<p>দুই বছর আগেও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা পরিবারগুলো ছিল পরস্পর বিচ্ছিন্ন। সেখানে সভা-সমাবেশ তো দূরের কথা, গ্রামের বাইরে বের হতেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হতো। মিয়ানমার বাহিনীর হামলা থেকে প্রাণে বাঁচতে এ দেশে ছুটে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে অতিথির মতোই স্বাগত জানিয়েছিল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দারা। গত রবিবার সেই রোহিঙ্গারা এক বিশাল সমাবেশে বলেছে, একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ছাড়া তাদের কেউই কখনো ফিরবে না। </p> <p>রোহিঙ্গাদের সুসংগঠিত বিপুল জমায়েত ও কঠোর বক্তব্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মনে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সাড়ে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার কারণে উখিয়া-টেকনাফের প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ স্থানীয় বাসিন্দা বেশ আগেই সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। তাদের জীবন-জীবিকা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও পর্যটনশিল্প—সবই আজ হুমকিতে। এমন প্রেক্ষাপটে দাবিদাওয়া নিয়ে এ দেশেই রোহিঙ্গাদের সংগঠিত হয়ে ওঠা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে।</p> <p>প্রশ্ন উঠেছে, যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি তারা মাত্র দুই বছরে এখানে এত সংগঠিত কিভাবে হলো? শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীকে ইংরেজিতে লেখা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার কারা সরবরাহ করেছে? বিশাল আকৃতির ব্যানারগুলোই বা তারা কোথায় পেয়েছে?</p> <p>জানা গেছে, গত রবিবারের সমাবেশটির আয়োজনের পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। সমাবেশ আয়োজনে রোহিঙ্গাশিবিরের ভেতরে ও বাইরে, এমনকি রোহিঙ্গাশিবির থেকে দূরে ইনানিতেও বৈঠক হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের সহযোগিতা করেছে। রোহিঙ্গাশিবির ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বরত সরকারি প্রতিনিধিরাই এমন কিছু তথ্য ঢাকায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে পাঠিয়েছেন।</p> <p>এদিকে রবিবারের রোহিঙ্গা সমাবেশ নিয়ে একটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও উদ্বেগজনক অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু হয়েছে। জানা গেছে, রেনুলাভ বি কসম্যান নামে এক বিদেশি গত ২৪ আগস্ট বাংলাদেশে আসেন। ওই দিন ঢাকার গুলশানের একটি হোটেলে তাঁর থাকার জন্য কক্ষ বুক করা হলেও তিনি সেদিনই কক্সবাজারের কুতুপালং শিবিরে যান। তাঁর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সমাবেশ আয়োজনে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে। তাঁর সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয়ধারী এক ব্যক্তিও সার্বক্ষণিক ছিলেন। এ ছাড়া সাংবাদিক পরিচয়ধারী অন্য এক বিদেশি নারীও রোহিঙ্গা সমাবেশে তৎপর ছিলেন।</p> <p>রোহিঙ্গা সমাবেশের আয়োজনে বেশ কয়েকটি দেশি-বিদেশি এনজিওর বিরুদ্ধেও সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের মুক্তি নামের একটি এনজিওর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে যে তারা রোহিঙ্গাদের নগদ অর্থ ছাড়াও সমাবেশের প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুন প্রদানসহ নানাভাবে সহায়তা করেছে। তবে এনজিওটির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রণজিত দাশ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।’</p> <p>সমাবেশ আয়োজনে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে আরেকটি স্থানীয় বিতর্কিত এনজিও পালস, বিদেশি এনজিও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যানিটারা, হেলবিটাচসহ আরো কয়েকটির সংস্থার কর্মীদের বিরুদ্ধেও। তবে পালসের নির্বাহী সাইফুল ইসলাম কলিমসহ অন্যরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমাবেশ আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত রোহিঙ্গা নেতা সিরাজুল মোস্তফাও অস্বীকার করেছেন সমাবেশ আয়োজনে কোনো অর্থ পাওয়ার কথা।</p> <p>এসব বিষয়ে কক্সবাজারে এনজিওর কর্মকাণ্ড তদারকির দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রবিবারের রোহিঙ্গা সমাবেশটি কিভাবে এবং কার ইশারায় আয়োজন করা হয়েছে সবার আগে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। সমাবেশটি আয়োজনে বেশ কিছু এনজিওর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আমরা তদন্ত করে দেখছি।’ তিনি বলেন, অভিযোগ সত্য হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।</p> <p>এদিকে গতকাল সোমবার কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাশিবিরের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির জন্য রোহিঙ্গা সংকট দেখভালকারী প্রশাসনকে দায়ী করেছেন। সভায় অভিযোগ ওঠে, রোহিঙ্গাশিবির ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বরতরা রোহিঙ্গা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুবিধাগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন সম্ভব কি না তা নিয়েও প্রশ্ন করেন অনেকে। </p> <p>এ বিষয়ে উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘‘আমরা মনে করি, গত রবিবারের রোহিঙ্গা সমাবেশ এই দেশের জন্য হুমকি। রোহিঙ্গারা আমাদের ‘রেড সিগন্যাল’ দেখিয়েছে। দুই বছর আগে আমরা মানবতার কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম, কিন্তু সেই মানবতাই এখন আমাদের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।” তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গারা এখানে অবস্থান নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবই দখলে নিয়েছে। তাদের কাছেই এখন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ও অস্ত্রশস্ত্র।