আবার একই বছরের জুনে ১৭টি সেচ প্রকল্পের ম্যানেজারের নামে চার লাখ ৫৩ হাজার ৬১০ ইউনিট বিল করা হয়। চার টাকা ১৬ পয়সা হিসাবে যার মূল্য দাঁড়ায় এক কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ১৭ টাকা। বিলের এ টাকাও লেজার থেকে গায়েব।
বিপিডিবির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, মহাব্যবস্থাপকসহ উচ্চ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাহী প্রকৌশলী বিলের লেজার শূন্য করার এখতিয়ার রাখেন না। এটা অবৈধ। যথাযথ অনুমোদন ছাড়া সঞ্চালন লাইনও সম্প্রসারণ করতে পারেন না।
বৈধতা ছাড়াই সঞ্চালন লাইন
বাজিতপুরে পাউবোর আওতাধীন এলাকায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বা দরপত্র আহবান ছাড়াই কমপক্ষে দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন (১১-কেভি) বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে। এর একটি উপজেলার পিরিজপুর বাজার থেকে ভৈরব-ময়মনসিংহ আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে গজারিয়া পর্যন্ত। অপরটি সরারচর-পিরিজপুর সড়কের মধ্য দলদলিয়া সেতু থেকে বিলপাড় জোয়ারিয়া পর্যন্ত। প্রথমটি ৬০ খুঁটির এবং দ্বিতীয়টি প্রায় ১৬ খুঁটির লাইন। দুটি লাইনের দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিমি।
পিডিবির বাজিতপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মর আলী দাবি করেছেন, লাইনের জন্য কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী) আসনের সংসদ সদস্য মো. আফজাল হোসেন ডিও লেটার (আধাসরকারিপত্র) দিয়েছেন। এমপি সাহেবের সম্মান রক্ষার জন্যই লাইনটি করা হয়েছে।
এমপি মো. আফজাল হোসেন ডিও লেটার দেওয়ার কথা অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই অননুমোদিত লাইনের জন্য আমি ডিও লেটার দিইনি। না বুঝে কখনোই কোনো ডিও লেটার দিই না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশেষ সুবিধা নিয়ে ‘আরআরপি ইউনিক ফুড’ মিলে সংযোগ দিতে টেন্ডার ছাড়াই ৬০ খুঁটির লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলেছে, এ ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন হয়েছে কমপক্ষে ৩৯ লাখ টাকা। লাইনটি বিউবোর প্রকল্পের আওতাভুক্ত নয়। এ ব্যাপারে কোনো দরপত্রও আহবান করা হয়নি।
বিউবোর তালিকাভুক্ত ঠিকাদার মেসার্স রায় ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী ছানা রায় বলেন, ‘টেন্ডার ছাড়া লাইন হয় কিভাবে?’
বিউবোর বাজিতপুর অফিসের লাইন হেলপার দুলাল ফরাজীর ভাষ্য, আরআরপির ম্যানেজার সাদেক তাঁর সঙ্গে প্রথমে লাইনটি নেওয়ার ব্যাপারে কথা বলেন। পরে তাঁকে বাদ দিয়ে সাদেক আরেক লাইন হেলপার মনিরের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে চুক্তি করেন।
তবে আরআরপির ব্যবস্থাপক এ বি এম সাদেকুর রহমান বলেন, বিশেষ এ লাইনের জন্য তাঁর কম্পানি কোনো ঘুষ লেনদেন করেনি। ব্যাংকে কেবল সংযোগ নেওয়ার টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। শুধু আরআরপি পর্যন্ত লাইন টানার কারণ জানতে চাইলে তিনি নিরুত্তর থাকেন।
দেখা যায়, বিলপাড় জোয়ারিয়ার লাইনটির দৈর্ঘ্য প্রায় তিন কিমি। প্রায় অর্ধেক লাইনের তারই গাছে বেঁধে টানানো। আবার পাঁচ-ছয় ফিট উঁচু আরসিসি পিলারেও লাইনের তার বাঁধা। স্থানীয়রা বলছেন, হাতের নাগালের কাছেই লাইনের তার থাকায় যেকোনো মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
জোয়ারিয়া হাটের রাইস মিল মালিক শফিকুল ইসলাম জানান, লাইনটি নিতে তাঁদের সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এই লাইন থেকেই তিনটি সেচ প্রকল্প ও একটি পোলট্রি ফার্ম চালানো হচ্ছে। খুঁটি ও তারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম পিডিবি দিয়েছে। অফিসের লাইন সাহায্যকারী (হেলপার) মনির হোসেন লাইনের কাজ করে দিয়েছে।
