হলো। বললেন, বিজ্ঞান এতটাই অনিশ্চিত হবে আগে জানলে বিজ্ঞানী হতাম না, হতাম সরাইখানার বেয়ারা নয়তো ফুটপাতের মুচি। </p> <p>এরপর শুরু হলো চ্যালেঞ্জ, পাল্টা চ্যালেঞ্জ। তৈরি হলো একটা যুদ্ধক্ষেত্রও। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বিজ্ঞানীদের সম্মেলন। সলভে সম্মেলন। সেই সম্মেলনে মুখোমুখি হলো দুই দল। </p> <p>আর সেখানেই আইনস্টাইনের যুক্তি খ-ন করলেন বোর, তাঁর সম্পূরক নীতি ব্যাখ্যা করলেন। আইনস্টাইন তাঁর বিপরীতে কোনো যুক্তি দিতে পারলেন না। হার হলো তাঁদের। তবু আইনস্টাইন মানতে পারেননি অনিশ্চয়তা তত্ত্ব।</p> <p>বোর কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা দিলেন। শ্রোডিঙ্গার সেটা মেনে নিলেন। অন্য যেসব বিজ্ঞানীর অনিশ্চয়তা তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ ছিল, তাঁরাও মেনে নিয়েছিলেন কোপেনেহেগেন ব্যাখ্যা। মানতে পারেননি কেবল আইনস্টাইন। সেটা আমৃত্যু। বোরের ব্যাখ্যা অসার প্রমাণের জন্য তিনি নানা রকম চেষ্টা-চরিত্র করেন। আসলে আইনস্টাইন সুনির্দিষ্ট তত্ত্বে বিশ্বাসী। পদার্থবিজ্ঞানে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মতো পরাবাস্তব একটা বিষয় এসে পড়বে, এটাই মানতে পারছিলেন না। বোর তাঁকে বুঝিয়ে পারছিলেন না, সাধারণ চিরায়ত জগতের সাথে কোয়ান্টাম জগতের ফারাক যোজন যোজন। বাস্তব জগতে যেটা অসম্ভব মনে হয়, কোয়ান্টাম জগতে সেটাই সম্ভব।</p> <p>১৯৩৫ সাল। আইনস্টাইন অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর আরেকবার আঘাত হানতে চাইলেন। প্রমাণ করতে চাইলেন, বোর ভুল। এ জন্য তিনি সামনে টেনে আনলেন আপেক্ষিকতা থেকে বেরিয়ে আসা তাঁর চিরায়ত সেই স্বীকার্যÑকোনো বস্তুর বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। </p> <p>আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মহাকর্ষ বল দূরক্রিয়া। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের খবর পৌঁছাতে সময় লাগে না। ধরা যাক, কোনোভাবে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেল। তার প্রভাব পৃথিবীর ওপরে পড়বে। সূর্য না থাকলে পৃথিবীও আর নিজের কক্ষপথে ঘুরতে পারবে না। সরলরৈখিক গতিতে ছিটকে যাবে অসীম মহাশূন্যের দিকে। কিন্তু পৃথিবী কতক্ষণে বুঝবে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেছে? কখনই-বা সে বন্ধ করে দেবে কক্ষপথে ঘোরা।</p> <p>নিউটনের সূত্র এমনভাবে গড়ে উঠেছে, মহাকর্ষ বলের প্রভাব সাথে সাথে কাজ করে, দুটি বস্তু যত দূরেই থাক। তাই সূর্য ধ্বংস হয়ে গেলে পৃথিবী সঙ্গে সঙ্গেই সে খবর পেয়ে যাবে। নিজের কক্ষপথে ঘোরা বাদ দিয়ে ধেয়ে যাবে অসীম মহাশূন্যের দিকে। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, সেটা সম্ভব নয়। </p> <p>বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব গড়েই উঠেছিল ওই স্বীকার্যের ওপর ভিত্তি করে—মহাবিশ্বের কোনো কিছুর বেগ আলোর চেয়ে বেশি হতে পারে না। তাই আলোর বেগের চেয়ে বেশি গতিতে কোনো তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব নয়। সুতরাং মহাকর্ষ বলকেও সেটা মানতে হবে। মহাকর্ষীয় প্রভাব কখনোই আলোর বেগের চেয়ে বেশি বেগে যেতে পারে না। আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখালেন সেটাই। এটা করতেই গিয়েই বেরিয়ে এল মহাকর্ষ তরঙ্গ নামে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরঙ্গ। মহাকর্ষ বলের সংবাদ বয়ে নিয়ে যায় এই তরঙ্গ। সেটা আলোর বেগের সমান গতিতে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পাবেন অন্বেষা থেকে প্রকাশিত আমার লেখা মহাকর্ষ তরঙ্গ বইটিতে।