<p>আমাদের পুরো শরীরের নিয়ন্ত্রণ মেরুদণ্ডের সুস্থতার ওপর নির্ভর করে। সে হিসেবে এটি আমাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের পুরো শরীরের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করে এই মেরুদণ্ড। আর তাইতো মেরুদণ্ডের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের পুরো শরীরেই ব্যথা হয়। স্বাভাবিক নড়াচড়া এবং চলাফেরাও কষ্টদায়ক হয়ে যায়। মেরুদণ্ড সমস্যাগ্রস্ত হলে যে বিষয়টি প্রথমেই পরিলক্ষিত হয়, সেটি হচ্ছে ব্যাকপেইন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অনির্দিষ্ট ব্যাকপেইন শিল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ লোকের হয়ে থাকে। এই ব্যাকপেইনের অন্যতম প্রধান কারণ মেরুদণ্ডের সমস্যা। আবার এই মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়েই আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ু সারা শরীরে বিস্তৃত থাকে। মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই স্নায়ুর ওপরেও চাপ পড়ে, যার কারণে আমাদের ব্যথাসহ অন্য অনেক সমস্যা হতে পারে। তাই মেরুদণ্ডের যত্ন নেওয়া এবং যেসব কাজ করলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলো থেকে সাবধান থাকাটা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।</p> <p> </p> <p>মেরুদণ্ডের গঠন</p> <p>প্রথমেই মেরুদণ্ডের গঠন সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া দরকার। মেরুদণ্ড মূলত বিভিন্ন ধরনের কশেরুকা, মাংসপেশি, লিগামেন্ট এবং কশেরুকার মধ্যবর্তী নরম জেলির মতো পদার্থ বা ডিস্কের সমন্বয়ে গঠিত। দুটি কশেরুকার মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা দিয়ে বের হয় আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলো। এগুলোর কোনো একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভারসাম্য হারাতে পারে মেরুদণ্ড। আবার কশেরুকা, মাংসপেশি, লিগামেন্ট এবং ডিস্ক—এগুলোর সজীবতা রক্ষা করার জন্য দরকার সঠিক রক্ত চলাচল ব্যবস্থা। কোনো কারণে ডিস্কের ওপরে চাপ পড়লে সেটি পরবর্তী সময়ে আমাদের শরীরকে নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুর ওপরে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে। যেহেতু কশেরুকা একটি হাড়, সেহেতু এটির সঠিক গঠন বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘ডি’র প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এগুলোর অভাবেও কশেরুকা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বা ভঙ্গুর হতে পারে। সাধারণত অস্টিওপোরোসিস রোগে এটি ঘটে থাকে। যাদের অস্টিওপোরোসিস থাকে, তাদের রক্তে ভিটামিন ‘ডি’ ও ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কম থাকে, যে কারণে কশেরুকায় সঠিক মাত্রায় ক্যালসিয়াম থাকে না। এ ছাড়া অস্বাভাবিক নড়াচড়া বা মুভমেন্টের কারণে লিগামেন্টস ও মাংস বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হঠাৎ করে অত্যধিক ভার বহন করার কারণেও আমাদের মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।</p> <p> </p> <p>যেসব কারণে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে</p> <p>♦ আঘাতের কারণে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।</p> <p>♦ মেরুদণ্ডে কোনো টিউমার হলে অথবা অন্য জায়গার কোনো টিউমার মেরুদণ্ডে এলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।</p> <p>♦ ডিজেনারেটিভ ডিস্ক ডিজিজ হলে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।</p> <p>♦ জন্মগত অথবা অন্য কোনো কারণে মেরুদণ্ড অস্বাভাবিক বাঁকা হয়ে গেলে।</p> <p>♦ মেরুদণ্ডের কশেরুকা হাড় একটির ওপর আরেকটি উঠে গেলে মেরুদণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।</p> <p>♦ রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস অথবা অন্য কোনো কারণে মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক বাঁকা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যেটিকে বলা হয় স্পন্ডিলোসিস।</p> <p>♦ যারা দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ভার বহনের কাজ করে, তাদের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।</p> <p>♦ যারা দীর্ঘদিন ধরে ধূমপান করে, তাদের ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের ডিস্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে এই ক্ষতিগ্রস্ত ডিস্ক এটির স্বাভাবিক জায়গা থেকে বের হয়ে এসে আমাদের শরীর নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুকে চাপ দিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।</p> <p>♦ যারা অস্টিওপোরোসিস সমস্যায় ভুগে থাকে, তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো সময় মেরুদণ্ড হালকা ভাঙার আশঙ্কা থাকে।