আর ১৯ জুন থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত খুচরা বাজারে চিনির দর আরো বেড়ে ৬২ থেকে ৬৫ টাকায় উঠেছে।
খুচরা দোকানিরা বলছেন, পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি চিনি কিনতে তাঁদের ৬২ টাকা পড়ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন মিল থেকে চিনির সরবরাহে ঘাটতির কথা। মিল থেকে এক ট্রাক চিনি আনতে তাঁদের ক্ষেত্রবিশেষে কয়েকটি ট্রাকের ভাড়া গুনতে হয়। কারণ, দিনের পর দিন বসে থেকেও চিনি পাওয়া যায় না।
ঢাকায় ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি আড়ত মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১০ ট্রাক চিনি চাইলে পাওয়া যায় দুই ট্রাক। তাও অপেক্ষা করতে হয় দিনের পর দিন। মিল গেটে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে লম্বা লাইনে। মিল থেকে চিনি না পেলে আমরা বাজারে দিব কিভাবে?’
দামের বিষয়ে গোলাম মাওলা বলেন, মিল গেটেই চিনির দাম পড়ে ৫০ টাকা কেজি। তার সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবহন খরচ। সরবরাহে দেরির জন্যও খরচ বাড়ে তাঁদের, ট্রাক বসিয়ে রেখেও প্রতিদিন গুনতে হয় বাড়তি ভাড়া।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে চিনির কোনো সংকট নেই। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (এপ্রিল পর্যন্ত) দেশে মোট চিনি আমদানি হয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ টন। এ ছাড়া সরকারি চিনি কলগুলোয়ও রয়েছে এক লাখ টন চিনি। আর পুরো বছরে চিনির চাহিদা মাত্র ১৫ লাখ টন।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, দেশীয় চিনি শিল্পকে রক্ষায় সরকার আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছিল। তবে এর পরও চিনির কেজি ৬০ টাকার নিচে থাকার কথা। হয়তো আকস্মিকভাবে কেউ কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ধরাও পড়ছে। মিলগুলো ৪৮ টাকা কেজিতে চিনি বিক্রি করে। পাইকাররা কেজিতে দু-তিন টাকা ব্যবসা করলে, খুচরা বিক্রেতা পাঁচ টাকা লাভ করলে, প্রতি কেজির দাম ৫৭-৫৮ টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। কেউ কারসাজি করে দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামে বেশি দামে চিনি বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে সিটি গ্রুপসহ দুটি মিলের বিরুদ্ধে। ঢাকায় পাইকারি বাজারে সিটি গ্রুপ ৪৮ টাকা ৭৬ পয়সা কেজি দরে চিনি বিক্রি করলেও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি মার্কেটে সিটি গ্রুপ চিনির দর নিচ্ছে সবচেয়ে বেশি। গতকাল খাতুনগঞ্জে সিটি গ্রুপ প্রতি মণ চিনি বিক্রি করেছে দুই হাজার ১৩০ টাকায়। অন্য গ্রুপগুলো প্রতি মণ চিনি বিক্রি করেছে এক হাজার ৮৫২ টাকা থেকে দুই হাজার ১০০ টাকায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সিটি গ্রুপ চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে। তাদের দেখানো পথেই হাঁটেন অন্য মিল মালিকরা। সময়মতো চিনি সরবরাহ না করার বেশি অভিযোগও তাঁদের বিরুদ্ধে।
তবে এ অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ ভুয়া’ বলে উড়িয়ে দেন সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বিশ্বজিৎ সাহা। সে ক্ষেত্রে বাজারে অন্য গ্রুপের চিনির চেয়ে সিটি গ্রুপের চিনির দর বেশি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমরা তো কারখানা থেকে ৪৮ টাকা ৭৬ পয়সা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছি। চট্টগ্রামে কেন এত বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে, তা জানি না।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন আমরা দুই হাজার ৮০০ থেকে তিন হাজার টন চিনি সরবরাহ করছি। একটি ট্রাকে ১০ টন চিনি সরবরাহ করলে প্রতিদিন ৩০০ ট্রাক লাগে। আর চিনির জন্য এসে পাইকারি ব্যবসায়ীদের যদি ১০ দিন করে অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে এত ট্রাক কোথায় অপেক্ষা করে? এ ছাড়া প্রতিদিন নিজস্ব ট্রাকে বিভিন্ন দোকানে ৫০ টাকা কেজি দরে ৯০০ টন থেকে এক হাজার টন চিনি সরবরাহ করছে সিটি গ্রুপ।’
