এর পশ্চিম দিকে কোতোয়ালি থানা এলাকায় নদীর পানি রাস্তায় উঠে এসেছে। এ ছাড়া নগরের তোপখানা, সিলেটের সবচেয়ে বড় আড়ত কালীঘাট এলাকা, কাজির বাজার, কাষ্টঘর, সোবহানীঘাট, মাছিমপুর, মেন্দিবাগ, উপশহর তেরোরতন, যতরপুর, সোনারপাড়া, খাঁরপাড়া, তালতলা, জামতলাসহ বিভিন্ন এলাকা জলমগ্ন হয়ে আছে। কোতোয়ালি থানা প্রাঙ্গণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সিলেট কার্যালয় প্রাঙ্গণসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠানের উঠানে পানি জমে আছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান মঙ্গলবার রাতে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে নগরবাসীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘বন্যার্তদের শুকনা ও রান্না করা খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। যত দিন বন্যার পানি না কমছে, তত দিন আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এক মিনিটের জন্যও আমাদের কার্যক্রম বন্ধ হবে না।’
বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে বলে মেয়র জানান। এর আগে সিটি করপোরেশনের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে সিসিক।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের সব কটি বন্যাকবলিত, ২২৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছে এক লাখ ২৩ হাজার ৮০০ মানুষ। এর মধ্যে বিছনাকান্দি, রুস্তমপুর, নন্দিরগাঁও ও তোয়াক্কুল ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে ইউনিয়নগুলোর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উপজেলায় এখন চলাচলের একমাত্র বাহন হচ্ছে নৌকা। উপজেলার বেশির ভাগ বিদ্যালয় ও কলেজ প্লাবিত হয়েছে। তবে গতকাল দুপুর থেকে গোয়াইনঘাটে বন্যার পানি কিছুটা কমেছে।
কানাইঘাট উপজেলার চতুল-দরবস্ত সড়ক, গাজী বোরহান উদ্দিন সড়ক, কানাইঘাট-শাহবাগ সড়ক, সুরইঘাট-কানাইঘাট সড়কের নিচু এলাকা দিয়ে বন্যার পানি তীব্র বেগে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভার প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামীণ রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে, শত শত বাড়িঘরে বন্যার পানি ঢুকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, বিশ্বনাথ, জকিগঞ্জ. ফেঞ্চুগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমা, বালাগঞ্জ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার সব কটি ইউনিয়ন কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলার শাহবাগ কলেজের পাশে মঙ্গলবার রাতে জাল তুলতে গিয়ে পানিতে পড়ে নিখোঁজ হন হালিম আহমদ (৩০)। পরের দিন সকালে তাঁর লাশ উদ্ধার করেন ডুবুরিরা।
জলমগ্ন ১২ হাজার হেক্টর ফসলি জমি
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার ২০ হাজার ৩৮৪ হেক্টর জমির ফসলের মধ্যে প্লাবিত হয়েছে ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টরের ফসল। এর মধ্যে রয়েছে আউশ ধান, বীজতলা, গ্রীষ্মকালীন সবজি ও বোনা আমন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ আনিছুজ্জামান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সব পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা
বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকে থাকায় সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ঈদের পরদিন দুপুরে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন প্রথমে তাদের পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করে। পরে বাকিগুলোও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। জাফলং, রাতারগুল, সাদা পাথর, বিছনাকান্দির মতো প্রসিদ্ধ পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে পানি ঢুকে টইটুম্বুর হয়ে আছে।
বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শনে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী
গতকাল বুধবার বিকেলে সিলেট নগর ও বন্যাকবলিত উপজেলা পরিদর্শন করেন দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান এমপি। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখছেন।’

সুনামগঞ্জে চার লাখ মানুষ পানিবন্দি
পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে সুনামগঞ্জের ৭৮টি ইউনিয়ন এবং তিনটি পৌরসভার প্রায় এক হাজার ১৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ ৯০ শতাংশ সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। সড়ক বিভাগের সুনামগঞ্জ-ছাতক সড়ক ডুবে যাওয়ায় যান চলাচলও বন্ধ। সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের বিভিন্ন অংশ ডুবে গেছে।
জেলা প্রশাসক রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, ‘প্রায় চার লাখ মানুষ কবলিত হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। ২৭২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রস্তুত আছে সর্বমোট ৫৩৬টি আশ্রয়কেন্দ্র।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামসুল করিম জানান, তিন হাজার পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, বন্যায় প্রায় ৯০ শতাংশ সড়ক তলিয়ে এখন যান চলাচল বন্ধ। মানুষজন নৌকা করেই যাতায়াত করছে।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জানান, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা ও সুনামগঞ্জ সদর উপজেলাসহ ছাতক ও সুনামগঞ্জ পৌরসভা। এই দুটি পৌরসভার ৮০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে বন্যার সময় বৈদ্যুতিক কাজ করতে গিয়ে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ইলেকট্রিশিয়ান সৌরভ মিয়া মঙ্গলবার রাতে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন।
তাহিরপুর উপজেলার নিচু এলাকায় অবস্থিত ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় পানি উঠেছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বন্যার পানি ঢুকেছে। প্রবল ঢেউয়ে হাওরপারের বসতভিটা ভাঙনে পড়েছে।