</p> <p> </p> <p>মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখার কৌশল</p> <p>সঠিক ঘুমের পদ্ধতি : যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখনো আমাদের মেরুদণ্ড অনেক কাজ করে থাকে। মেরুদণ্ডকে সজীব রাখার জন্য এটির প্রয়োজনীয় উপাদান রক্তের মাধ্যমে পেয়ে থাকে। আমাদের ঘুমের সময় যদি মেরুদণ্ড ও শরীরের অন্যান্য সংযোগস্থলে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় না থাকে, তাহলে মেরুদণ্ডের রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। এর ফলে মেরুদণ্ডের হাড়, কশেরুকা, মাংসপেশি ও লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে একসময় শরীরে ব্যথার সমস্যা তৈরি হয়। তাই সঠিক ঘুমের পদ্ধতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি সাধারণ কৌশল হলো ঘাড়ের নিচে বালিশ দিয়ে ঘুমানো। যদি চিত হয়ে ঘুমাতে চান, তাহলে হাঁটুর নিচে একটি বালিশ দিলে ভালো হয়। কাত হয়ে ঘুমালে দুই হাঁটুর মাঝখানে বালিশ বা কোলবালিশ ব্যবহার করা উত্তম। ঘুমানোর সময় অতিরিক্ত শক্ত ম্যাট্রেস বা অতিরিক্ত নরম ম্যাট্রেস ব্যবহার করা ঠিক নয়। মাঝারি ধরনের নরম ও মেডিকেটেড ম্যাট্রেস ব্যবহার করাই উত্তম। আমাদের সঠিক ঘুমের কৌশলের মাধ্যমে মেরুদণ্ডে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকে এবং সারা দিন সে যে লোড নেয়, সেটি ওভার কাম করে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে পারে।</p> <p>মাংসপেশির স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ : মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখার জন্য মাংসপেশির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিয়মিত মাংসপেশির ব্যায়াম মেরুদণ্ডের মাংসপেশিকে স্বাভাবিক রাখতে এবং অতিরিক্ত ভার নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ সাহায্য করে। ব্যায়ামের মাধ্যমে মাংসপেশির রক্ত চলাচল বেড়ে যায়, যার ফলে মেরুদণ্ডের হাড় এবং ডিস্ক তাদের সজীব থাকার উপাদান যথাযথভাবে পেতে পারে।</p> <p>সঠিক জুতা ব্যবহার করা : আমাদের শরীরের ভার পা দিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে নিউট্রালাইজ হয়। সাধারণত অস্বাভাবিক ধরনের উঁচু জুতা বা সামনে-পেছনে উঁচু-নিচু জুতা ব্যবহার করার কারণে আমাদের পুরো শরীরের ভার সঠিকভাবে নিউট্রালাইজ হতে পারে না, যে কারণে মেরুদণ্ডের ওপরে চাপ তৈরি হতে পারে। এ জন্য সঠিক মাপের নরম ও হালকা উঁচু জুতা ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে হাইহিল ব্যবহার মেরুদণ্ডের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।</p> <p>সঠিক নিয়মে বসে কাজ করার পদ্ধতি : যাঁরা দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মে বসে কাজ করার পদ্ধতি জেনে নেওয়া খুবই জরুরি। চেয়ারের পেছনে-সামনে বাঁকানো ব্যাক রেস্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ না করে মাঝেমধ্যে পাঁচ মিনিটের জন্য একটু হেঁটে আবার বসে কাজ করা যেতে পারে। বসার জায়গা অত্যন্ত শক্ত বা অধিক নরম না করে শক্ত কাঠের চেয়ারে হালকা কুশন ব্যবহার করা যেতে পারে। বসে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে নিজের শরীরকে ডানে এবং বাঁয়ে ঘুরিয়ে কিছুটা স্ট্রেস ফ্রি করা যেতে পারে।</p> <p>ধূমপান বর্জন করা : দীর্ঘদিন ধূমপান করার কারণে আমাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্তনালিগুলো সংকুচিত হয়। মেরুদণ্ডে রক্তনালিগুলো এমনিতেই সরু। দীর্ঘদিন ধূমপান করার কারণে রক্তনালিগুলো আরো সরু হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের হাড়, মাংসপেশি, ডিস্কের সজীবতা রক্ষাকারী উপাদান সরবরাহ কমে যায়। এর ফলে মেরুদণ্ড মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই ধূমপান বর্জন আপনার মেরুদণ্ডে স্বাভাবিক গঠন বজায় রাখতে খুবই সাহায্য করে।</p> <p> </p> <p>মাথায় রাখতে হবে আরো কিছু বিষয়</p> <p>♦ শরীরের ওজন সঠিক রাখা।</p> <p>♦ সুষম খাদ্য গ্রহণ।</p> <p>♦ ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।</p> <p>♦ নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস করা।</p> <p>♦ বয়োবৃদ্ধদের ঘুমের সঠিক নিয়ম শেখানো এবং মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জয়েন্ট অন্য কাউকে দিয়ে নড়াচড়া করিয়ে নেওয়া।</p> <p>♦ মাঝেমধ্যে ম্যাসাজ পদ্ধতি গ্রহণ করা যেতে পারে।</p> <p>♦ স্বাভাবিক মাত্রায় পানি পান করা।</p> <p>♦ নিজের শরীরের ওজনের চার ভাগের এক ভাগের (২৫%) বেশি ওজন বহন না করা; যেমন—আপনার ওজন যদি ৬০ কেজি হয়, তাহলে ১৫ কেজির বেশি ওজন বহন না করা।</p> <p> </p> <p>প্রয়োজনে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন</p> <p>♦ হঠাৎ কোনো আঘাত পাওয়ার কারণে ব্যথা অনুভূত হলে।</p> <p>♦ শরীরের কোনো স্থানে টিউমার দেখা দিলে।</p> <p>♦ অল্প সময়ের মধ্যে শরীরের ওজন কমে গেলে।</p> <p>♦ হঠাৎ করে পায়ে অবশ অবশ ভাব অনুভূত হলে।</p> <p>♦ পায়খানা বা প্রস্রাবের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলে।</p> <p>♦ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে মাজায় ব্যথা অনুভূত হওয়া।</p> <p>♦ মাজার ব্যথা পায়ের ডান পাশে বা বাঁ পাশ দিয়ে নিচে নেমে এলে।</p> <p> </p> <p>লেখক : চিফ কনসালট্যান্ট ও ব্যথা বিশেষজ্ঞ</p> <p>বাংলাদেশ সেন্টার ফর রিহ্যাবিলিটেশন, ঢাকা</p>