চিনির দাম বৃদ্ধির জন্য সরকারের বর্ধিত শুল্ককর আরোপকে দায়ী করে বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আগে প্রতি কেজি চিনিতে সরকারকে শুল্ককর বাবদ দিতে হতো দুই টাকা। এখন দিতে হয় ১৮ টাকা।
গত বছর আগস্টে চিনি আমদানির ওপর ২০ শতাংশ সংরক্ষণমূলক শুল্ক আরোপ করেছে সরকার। এ ছাড়া গত ডিসেম্বরে চিনি আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
এত আগে আরোপিত শুল্ককরের কারণে রমজান মাসে চিনির দর বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের জিএম বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘নতুন করে শুল্ককর আরোপের আগে আমদানি করা চিনি রোজার আগ পর্যন্ত আমরা সরবরাহ করেছি। ফলে তখন দাম কম ছিল। রোজার সময় থেকেই বর্ধিত ট্যারিফে আমদানি করা চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে। ফলে দাম কিছুটা বেড়েছে।’
এস আলম গ্রুপের চিনির একমাত্র বিক্রয় প্রতিনিধি মীর গ্রুপের কর্ণধার আবদুস সালাম বলেন, ‘ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৮ জুন থেকে আমরা ৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বাজারে চিনি বিক্রি করছি। কিন্তু ঢাকার কারখানাগুলো (বিশেষ করে সিটি গ্রুপ) বিক্রি করছে এর চেয়েও অনেক বেশি দামে। ফলে চট্টগ্রামের চিনি ঢাকায় চলে যাচ্ছে।’
তবে প্রতিবছর রোজায় চিনির দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পরও দোষী মিল মালিকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই সরকারের। মোহাম্মদ ফারুক খান বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাকালে রোজায় চিনির দাম আকাশ ছুঁয়েছিল। ওই সময়ও সিটি গ্রুপসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মিল বন্ধ রাখে ওভারহোলিংয়ের নাম করে। তখন মিল মালিকদের শোকজ করা হলেও শুধু একটি চিনি কলের আমদানি লাইসেন্স স্থগিত করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ বছরও রোজার শুরুতে সিটি গ্রুপসহ আরো কয়েকটি চিনিকল মালিক ওভার হোলিংয়ের নাম করে উৎপাদন বন্ধ রেখে বাজারে সরবরাহ সংকট সৃষ্টি করে। তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
বাণিজ্যমন্ত্রী থাকাবস্থায় ফারুক খান জাতীয় সংসদে চিনির দাম বৃদ্ধির পেছনে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি একটি গ্রুপের নাম উল্লেখ করে বলেন, ওই গ্রুপ চিনি আমদানির পর চিনিভর্তি জাহাজটি আর বাংলাদেশে ভেড়ায়নি। বরং বেশি দামে তৃতীয় কোনো দেশে সেই চিনি বিক্রি করে দিয়েছে।
পরে এ বিষয়ে আর কোনো তদন্ত কিংবা আইনি পদক্ষেপ নেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তখন ডিও প্রথা বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করে আইন সংশোধন ও নীতিমালা জারি করা হয়। সে সময় প্রকাশ্যে মিল মালিকদের বলতে শোনা গেছে, দাম বাড়ায় ডিও ব্যবসায়ীরা। তাই ডিও প্রথা বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করলে কোনো অবস্থাতেই পণ্যের দাম বাড়বে না। আর কোনো কারণে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে, এর দায় নেবেন মিল মালিকরা। পরে ডিও প্রথা বাতিল করে পরিবেশক প্রথা চালু করতে গিয়ে সেই মিল মালিকদের বাধার কারণে সেটিও কার্যকর করতে পারেনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও পূর্বাভাস সেলের প্রধান মাসুদুল মান্নান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, চিনির দর নিয়ন্ত্রণে এবার সরকারি চিনিকলের গুদামে থাকা এক লাখ টন চিনি বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নিচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের প্রতি কেজি চিনির দর ৪৮ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভাবছে, এখনই ওই চিনি বিক্রির উপযুক্ত সময়। এতে বেসরকারি মিল মালিকরা চাপে পড়ে সরবরাহ বাড়াবেন। ভোক্তারাও এর সুফল পাবে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে খুব শিগগির সিদ্ধান্ত হবে।