মৌলভীবাজারে ৩৩২টি গ্রাম প্লাবিত
জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে ছয়টি উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়নের ৩৩২টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে এক লাখ ৯৩ হাজার ৯৯০ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কুশিয়ারা, মনু, ধলাই, জুড়ী নদী, সোনাই নদী, ফানাই নদীসহ সব কটি নদীর পানি এখন বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গতকাল বুধবার দুপুর ১টার দিকে ধলাই নদীর পানি বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে মাতারকাপন গ্রামসহ লোকালয়ে প্রবেশ করছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সদর উপজেলার শেরপুর এলাকার পশ্চিম পার অতিক্রম করে হামরকোনা, ব্রাহ্মণগাঁওসহ আশপাশের গ্রামের ভেতরে পানি প্রবেশ করে মানুষের ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু, সহায় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দিন ও রাতে থেমে থেমে বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
সদর উপজেলার চাঁদনী ঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আখতার উদ্দিন জানান, গ্রামের স্থানীয় বাজারের দোকানদারদের মালপত্র নিরাপদে সরিয়ে নিতে আহবান জানানো হয়েছে।
গতকাল দুপুরে কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের চৈত্রঘাট ও সদর ইউনিয়নের চৈতন্যগঞ্জ গ্রামে বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে এবং ধলাই নদীর ভাঙনে খুশালপুর গ্রাম এবং কমলগঞ্জ পৌরসভার ও থানার বহু বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে।
বড়লেখা উপজেলায় বন্যাকবলিত হয়েছে ১০টি ইউনিয়নের ২৫২ গ্রাম। ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ। এতে প্রায় এক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২২টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত ২২০টি পরিবারের ৬০০ মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে।
হবিগঞ্জ : খোয়াই কুশিয়ারা ও কালনী-কুশিয়ারাসহ সব নদীর পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কুশিয়ারার বাঁধ উপচে নবীগঞ্জ উপজেলার ১০-১২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার জালালাবাদ গ্রামে খোয়াই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। হবিগঞ্জ শহরের প্রধান সড়কের বেশ কিছু এলাকা ডুবে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সার্কিট হাউসসহ শহরের অনন্তপুর, মাহমুদাবাদ, শ্যামলীসহ অনেক এলাকার লোকজন হয়ে পড়েছে পানিবন্দি।

কুড়িগ্রাম : তিস্তা ও দুধকুমারের পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিপত্সীমার খুব কাছ দিয়ে বইছে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল দুপুরে দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার এবং তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ২০ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
রাজারহাট ও নাগেশ্বরী উপজেলার ১২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়। সবজিক্ষেত তলিয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম সদর, রাজারহাট ও রৌমারীর কয়েকটি পয়েন্টে নদীভাঙনে গৃহহীন হয়েছে ২০টি পরিবার। ঝুঁকিতে পড়েছে বাঁধ, বাজার, ফসলি জমি ও বাড়িঘর।
রংপুর : তিস্তা নদীর কাউনিয়া পয়েন্টে পানি বিপত্সীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রাস্তাঘাট ডুবে বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলায় ১০ গ্রামে পানি ঢুকে পড়ছে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, বুধবার সকাল ৬টায় কাউনিয়া পয়েন্টে বিপত্সীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং সকাল ৯টায় ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়েছে। তলিয়ে গেছে পাঁচ গ্রামের বেশির ভাগ এলাকা।
জেলা প্রশাসক মোবাশ্বের হাসান জানান, রাতভর বৃষ্টির ফলে অনেক স্থানে পানি উঠেছে। নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে খোঁজখবর নেওয়ার। অতি দ্রুত তাদের কাছে সরকারিভাবে সহযোগিতা ও সাহায্য দেওয়া হবে।
পীরগাছা উপজেলার কয়েক শ কৃষকের বাদাম এখন তিস্তার পানির নিচে। অনেকেই পানির নিচে থেকে বাদাম তুলে নৌকাযোগে নিয়ে এলেও তিন দিন থেকে সূর্যের মুখ দেখা না যাওয়ায় তা শুকাতেও পারছেন না।
নেত্রকোনা : গতকাল দুপুরে কলমাকান্দা উপজেলার উপদাখালী নদীর পানি বিপত্সীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারওয়ার জাহান জানিয়েছেন, জেলার প্রধান নদী উপদাখালী, কংস, সোমেশ্বরী, ধনুসহ সব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সীমান্তবর্তী সোমেশ্বরীর দুই পার উপচে পড়ার অবস্থা।
জেলা প্রশাসক শাহেদ পারভেজ জানান, বন্যার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শুকনা খাবার ও টাকা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পানি বাড়ায় প্রশাসন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
শেরপুর : সীমান্তবর্তী নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই, চেল্লাখালী, ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি ও সোমেশ্বরী নদী পাহাড়ি ঢলের পানিতে টইটুম্বুর হয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও শেরপুর সদর উপজেলায় নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। বিশেষ করে মহারশি, চেল্লাখালী ও ভোগাই নদীর কাঁচা বাঁধের পুরনো ভাঙনকবলিত স্থানগুলো দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবেশ করে এলাকার ফসলি জমি তলিয়ে যেতে পারে। এ জন্য ওই সব এলাকার সবজি, কলা এবং মৎস্য চাষিরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।