যাদের টাকা লেজার থেকে উধাও
অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যুৎ চুরির কারসাজি সামলাতে নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের নামে ভুয়া ইউনিট দেখিয়ে মোটা অঙ্কের বিদ্যুৎ বিল করে তা পরে মুছে দেওয়া হয়। অনেকে এ কারসাজির কথা জানেনও না।
উপজেলার লৌহগাঁওয়ের কৃষক মো. নান্নু মিয়া একটি সেচ প্রকল্প চালাতেন। তিন বছর আগেই তিনি সেচ প্রকল্পের লাইন (গ্রাহক নং-৭৩২৯৪৯৪০) বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর নামে ২০২২ সালের জানুয়ারি-এপ্রিল এ চার মাসে মোট তিন লাখ ৯৩ হাজার ৫৪৮ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ দেখিয়ে ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৭৪ হাজার বিল করা হয়েছে। এ তথ্য মো. নান্নু মিয়ার কাছে নেই।
চার মাসে প্রায় ১৫ লাখ টাকার বিল এসেছে শুনে কৃষক মো. নান্নু মিয়া আকাশ থেকে পড়েন। তিনি জানান, এর আগের বছরই (২০২১) বোরো মৌসুম শেষে প্রকল্প বন্ধ করে দেন। এরপর আর চালাননি। এত টাকা বিল করায় তিনি বলেন, ‘আমি তো মিটার জমা দিয়া লাইন বন্ধ কইরা দিছি। আমার নামে বিল আইব ক্যান?’
উপজেলার হাওরপারের জেলেপল্লীর কচুয়াখোলা গ্রামের স্বপন চন্দ্র দাসের সেচ প্রকল্পের অনুকূলে (গ্রাহক নং-৭৩২৫৮১০৭ ও ৭৩২৫৮০৯৪) দুটি সংযোগে বিল করা হয় মোট এক লাখ ৯০ হাজার ইউনিট। যার মূল্য ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৬৬৬ টাকা। স্বপন চন্দ্র দাসের তথ্য মতে, কর্মকর্তারা তাঁর নামে আসা বিলের টাকার মোটা অঙ্কের ভাগ চেয়েছিলেন। তিনি দিতে রাজি না হওয়ায় পরে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন।
কুকরারাই গ্রামের কৃষক মো. ফজলু মিয়ার নামে (গ্রাহক নং-৭৩২৫৮৪৯৯) বিল করা হয় এক লাখ ৬৪ হাজার ৩৩৩ ইউনিটের। যার মূল্য ৯ লাখ ৬১ হাজার ৮৪৫ টাকা। এই দুজনের লেজার থেকেও টাকা বাদ দেওয়া হয়েছে।
কথিত ‘নিখোঁজ’ গ্রাহকদের ভুয়া তালিকা
অফিসের লেজার বুকের কোটি কোটি টাকা রহস্যজনকভাবে গায়েবের ঘটনা নিয়ে কালের কণ্ঠ অনুসন্ধান শুরুর পর বাউবো বাজিতপুর অফিস কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। তারা তৎপর হয়ে ২৮৭ জন কথিত ‘নিখোঁজ’ গ্রাহকের একটি তালিকা তৈরি করে বিউবোর কেন্দ্রীয় মহাব্যবস্থাপকের (বাণিজ্যিক পরিচালন) কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। এই তালিকাটিও কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে।
প্রি-পেইড মিটারে ঘুষের অভিযোগ
বাজিতপুর বিউবোর তথ্য অনুযায়ী, সেখানে গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। গ্রাহকদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য দেওয়া প্রি-পেইড মিটার থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগে বলা হয়, ‘মিটার চার্জ’ বাবদ প্রত্যেক গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে তিন-চার হাজার টাকা। অফিসের জন্য বরাদ্দ প্রায় চার হাজার মিটার থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে।
সহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুল হাসানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বাজিতপুর পৌর শহরের মথুরাপুরের গ্রাহক কৃষক মো. বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘অফিসের ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদ স্যার আমার বাড়িতে দুইটা প্রি-পেইড মিটার পাল্টে দিয়ে আট হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।’
