<p>দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির নাড়ি-নক্ষত্র জানেন তিনি। তাই তাঁর ভবিষ্যদ্বাণীকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। অন্তত দুজনের ভাগ্যের দেয়াললিখন তিনি ঠিকঠাকই বলে দিয়েছিলেন। স্টিভ রোডস ও রাসেল ডমিঙ্গো যে দীর্ঘস্থায়ী হবেন না, তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের পরই বলে দিয়েছিলেন তিনি।</p> <p>তাঁর নামটা গোপন থাক। দুই কোচ সম্পর্কে তাঁর অনুমান ছিল, ‘ভালো মানুষ, ভালো কোচও তাঁরা। কিন্তু আমাদের কালচারের সঙ্গে যায় না।’ তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রোডস ও ডমিঙ্গোর বাংলাদেশে চাকরির মেয়াদ বাড়েনি।</p> <p>উল্টো নানাভাবে অপদস্ত হয়েছেন তাঁরা। তো, ফিল সিমন্সের নিযুক্তির খবর শুনেও সেই ভবিষ্যদ্বক্তা বলে দিলেন, ‘বেশি দিন টিকবে বলে মনে হয় না!’ ফিল সিমন্সকে আপাতত আগামী বছর অনুষ্ঠিত আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পর্যন্ত নিয়োগ দিয়েছে বিসিবি। সময়ের হিসাবে দীর্ঘস্থায়ী নিযুক্তি নয়, মোটে মাস পাঁচেকের। তাতে বাংলাদেশের প্রধান কোচ পদে সিমন্সের স্থায়িত্ব নিয়ে এখনই সন্দিহান হওয়ার সুযোগ নেই।</p> <p>তবে ব্যাটে-বলে মিলে গেলে এই ক্যারিবীয়র সঙ্গে চুক্তি নবায়নের নীরব আগ্রহ আছে বিসিবির শীর্ষব্যক্তিদের। এই প্রেক্ষাপটে সিমন্সের স্থায়িত্ব নিয়ে কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক।</p> <p>এমনিতে ডাকলেই কেউ বাংলাদেশে ছুটে আসেন না। উচ্চ বেতন আর অনন্যোপায় না হলে কোনো বিদেশি বাংলাদেশের চাকরি নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না, এটাই বাস্তবতা। তার ওপর হরেক রকমের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের যুগে হুটহাট ভালো কোচ পাওয়াও কঠিন।</p> <p>সেসব বিবেচনায় ফিল সিমন্সের মতো বৈশ্বিক আসর জেতা কোচ বাংলাদেশের জন্য হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো ব্যাপার। ১৪ অক্টোবর বিপিএলের প্লেয়ার্স ড্রাফট শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ফারুক আহমদ হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘দু-এক দিনের মধ্যে সুখবরটা পেয়ে যাবেন।’ কালবিলম্ব না করে পরের দিনই কোচ বদলের খবরটি দিয়েছেন বিসিবি সভাপতি। ফিল সিমন্স বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন চাঁদতুল্য।</p> <p>অবশ্য এই বিশ্বকাপ জয়টয় সব সময় রক্ষাকবচ হয় না। ফিল সিমন্স নিজেও তা জানেন। ভারতে অনুষ্ঠেয় ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ তাঁর অধীনেই জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু এর মাস ছয়েক পরই সিমন্সকে বরখাস্ত করে ক্যারিবীয় ক্রিকেট বোর্ড। সেই বরখাস্তপত্রের চৌম্বক অংশ, ‘সাম্প্রতিক সময়ে তিনি (সিমন্স) প্রকাশ্যে এমন কিছু বলেছেন, যা আমাদের সংস্কৃতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।’ </p> <p>সেই অসামঞ্জস্য কী ছিল জানেন? দল নির্বাচনে বাইরের হস্তক্ষেপ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নিজের অসন্তোষের কথা বলেছিলেন সিমন্স। প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইলে হয়তো চাকরি বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন তিনি। কিন্তু তা করেননি। বোর্ড চাকরিচ্যুত করার পর উল্টো প্রায় লাখ চারেক ডলারের ক্ষতিপূরণ আদায়ের মামলা করেছিলেন। পরের বোর্ড সভাপতি রিকি স্কেরিটের যুগে পুরনো চাকরিতে ফিরেছিলেন। শোনা যায়, ক্ষতিপূরণের বিষয়টিও ফয়সালা হয়েছিল। যদিও অর্থের পরিমাণ দুই পক্ষের কেউ-ই প্রকাশ করেনি।