<p>কোটি টাকার ঝুট, মাদক সাম্রাজ্য, স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় নিয়োগ, পদ বাণিজ্য, দখলদারি, ঠিকাদারি—সব কিছুতেই জড়িয়ে তাঁর নাম। বিচার-সালিস থেকে শুরু করে ডিশ, ইন্টারনেট, ফুটপাত, ট্রাকস্ট্যান্ড, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশায় চাঁদাবাজিসহ যেখানেই টাকার গন্ধ সেখানেই মতি চাচা। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যবসার কথা বলে এবং সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর বানানোর আশ্বাস দিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও। অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাং ও ক্যাডার বাহিনী পালনের।</p> <p>এত সব অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে তিনি হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী গাজীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মো. জাহিদ আহসান রাসেলের চাচা মতিউর রহমান মতি। ভাতিজা এমপি হলেও তাঁর আঙুলের ইশারায় চলত টঙ্গী-গাজীপুর। চাচার ভালো-মন্দ সব কাজে ছিল ভাতিজা রাসেলের অকুণ্ঠ সমর্থন। আর ভাতিজার আশকারায়ই ‘মতি চাচা’ হয়ে ওঠেন দেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিল্পনগরীর সত্যিকারের ‘ডন’।</p> <p>মতির রাজত্বে কিছুটা ধস নামে ২০১৮ সালের পর। সেবারের নির্বাচনে জেতার পর যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ভাতিজা রাসেল। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর কয়েকজন নেতা রাসেলের স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বলয় তৈরি করেন। এতে মতির ঝুট ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ কয়েকটি বড় খাতের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যায়। ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে চাচা-ভাতিজাও গাঢাকা দেন।</p> <p>যেভাবে উত্থান : রাসেলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আহসানউল্লাহ মাস্টার ছিলেন গাজীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ৭ মে টঙ্গীতে দলীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার সময় সন্ত্রাসীরা তাঁকে গুলিতে হত্যা করে। ওই হত্যা মামলার বাদী ছিলেন আহসানউল্লাহ মাস্টারের ছোট ভাই মতিউর রহমান মতি এবং মামলার বাদী হওয়ার সুবাদে তিনি টঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। উপনির্বাচনে ২৬ বছর বয়সী রাসেল জেতেন, কিন্তু দলীয় লোকজন ও এলাকাবাসী দাবি নিয়ে এলে রাসেল তাদের পাঠিয়ে দিতেন চাচা মতির কাছে।</p> <p>২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মতি নিজ বাহিনী দিয়ে কবজায় নেন টঙ্গী শিল্পনগরী ও টঙ্গী বিসিক, বোর্ডবাজার এবং পুবাইল শিল্পঞ্চলের শতকোটি ঝুট ব্যবসা। নিয়ন্ত্রণ নেন টঙ্গীর অপরাধজগৎ থেকে মাদক সাম্রাজ্য, এমনকি ফুটপাতও। দলীয় পদ বাণিজ্য, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, জাতীয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগেও ছিল তাঁর অফুরান প্রভাব। ঝুট খাত থেকে পেতেন প্রতি মাসে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা। এদিকে টঙ্গীর ১৯ বস্তিতে মাসে লেনদেন হয় শতকোটি টাকা। এই ব্যবসার একটি অংশ আসত মতির তহবিলে।</p> <p>সম্পদ :  ডন মতি দুই হাতে টাকা কামিয়ে নামে-বেনামে খুলেছেন একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কারখানা। এসব করে তিনি ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হন। জানা গেছে, ২০০৮ সাল পর্যন্ত ভাড়া বাসায় থাকলেও এখন টঙ্গীতে মতির রয়েছে একাধিক বিশাল বহুতল বাড়ি, প্লট ও ফ্ল্যাট, রাজধানীর উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরে জমজম টাওয়ারের পশ্চিম পাশে ১০ তলা বাড়ি, মালয়েশিয়ায় বাড়ি, নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজসংলগ্ন রোলিং মিল, শ্বশুরবাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে ৩১ বিঘা এবং শেরপুরের গজনি এলাকায় ৫২ বিঘা জমি। তাঁর রোলিং মিলের নাম সাউথ-ইস্ট রি-রোলিং মিল। তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, স্ত্রী এনি এমডি এবং ছেলে লিয়ন পরিচালক।</p> <p>দখলদারি : মতির প্রথম দখল বাণিজ্য শুরু হয় ২০০৪ সালে টঙ্গী নতুনবাজারের ব্যাংকের মাঠ এলাকায় ক্যাপরি সিনেমা হল দখল দিয়ে। জানা গেছে, টঙ্গী ব্যাংকের মাঠ এবং পাশের সরকারি মেঘনা টেক্সটাইল মিলের আশপাশের খালি জায়গা দখল করে ৫০টি টিনের ঘর তুলে ঝুটের গোডাউন হিসেবে ভাড়া দিয়ে রেখেছেন মতি। এখান থেকে মাসে ২০ লাখ টাকা ভাড়া পান। মেঘনা মিলের ভেতরে একটি বিশাল গোডাউন তুলে ভাড়া দিয়ে মাসে ১০ লাখ টাকার বেশি ভাড়া নেন। টঙ্গীর খাঁপাড়া এলাকার এশিয়া ফিলিং স্টেশনটিও দখল করে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ব্যক্তিগত সহকারী শাকিল আহমেদের সম্পদও দখল করার পর তাঁকে এলাকাছাড়া করেন তিনি। </p> <p>২০২২ সালে মতির হুমকিতে বায়না দলিলে ১০০ কোটি টাকার জমি ৬০ কোটি টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন স্থানীয় লিটু মিয়া। এভাবে অনেকের জমি ও সম্পদ হাতিয়ে নেন মতি চাচা। গাজীপুর মহানগর, টঙ্গী থানা, বিভিন্ন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ কমিটি ছিল তাঁর মুঠোয়। সম্পদ ও ব্যবসার লোভ দেখিয়ে অনেকের টাকাও তিনি মেরে দিয়েছেন। মতি দেশব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসেন গত বছর হক গ্রুপ অব কম্পানির এমডি আদম তমিজী হকের কারখানায় দলবল নিয়ে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে।</p> <p>২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে রাসেল যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হন। তারপর টঙ্গীতে টেলিফোন শিল্প সংস্থার মাঠে বাবার নামে একটি মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ শুরু করেন, যা এখনো শেষ হয়নি। গাজীপুরে বাবার নামে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করেন। পাঁচবার এমপি হওয়ার পরও তাঁর দৃশ্যমান উন্নয়ন এ পর্যন্তই।</p> <p>তবে সরকারি টাকায় নির্মিত কমপক্ষে ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনের নামকরণ রাসেল করেছেন প্রয়াত বাবা ও নিজের নামে। আর আওয়ামী লীগ ছাড়া সব সহযোগী সংগঠনের পদ অনুগতদের দিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি দিয়েছেন অনুগতদের। মাদক ব্যবসায়ীরা থাকতেন তাঁর সভা-সমাবেশে। তাঁদের পদ-পদবিও দেন রাসেল। এ রকম বহু সুবিধাবাদীকে প্রতিষ্ঠা করে নেপথ্যে সুবিধা আদায় করে নিয়েছেন রাসেলের স্ত্রী খাদিজা রাসেল। তবে এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায় মতিউর রহমান মতি ও জাহিদ আহসান রাসেলের মোবাইল ফোন।</p> <p> </p> <p> </p>