</p> <p>আইনস্টাইন দেখলেন অনিশ্চয়তা তত্ত্বে এসে ধাক্কা খায় তাঁর এই তত্ত্ব। কোয়ান্টাম কণাগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে মুহূর্তের মধ্যেই। এ জন্য তিনি বোরিস পোডলস্কি আর নাথান রোজেনকে সাথে নিয়ে এপিআর (ঊচজ, আইনস্টাইন, পেডোলস্কি আর রোজেনের নামের আদ্যক্ষর সাজিয়ে এই নাম) নামে একটা বিভ্রমের (Paradox) জন্ম দিলেন। সত্যিই সেটা এক মজার ধাঁধা। সেই ধাঁধা থেকেই জন্ম হলো কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট নামের এক নতুন তত্ত্বের।</p> <p>উঠে এল আইনস্টাইনের (EPR) প্যারাডক্সে। ১৯৩৫ সাল নাগাদ কোয়ান্টাম মেকানিকস তত দিনে দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত ভিতের ওপর। ঠিক সে সময় আঘাত হানলেন আইনস্টাইন। রোজেন আর পোডলস্কিকে নিয়ে ফিজিক্যাল রিভিউতে লিখলেন চার পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ। তাতে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করালেন পাঠককে। ধরা যাক, দুটো ইলেকট্রন ছুটছে পরস্পরের দিকে। দুটোর গতি আর ভরবেগ সমান। তারপর একসময় তাদের সংঘর্ষ হবে। পরস্পরকে তারা দেবে জোর ধাক্কা। দুটো ইলেকট্রন সমান গতিতে পরস্পরের দিকে ছুটতে থাকবে বিপরীত দিকে। ধরা যাক, এভাবে ইলেকট্রন দুটি পরস্পর থেকে হাজার কিলোমিটার দূরে চলে গেল। একজন বৈজ্ঞানিক একটা ইলেকট্রন পরীক্ষা করলেন। নির্ণয় করলেন তার ভরবেগ আর গতিশক্তি।</p> <p>সেই মুহূর্তে অন্য ইলেকট্রনের ভাগ্যে কী ঘটছে? যখন বিজ্ঞানী ইলেকট্রনের গতিশক্তি বা অবস্থান বের করছেন, সেই মুহূর্তে তিনি অন্য ইলেকট্রনের গতিশক্তিও বের করে ফেলতে পারবেন। কারণ দুটোরই ভর, গতি সমান। তাই একটা দেখেই আরেকটার অবস্থান, ভরবেগ বের করে ফেলা যায়। </p> <p>অথচ সেই ইলেকট্রনটা তার থেকে এক কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ সময় ব্যয় না করে এক কিলোমিটার দূরের আরেকটা ইলেকট্রনের ধর্ম বের করে ফেলা যাচ্ছে।</p> <p>ধরা যাক, এভাবে ইলেকট্রন দুটি চলতে চলতে বহুদূরের পথ পাড়ি দিল। দটির মধ্যবর্তী দূরত্ব এখন ২৫ লাখ আলোকবর্ষ। একটার অবস্থান আমাদের পৃথিবীতে হলে আরেকটা চলে গেছে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে। আমরা পৃথিবীর ইলেকট্রনের ভরবেগ আর গতিশক্তি ও অন্যান্য ধর্ম পরীক্ষা করে বলে দিতে পারি, অ্যান্ড্রোমিডাতে চলে যাওয়া সেই ইলেকট্রনের এই মুহূর্তের ধর্মও। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আসলে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। এখানেই আইনস্টাইনের প্রশ্ন। তাহলে কি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এই আইনে আলোর গতির চেয়েও বেশি গতিতে তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব। কিছুতেই এটা হতে পারে না। এটাই তুলে ধরেছিলেন তিন বিজ্ঞানী। বলেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্ব তাহলে কি ভেঙে ফেলতে চাই বিশেষ আপেক্ষিকতার সেই বিখ্যাত নীতি —আলোর চেয়ে বেশি গতি চলতে পারে না কোনো বস্তু, এমন কী তথ্যও? সঙ্গে শ্রোডিঙ্গার শুনিয়েছিলেন তার কাল্পনিক বিড়ালের গল্প, আইনস্টাইনের পক্ষ নিয়ে।</p> <p>সলভে সম্মেলনে বোর আর তার অনুসারীররা কোপেনহেগেন ব্যাখ্য দিয়ে বলেছিলেন, আসলেই কোয়ান্টাম কণিকারা তথ্য পাচার করতে পারে আলোর চেয়েও বেশি গতিতে। তা যতই অদ্ভুত শোনাক। অতি সম্প্রতি চিনের বিজ্ঞানীরা সত্যি সত্যিই কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেল ঘটিয়ে আলোর চেয়েও দ্রুত গতিতে তথ্য পাচার করতে সক্ষম হয়েছেন।</p>