অভিযোগ অস্বীকার করে সহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুল হাসান বলেন, বললেই তো আর হলো না। প্রমাণ দেখাক তারা।
নির্বাহী প্রকৌশলীর অনিয়ম তদন্তে কমিটি
নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে বিপিডিবির মহাব্যবস্থাপকের দপ্তর (বাণিজ্যিক পরিচালন) চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এতে বিউবোর ময়মনসিংহ অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক চন্দন কুমার দে ও ঢাকার উপপরিচালক মাকসুদা খাতুনকে যথাক্রমে কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব করা হয়েছে।
বিউবো ঢাকার এনার্জি অডিটিংয়ের সিনিয়র সহকারী পরিচালক চৌধুরী হাসান শরীফ ও বাজিতপুর অফিসের সহকারী প্রকৌশলী তৌহিদুল হাসানকে কমিটিতে সদস্য রাখা হয়। কমিটিকে সব অভিযোগ তদন্ত করে সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির আহ্বায়ক চন্দন কুমার দে গত শুক্রবার কালের কণ্ঠকে জানান, কমিটি তদন্ত কাজ শুরু করেছে। যথাসময়ে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। কমিটির এক সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকার তথ্য পেয়ে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।’
অভিযোগের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর ভাষ্য
নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ আলী তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অনিয়ম ও দুর্নীতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। দরপত্র আহবান না করে এবং যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে ১০ কিমি সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, এর একটি লাইন বার্ষিক কর্মপরিকল্পনায় (এপিপি) আছে।
‘লেজার বুক থেকে কোন ক্ষমতাবলে কোটি কোটি টাকা উধাও করলেন? কাজটি কি অবৈধ নয়?’
এমন প্রশ্নের উত্তরে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, ‘এগুলো টেম্পরারিলি ডিস-কানেক্টেড (সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন) করে রাখা হয়েছে। বিল মওকুফ করা হয়নি। এসব হচ্ছে পুঞ্জীভূত বকেয়া। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তথা বোর্ডের নির্দেশে লেজার বুক জিরো করে রাখা হয়েছে।’
লেজার বুক খালি করার বিষয়ে বোর্ডের নির্দেশের কপি চাইলে তিনি তা দিতে অস্বীকার করেন। এ ছাড়া দাপ্তরিক কোনো নির্দেশের কপি দেখাতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে বিউবোর ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল-২) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘লেজার বুক শূন্য করে দেওয়ার জন্য কোনো নির্দেশনা নেই।’
বিউবোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভাষ্য
বিউবোর সূত্র জানায়, লাইনটি বৈধ ও অনুমোদিত হলে ১২ মিটার উচ্চতার বেশি উঁচু খুঁটি স্থাপনের কথা নয়। এ ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছে।
এ বিষয়ে বিউবোর ময়মনসিংহ বিভাগীয় কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিচালন ও সংরক্ষণ সার্কেল-১) এ কে এম জসীম উদ্দিন বলেন, ‘টেন্ডার প্রক্রিয়ার বাইরে এত বড় সঞ্চালন লাইন নির্মাণের সুযোগ নেই। এটি অবৈধ।’
বিউবোর চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের চিফ স্টাফ অফিসার (সিএসও) প্রকৌশলী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে বড় কোনো সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। লেজার শূন্য করারও কোনো এখতিয়ার নেই তাঁর (নির্বাহী প্রকৌশলীর)।