<p>ভারতে শিক্ষার অধিকারসংক্রান্ত আইনের নিয়মে পরিবর্তন করল কেন্দ্রীয় সরকার। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাস-ফেল প্রথা ফেরানো হলো। নো-ডিটেনশন বা শিক্ষার্থীদের পরের ক্লাসে তুলে দেওয়ার নীতি বদল করা হলো। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষায় পাস না করলে দুই মাসের সময় দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীর বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তারপর আবার পরীক্ষায় বসতে হবে তাকে। তখনো ফেল করলে সেই ক্লাসে থেকে যেতে হবে তাকে।</p> <p>স্কুল শিক্ষা সচিব সঞ্জয় কুমার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নতুন নিয়মের ফলে শিক্ষার্থীদের মান বাড়বে। যারা দুর্বল শিক্ষার্থী, তাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হবে। সব রকম চেষ্টা সত্ত্বেও যদি কেউ পাস করতে না পারে, তাহলে তাকে একই ক্লাসে থেকে যেতে হবে। তবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কাউকে ফেল করার জন্য স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হবে না। এখন বাচ্চারা কতটা শিখছে তার দিকে নজর দেওয়া হবে।’</p> <p><strong>নো-ডিটেনশন নীতি কী ছিল?</strong><br /> ২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইনে নো-ডিটেনশন নীতি নেওয়া হয়। এই নীতি অনুসারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাস-ফেলের বিষয়টিই তুলে দেওয়া হয়। সব ছাত্রছাত্রী অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিবছর ওপরের ক্লাসে উঠে যেত। তাদের মূল্যায়নের একটা ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে সেটাও তুলে দেওয়া হয়।</p> <p>শিক্ষা হলো কেন্দ্র ও রাজ্যের যুগ্ম তালিকাভুক্ত বিষয়। তাই রাজ্যগুলোও নিজেদের ব্যবস্থা চালু করতে পারে। ২০১৯ সালে ১৬টি রাজ্য ও দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নো-ডিটেনশন পদ্ধতি খারিজ করে জানায়, তারা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাস-ফেল ব্যবস্থা বজায় রাখবে। অন্য রাজ্যগুলো নো-ডিটেনশন নীতি নিয়ে চলছিল।</p> <p><strong>এখন কী হলো?</strong><br /> কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে তিন হাজারের মতো কেন্দ্রীয় স্কুলে নো-ডিটেনশন নীতি উঠে গেল। এই স্কুলগুলোর মধ্যে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয়, সেনা স্কুলও আছে। বাকি রাজ্যগুলো এখন ঠিক করবে, তারা কী ব্যবস্থা নেবে।</p> <p><strong>পশ্চিমবঙ্গে কী হবে?</strong><br /> এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেন, রাজ্য ২০২০ সালে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাস-ফেল পদ্ধতি বহাল রাখে। তার দাবি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন আগে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এখন কেন্দ্রীয় সরকার তা নিল।</p> <p>কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তি সত্ত্বেও রাজ্যে পঞ্চম তো বটেই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কাউকে ক্লাসে রেখে দেওয়া হতো না বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাস-ফেল ব্যবস্থা চালু রাখার কথা বললেও বাস্তবে নো-ডিটেনশন নীতি নিয়েই চলছিল রাজ্য।</p> <p><strong>কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া</strong><br /> কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তকে শিক্ষার সঙ্গে জড়িত অনেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দেবাশিস ভৌমিক জানিয়েছেন, ‘আমার মনে হয়, অষ্টম শ্রেণিতে পাস-ফেলের ব্যবস্থা থাকাটা জরুরি। তবে পঞ্চম শ্রেণিতে তা থাকা উচিত নয়।’</p> <p>দেবাশিসের যুক্তি, ‘পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী গ্রামের স্কুলে পড়ে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত তারা প্রাইমারি স্কুলে পড়ে আসে। সেখানে পড়ার মান খুব খারাপ। সেখানে মিড ডে মিল হলো মূল আকর্ষণ। তারা যখন হাই স্কুলে আসে, তখন আমরা দেখেছি, তারা যুক্তাক্ষর লিখতে পারে না। এক পাতা ঠিক করে পড়তে পারে না। তাদের পক্ষে পঞ্চম শ্রেণির বাধা টপকানো কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে তারা শিক্ষার প্রতিই উৎসাহ হারাতে পারে। তবে অষ্টম শ্রেণিতে মান ঠিক রাখার জন্য পাস-ফেল চালু করাই উচিত।’</p> <p>যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রতীম বৈদ্য আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেছেন, ‘অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাস-ফেল না থাকার ফল মারাত্মক হয়েছে। অনেকে শূন্য পেয়েও পাস করেছে। অনেকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য সব পরীক্ষা দেয়নি। সেও পাস হয়ে গেছে। পরে তারা নবম ও দশম শ্রেণিতে উঠতে পারেনি।’</p> <p>কলকাতার অধ্যাপক উত্তরা রায় জানান, ‘আমার তো মনে হয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাস-ফেল ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিক্ষার মানের কথা ভেবেই তা থাকা দরকার।’ </p> <p>অনেকে বলছেন, শিক্ষকদেরও তো দায় আছে। তারা কতটা মনোযোগ দিয়ে পড়াচ্ছেন, তারা নিয়মিত স্কুলে আসেন কি না, সেটাও তো দেখতে হবে।</p> <p><strong>শিক্ষার্থী নেই বলে স্কুল বন্ধের আশঙ্কা</strong><br /> অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে আরো একটি বড় সমস্যা রয়েছে। শিক্ষার্থী নেই বলে আট হাজারের বেশি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। </p> <p>গত বছর আগস্টে সরকারি প্রতিবেদন তুলে ধরে এবিপি আনন্দ জানাচ্ছে, ২২৬টি স্কুলে কোনো শিক্ষার্থীই নেই। কয়েক হাজার স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫০-এর কম। স্কুল আছে, শিক্ষক আছে, কিন্তু শিক্ষার্থী নেই। বলা হচ্ছে, বেসরকারি স্কুলের রমরমা, স্কুলের বাইরের শিক্ষকদের কাছে পড়ার প্রবণতা এবং সরকারি স্কুলের বেহাল অবস্থার জন্য এই পরিস্থিতি হয়েছে।</p> <p>অধ্যাপক দেবযানী মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘আমিও শুনেছি, স্কুলে এখন শিক্ষার্থীরা অনেক কম আসছে। কলেজের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা রয়েছে।’</p> <p>দেবাশিস মনে করেন, ‘একে পাস-ফেলের বিষয় নেই, তার ওপর শিক্ষার্থীরা টিউশন পড়ে। অনেকে আবার স্কুলের সময়ও টিউশন নেন। তা ছাড়া একটা সামগ্রিক হতাশাও আছে। পড়াশোনার পরও চাকরি পাওয়া নিয়ে। তাই স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমছে। হাই স্কুলে ক্লাস ফাইভে এসে যারা ভর্তি হচ্ছে, তারা নিজেদের মাতৃভাষায় একটা গোটা পাতাও পড়তে পারে না। যুক্তাক্ষর লিখতে তাদের কলম ভেঙে যায়। ফলে তাদের ন্যূনতম শিক্ষা দেপয়া ও মেধাবীদের পরবর্তী ধাপের জন্য তৈরি করাটা স্কুলের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।’</p>