</p> <p>স্বর্ণযুগ পেরিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির কোথাও কি মিল খুঁজে পাচ্ছেন? খুঁজে পাওয়ার তো কথা। নাজমুল হাসানের মুখে আগাম দল থেকে একাদশের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্রিকেটারের সামর্থ্য সম্পর্কে অনুপুঙ্খ তথ্যাদি জেনে অভ্যস্ত দেশের ক্রিকেটসমাজের মিল খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রোডস এবং ডমিঙ্গো এমন সংস্কৃতিরই বলি হয়েছিলেন।</p> <p>সিমন্সের জন্য আশার কথা, দল নির্বাচনী সভা থেকে দূরে থাকার যুক্তিতে এখনো অটল আছেন বিসিবির বর্তমান সভাপতি ফারুক আহমেদ। বাইরের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে প্রধান নির্বাচকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখনো পর্যন্ত দল নির্বাচন নিয়ে ফারুককে কোনো উচ্চবাচ্য করতে শোনা যায়নি; বরং নির্বাচকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার তিনি। সে অর্থে সিমন্সকে আপাতত ‘নিরাপদ’ মনে হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে।</p> <p>যুক্তির আড়ালে আবার সংশয়ও আছে। আছে, কারণ দেশটা বাংলাদেশ। জোর হাওয়ায় পাল তুলে চলে সব কিছু। স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শক্তি খুব একটা দেখা যায় না। নিজেকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে অন্যকে বিপদে ফেলে দিতে বিচলিত হন না কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তৈরি আবেগের স্রোতেও হরহামেশা ভেসে যায় পেশাদার সিদ্ধান্ত। সে রকম কিছু হলে সিমন্সের সামনে কী ঢাল হয়ে দাঁড়াবেন ফারুক?</p> <p>ধরুণ নতুন কোচের অধীনে খারাপ ফল হলো বাংলাদেশ দলের। ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঘুরে পাকিস্তানের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সিমন্সের আপাতত মেয়াদ এটুকু। যুক্তি বলে, এর কোনোটি বাংলাদেশ দলের জন্য মৃগয়া নয়, ফল খারাপ হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। তবু ফল খারাপ হলে শোর উঠবে। পরিবর্তনের হাওয়া বইবে। নতুন বলে কী বিশেষ ছাড় পাবেন সিমন্স? পেতে পারেন বলতেও দ্বিধা হচ্ছে। ভারত সফরের আগে বাংলাদেশ দল যে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করেছিল, সেটিই তো কারো মনে নেই। সিমন্সের খেলোয়াড়ি জীবন, কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের স্বীকৃতি কিংবা ব্যক্তিত্বও দুঃসময়ে প্রাপ্য মর্যাদা পাবে বলে মনে হয় না।</p> <p>এতকাল এভাবেই চলে এসেছে। মহা ধুমধাম করে বিদেশি কোচ আনা হয়েছে। উৎসবের সেই রেশ না কাটতেই শুরু তীব্র সমালোচনার। প্রথমে কোচের নিন্দামন্দ শুরু হয় বিসিবির বোর্ড রুমে। এরপর ড্রেসিংরুমের ফিসফাস ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়ায়। সেই সূত্রে আমজনতার ঢল নামে সমালোচনার ময়দানে। বলার অপেক্ষা রাখে না, দল যত খারাপ খেলে, তত বাড়তে থাকে সমালোচনার তীব্রতা। এটাই বাংলাদেশের চিরায়ত ‘চেইন রিঅ্যাকশন’।