</p> <p>হামিদুল হক চৌধুরী আরো বলেন, ‘রবিবারের সমাবেশ নিয়ে যদি যৎসামান্য গণ্ডগোল হতো তাহলে এলাকায় কী রক্তাক্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।’</p> <p>কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলায় ২০টি রোহিঙ্গাশিবিরে আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বিশাল শোডাউনের পরের দিন সংগত কারণেই উখিয়া উপজেলা পরিষদের স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিসহ সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত সভাটি ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সভায় পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গা নিয়ে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একে একে দুইবারের নির্ধারিত প্রত্যাবাসনও ভেস্তে গেছে।’ সভায় উপজেলা পরিষদের দুজন ভাইস চেয়ারম্যান ও আরো চারজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রোহিঙ্গাদের কর্মকাণ্ড, রবিবারের সমাবেশ এবং রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্ত প্রশাসনের কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।</p> <p>প্রশ্ন উঠেছে, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশ প্রশাসনকে না জানিয়ে রোহিঙ্গাশিবিরের ইনচার্জ (ক্যাম্প ইনচার্জ, সংক্ষেপে সিআইসি) কিভাবে রবিবার পাঁচ লাখ লোকের সমাবেশ করার অনুমতি দেন? অভিযোগ উঠেছে, রোহিঙ্গাদের সমাবেশ দেখিয়ে বিদেশিদের খুশি করানোর জন্যই ছিল এমন আয়োজন।</p> <p>সবচেয়ে বড় সমাবেশটির আয়োজন করা হয়েছিল কুতুপালং ৪ নম্বর শিবিরের বর্ধিতাংশের খোলা মাঠে। শিবিরটির দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারের উপসচিব শামিমুল হক পাভেলের (সিআইসি) কাছে সমাবেশের অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে অনুমতি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেন। পরে কালের কণ্ঠের কাছে এসংক্রান্ত তথ্য থাকার কথা জানালে তিনি অনুমতি দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ছোটখাটো সমাবেশ করার কথা ছিল।</p> <p>কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আসা রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ গত ২২ আগস্ট তিন থেকে পাঁচ লাখ লোকের সমাবেশ করতে লিখিতভাবে আবেদন করেছিলেন। সেদিনই সিআইসি শামিমুল হক ওই আবেদন মঞ্জুর করে স্বাক্ষর করেন।</p> <p>উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাগ্যিস শিবিরে সমাবেশে কোনো বড় ধরনের গণ্ডগোল হয়নি। যদি হতো, তাহলে নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আমার ওপরই দায় বর্তাতো। তবে রোহিঙ্গা প্রশাসনের কেউই আমাকে সমাবেশ আয়োজনের কথা বলেনি।’</p> <p>কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে সমাবেশ আয়োজনের কথা বলা হয়নি। তবে শুনেই আমি আরআরআরসি স্যারের কাছে আমার উদ্বেগের কথা জানাই। জবাবে আরআরআরসি বলেন, কোনো অসুবিধা হবে না। এ রকম সমাবেশ আয়োজনে বিদেশিরা খুশি হবেন।’ তবু সমাবেশ আয়োজন দেখে পুলিশ যথাযথ প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা নিয়েছিল বলেও পুলিশ সুপার জানান। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বলেছেন, এমন সমাবেশের কথা তাঁদেরও জানানো হয়নি।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজারের সরকারি কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানান, রোহিঙ্গা সংকট দেখভালকারী প্রশাসনের সঙ্গে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সমন্বয় নেই। শুধু প্রত্যাবাসনের দিন নির্ধারণ করা হলে টাস্কফোর্স কমিটির একটি নামমাত্র বৈঠক হয়। রোহিঙ্গাশিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সংকটে লাভবান হওয়ারও নানা অভিযোগ আছে।</p> <p>স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসনে পাঠানো বার্তায় রোহিঙ্গাশিবিরে কর্মরত বিতর্কিত দুজন সিআইসির বিরুদ্ধে গোয়েন্দা শাখার বারবার নেতিবাচক রিপোর্ট পাঠানোর তথ্য জানানো হয়, কিন্তু তার পরও অজ্ঞাত কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।</p> <p>এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের বলেন, গত রবিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সমাবেশের বিষয়টি তাঁরা জানতেন না।  রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে যেন এমনটা না করতে পারে, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে বলেও তিনি জানান।</p> <p>রোহিঙ্গাদের অপরাধ ঠেকাতে ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রস্তাব পুলিশের : বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। খুন-ধর্ষণ থেকে শুরু করে চুরি-ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ মাদক কারবারেও জড়িয়ে পড়ছে তারা। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের অপরাধপ্রবণতা ঠেকানো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ পটভূমিতে রোহিঙ্গাদের অপরাধ ঠেকাতে ক্যাম্পের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছে পুলিশ। ক্যাম্প এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।</p> <p>সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরে। প্রতিবেদনে অন্যান্য প্রসঙ্গের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার বিষয়টি তুলে ধরে তা নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের কথা বলা হয়েছে।</p> <p> </p>