মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সপ্তাহে রুশ নেতা ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে আলাদা আলাদা ফোনালাপ করেছেন। দীর্ঘ এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এই আলোচনাগুলোকে শান্তি আলোচনার সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এএফপি এই প্রতিবেদনে পর্যালোচনা করেছে, মস্কো ও কিয়েভ বর্তমানে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে সম্ভাব্য আলোচনার বিষয়ে কী অবস্থান নিচ্ছে।
রাশিয়া : সংঘাতের ‘মূল কারণ’ সমাধান
ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপে পুতিন বলেছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধ করতে হলে এই সংঘাতের ‘মূল কারণগুলো’ সমাধান করতে হবে।
আরো পড়ুন
পুতিন-ট্রাম্প ফোনালাপ, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা শুরু হবে
এটি সম্ভবত সেই নিরাপত্তা দাবির প্রতি ইঙ্গিত, যা মস্কো ২০২১ সালের শেষের দিকে ন্যাটো ও ওয়াশিংটনের কাছে তুলে ধরেছিল, যেসব দাবি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ আগেই জানিয়েছিল।
এই দাবির মধ্যে ছিল ইউরোপের নিরাপত্তা কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীকে সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্র ও পূর্ব ইউরোপীয় ব্লকের দেশগুলো থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। এর মধ্যে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো, রুমানিয়া ও বুলগেরিয়া অন্তর্ভুক্ত, যারা বর্তমানে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য।
রাশিয়া আরো দাবি করেছিল, কোনো সাবেক সোভিয়েত রাষ্ট্রকে ন্যাটোর সদস্য পদ দেওয়া যাবে না এবং সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে ন্যাটোর কোনো সামরিক অভিযান চালানো যাবে না।
আরো পড়ুন
ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাশিয়ায় যুক্ত হতে চায় : ক্রেমলিন
এ ছাড়া আক্রমণের পর থেকে মস্কো স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো ভূখণ্ড বিনিময়ের ধারণা সমর্থন করে না, যেখানে ইউক্রেন রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের বদলে রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন অংশ পাবে।
মস্কো বলছে, যুদ্ধ শেষ করার জন্য যেকোনো চুক্তিকে অবশ্যই ‘নতুন বাস্তবতা’ প্রতিফলিত করতে হবে, যার মধ্যে ২০২২ সালে রাশিয়ার দখল করা ইউক্রেনের চারটি দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ড এবং ২০১৪ সালে দখল করা ক্রিমিয়ার অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে।
রাশিয়া আরো বলেছে, তারা ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে না। কারণ মস্কোর দাবি অনুযায়ী তার মেয়াদ গত বছর শেষ হয়েছে।
তবে ইউক্রেনে যুদ্ধকালীন আইন জারি থাকায় জেলেনস্কি এখনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রেসিডেন্ট।
পুতিন ট্রাম্পের প্রশংসা করেছেন এবং তার সঙ্গে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তিনি বলেছেন, যদি ট্রাম্প ২০২২ সালে হোয়াইট হাউসে থাকতেন, তাহলে যুদ্ধই শুরু হতো না।
ইউক্রেন : ‘ন্যায়সংগত শান্তি’
প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি চান যুদ্ধ দ্রুত শেষ হোক এবং ইউক্রেন এমন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা পাক, যা ভবিষ্যতে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে পারে। এর মধ্যে ন্যাটোর সদস্য পদ বা বড় পরিসরের আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষা বাহিনী মোতায়েনের মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তিনি বলেছেন, আলোচনায় ইউক্রেন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে, যেহেতু ইউক্রেন বর্তমানে ইইউর প্রার্থীর তালিকায় রয়েছে এবং যোগদানের আশা করছে।
পাশাপাশি কিয়েভ রাশিয়ার কাছে কোনো ভূখণ্ড ছাড়তে চায় না। তবে জেলেনস্কি স্বীকার করেছেন, কিছু এলাকা কূটনীতির মাধ্যমে পরে পুনরুদ্ধার করা হতে পারে।
আরো পড়ুন
যুদ্ধ শেষ করতে পুতিনের সঙ্গে বসতে রাজি আছি : জেলেনস্কি
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট মিত্রদের যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য ইউক্রেনের প্রস্তাবিত দুই নথি—‘পিস ফর্মুলা’ ও ‘ভিক্টরি প্ল্যান’-এর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা সফল হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
গত আগস্টে ইউক্রেন রাশিয়ার সীমান্তবর্তী কুরস্ক অঞ্চলের বড় অংশ দখল করে। কিয়েভের মতে, এটি ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সম্পদ হতে পারে। এই সপ্তাহের শুরুতে জেলেনস্কি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিয়েছেন, অঞ্চলটি রুশ নিয়ন্ত্রিত কিছু ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডের বিনিময়ে ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
এর আগে তিনি বলেছিলেন, রাশিয়ার সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারই আলোচনার পূর্বশর্ত এবং শুধু ‘ন্যায়সংগত শান্তি’ স্থায়ীভাবে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারে।
পটভূমি
কিয়েভ মনে করে, রাশিয়া কোনো চুক্তি মানবে না, যদি না তাদের ওপর আন্তর্জাতিক নজরদারি থাকে। তারা অতীতের একাধিক চুক্তির ভিত্তিতে এই মতামত গঠন করেছে।
২০২২ সালের জুলাই মাসে মস্কো ও কিয়েভ তুরস্ক ও জাতিসংঘের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যাতে ইউক্রেন কৃষ্ণ সাগরের রুশ নৌ অবরোধ এড়িয়ে শস্য রপ্তানি করতে পারে। কিন্তু এক বছর পর রাশিয়া একতরফাভাবে এই চুক্তি বাতিল করে। কারণ হিসেবে তারা দাবি করে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়নি।
এদিকে এই সপ্তাহের মিউনিখ সম্মেলনে আলোচনা এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন এক দশক আগে ফ্রান্স, জার্মানি, ইউক্রেন ও রাশিয়া বেলারুশের রাজধানীতে একটি শান্তিচুক্তির চেষ্টা করেছিল। সেটির লক্ষ্য ছিল, রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী ও কিয়েভের মধ্যে সংঘাতের অবসান ঘটানো। কিন্তু সেই নাজুক চুক্তিগুলো রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পূর্ব ইউক্রেনের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সুযোগ দেয়, যা কিয়েভের মতে রাশিয়াকে সামরিক প্রস্তুতির জন্য সময় দিয়েছিল এবং পরে ২০২২ সালে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণ চালানোর পথ তৈরি করেছিল।
আরো পড়ুন
শান্তি আলোচনার কাঠামো নির্ধারণে মিত্রদের প্রতি জেলেনস্কির আহ্বান