</p> <p>চন্দিকা হাতুরাসিংহে আবার অভাবিত এক কাণ্ড করে বসেছেন। ২০২৩ বিশ্বকাপে চেন্নাইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ চলাকালে নাসুম আহমেদের ওপর চড়াও হন তিনি। ঘটনাটি মিডিয়ায় আসে অনেক পরে। এরপর সেটি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ধামাচাপা দিয়েছিল নাজমুল হাসানের নেতৃত্বাধীন বোর্ড। এমন একটি অপমানজনক ঘটনা কেন ধামাচাপা পড়েছিল? অবশ্যই নাজমুল হাসানের সঙ্গে শ্রীলঙ্কান কোচের গভীর সখ্যতা প্রধানতম কারণ। কিন্তু একটি ড্রেসিংরুমে তো ‘কমরেডি’ থাকার কথা। সতীর্থদের একজন নিগৃহীত হলে পুরো ড্রেসিংরুমের প্রতিবাদ করাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেদিন সে রকম কিছু ঘটেনি। এমনকি বিশ্বকাপের পরে মূল্যায়ন কমিটির সামনেও বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেটাররা খুব বেশি কিছু জানাননি। প্রত্যক্ষদর্শী না হতে পারেন; কিন্তু একজন সতীর্থের বক্তব্যে যে তাঁরা আস্থা রাখতে পারেননি, এটা অবিশ্বাস্য! সভাপতি হওয়ার পর ঘটনার তদন্তে নেমে একজন বিদেশির বয়ানে নাসুমের পক্ষে  প্রমাণ পেয়েছেন ফারুক আহমেদ। সেই বিদেশি জাতীয় দলের কোচিং স্টাফের সাবেক এক সদস্য।</p> <p>নাসুমের প্রতি প্রধান কোচের আচরণে বেদনা অনুভব করেছেন ফারুক, সেটি সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে। সেখানে নাসুমের সতীর্থদের মর্মবেদনা তো আরো বেশি হওয়ার কথা। সেটি হয়নি, যা বাংলাদেশ ক্রিকেট সংস্কৃতির পীড়াদায়ক একটি অনুসঙ্গ। প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে স্বার্থপরতা আর ব্যক্তিত্বের সংঘাত।</p> <p>২০২৩ বিশ্বকাপকে ঘিরে গঠিত পর্যালোচনা কমিটির সদস্যরাও মৌনব্রত নিয়েছিলেন। বিভিন্ন পক্ষের কথা শুনে তাঁরা তিন পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন তৎকালীন বোর্ড সভাপতিকে। সেটি সংবাদমাধ্যমের সামনে নাড়াতে নাড়াতে নাজমুল হাসান একদিন বলেছিলেন, ‘আমি তো এই প্রতিবেদনে কিছুই খুঁজে পেলাম না!’ অথচ ফারুক আহমেদ জানিয়েছেন, সেই প্রতিবেদনে নাসুমের সঙ্গে ‘কিছু একটা ঘটেছিল’ লেখা ছিল। তাহলে তিন সদস্যের পর্যালোচনা কমিটির কেউ-ই সেদিন নাজমুলের বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেন না কেন? প্রতিবাদ করেননি কর্তার বিরাগভাজন হতে চাননি বিধায়। নাসুম বড় তারকা হলে অবশ্য ভিন্ন কথা ছিল, উথাল-পাথাল হতো ক্রিকেটাঙ্গন। অবশ্য সে ক্ষেত্রে চতুর হাতুরাসিংহে সম্ভবত নাসুমকে আঘাত না করে সুকৌশলে ‘এক্সিট রুট’ দেখিয়ে দিতেন!</p> <p>বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির ঘাটতির জায়গা এখানে। আগের বোর্ডে হাতুরাসিংহে ক্ষমতার মধ্যমণি ছিলেন। তাই নাসুমের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বোর্ড কিংবা দল। এখন দিন বদলেছে। নতুন সভাপতি প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন হাতুরাসিংহের। চট করে ড্রেসিংরুমে প্রতিপত্তি হারিয়েছেন তিনি। বিদায়বেলায় কেউ তাঁকে ক্ষুদেবার্তা পাঠাবেন বলে বিশ্বাস হয় না।</p> <p>ফিল সিমন্সের ভাগ্যে কী লেখা আছে? সেটা সময়ই বলবে। তবে নিজ দেশে মর্যাদার জন্য প্রকাশ্যে লড়াই করতে হয়েছিল তাঁকে। বাংলাদেশে এই ক্যারিবীয়র পথচলা মসৃণ হবে—এমন নিশ্চয়তা নেই। ব্যক্তিগত স্বার্থের ঠোকাঠুকি, উত্তাল মিডিয়া আউটলেট আর জাতীয় দলকে ঘিরে অযুত-কোটি জনতার আকাশচুম্বী উচ্চাশার সঙ্গে সিমন্স কিভাবে মানিয়ে নেবেন? সঙ্গে স্বার্থপরতা আর ব্যক্তিত্বের ঠোকাঠুকি তো আছেই।</p> <p>তাই আপাতত ফিল সিমন্সের জন্য প্রার্থনা—ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন!</p>