<p>বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘তরুণসমাজের অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি বিশ্বসম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।’</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৭৯তম অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এসব কথা বলেন এবং তাঁর প্রত্যাশার কথা জানান।</p> <p>বাংলাদেশ সময় গতকাল শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টায় মুহাম্মদ ইউনূসের এই ভাষণ শুরু হয়। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতেই আজ আমি বিশ্বসম্প্রদায়ের এই মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণসমাজের অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্রকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।’</p> <p>জাতিসংঘ সদর দপ্তরের জেনারেল অ্যাসেম্বলি হলে সাধারণ আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা তাঁর এই ভাষণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন।</p> <p>কী পরিস্থিতিতে তিনি সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন, তাসহ পরিবর্তিত সময়ে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম, রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিষয় তাঁর ভাষণে স্থান পেয়েছে।</p> <p>এ বছরের ইউএনজিএর মূল প্রতিপাদ্য ‘কাউকে পিছিয়ে রাখা নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য শান্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং মানবমর্যাদার অগ্রগতিতে একসঙ্গে কাজ করা’।</p> <p>প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশন ও অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছেন।</p> <p>তিনি জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।</p> <p>ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের ছাত্র ও যুবসমাজের আন্দোলন প্রথম দিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কিভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের ছাত্র-জনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। তাদের এই সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই আমাদের দেশের ভবিষ্যত্ নিহিত, যা এ দেশটিকে বিশ্বসম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’</p> <p>প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই গণ-আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধাবঞ্চিত বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারি চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উত্সর্গ করেছিল।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের এই তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে, তা আমাদের অভিভূত করেছে। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের এই তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। জনগণের এই আন্দোলনে আমাদের জানা মতে, ৮০০-এরও বেশি জীবন আমরা হারিয়েছি স্বৈরাচারী শক্তির হাতে।’</p> <p>ড. ইউনূস বলেন, ‘দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা গভীর বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে মুখোমুখিভাবে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, কিভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, কিভাবে জনগণের অর্থসম্পদকে নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল, কিভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সব ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এককথায় কিভাবে প্রতিটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দল এখন স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহি নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার।’</p> <p>ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে—এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘আমাদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশের গণ-আন্দোলনকালে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান এবং এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পরামর্শ প্রদানের জন্য একটি ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন গঠন এবং তার কাজ শুরু করার জন্য দ্রুত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি তাঁকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’</p> <p>প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দায়িত্বভার গ্রহণের দুই সপ্তাহের মধ্যে আমরা গুম প্রতিরোধে যে আন্তর্জাতিক কনভেনশন রয়েছে, তাতে যোগদান করেছি। এর আশু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দেশীয় আইন ও বিধি প্রণয়ন বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিগত দেড় দশকে যেসব গুমের অভিযোগ রয়েছে, সেগুলো তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত কমিশন এ মুহূর্তে কাজ করছে।</p> <p>জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের সবার অস্তিত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এই গ্রীষ্মে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকারী দাবদাহ আমাদের জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কথা স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবগুলো অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছি, প্যাথোজেনের পরিবর্তনের ফলে নতুন রোগ বাড়ছে, কৃষি ক্ষেত্রে চাপ বাড়ছে, ক্রমহ্রাসমান পানিসম্পদ ঝুঁকিতে ফেলছে আমাদের বাসযোগ্যতাকে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা আমাদের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করছে প্রতিনিয়ত। আমি আজ যখন এই বিশ্বসভায় কথা বলছি, তখন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ তাদের জীবদ্দশায় হওয়া সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবেলা করছে।’</p> <p>ড. ইউনূস বলেন, ‘জলবায়ু সংকটের মোকাবেলা এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের যুগপত্ভাবে কাজ করতে হবে। বিশ্বসম্প্রদায় এখন কার্বনমুক্ত পৃথিবী গড়ে তুলতে মনোযোগী হচ্ছে। বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষকে এ ধরনের পরিবর্তনের সুফলভোগী করতে হলে নেট-জিরো পৃথিবীর লক্ষ্য সমানভাবে পূরণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে সঙ্গে নিতে হবে।’</p> <p>জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সাত বছর ধরে মায়ানমার থেকে আসা ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে আসছে। এর ফলে আমরা বিশাল সামাজিক-অর্থনৈতিক-পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে সৃষ্ট এই সংকট বাংলাদেশ ও আমাদের অঞ্চলের জন্য প্রথাগত ও অপ্রথাগত উভয় ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত চাই।’</p> <p>ড. ইউনূস বলেন, রাজনৈতিক মুক্তি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক জাগরণ ছাড়া শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। অবৈধ অর্থের প্রবাহ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদের পাচার বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পাচার হয়ে যাওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করতে হবে।</p> <p>প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত বিশ্বে বসবাস করছি, সেখানে অভিবাসন এবং মানুষের অবাধ প্রবাহ এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা। বাংলাদেশি নাগরিকরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হিসেবে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ মুহূর্তে প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি আছে। সবার জন্য অভিবাসনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের পথ সুগম করতে হবে।’</p> <p>তরুণ জনশক্তির বিষয়ে ড. ইউনূস বলেন, প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন।</p> <p>এই বিপুল জনশক্তির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। এই জনশক্তিকে বর্তমান ও আগামী দিনের জন্য গড়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।</p> <p><img alt="নতুন যাত্রায় বিশ্বকে পাশে চাই" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/28-09-2024/777_kaler-kantho--28-9-2024.jpg" width="1000" /></p> <p><img alt="নতুন যাত্রায় বিশ্বকে পাশে চাই" height="600" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/28-09-2024/88_kaler-kantho--28-9-2024.jpg" width="1000" /></p> <p>প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন (বাঁয়ে) এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন।</p> <p> </p>