<p>বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রতিক সময়ের নৈরাজ্যকর বিক্ষোভে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি। দলটির দাবি, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার এই বিক্ষোভ সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, পরিস্থিতি দিন দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাদের মত, সরকার পরিচালনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।</p> <p>গত সোমবার রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতাদের আলোচনায় এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। বৈঠকে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন।</p> <p>গত কয়েক দিনে রাজধানীতে বিভিন্ন দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ হয়েছে। রবি ও সোমবার পুরনো ঢাকায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে ঘেরাও করেছে বিক্ষোভকারীরা। </p> <p>এসব বিক্ষোভের বিষয়ে বিএনপির বিশ্লেষণ হচ্ছে, সরকার শুরু থেকে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের নমনীয়তা বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সরকারকে ‘ব্যর্থ’ এবং দেশকে অস্থিতিশীল করতে চক্রান্ত ও সহিংস অবস্থা তৈরি হতে পারে—এমন শঙ্কা থাকার পরও সরকার তা শক্ত হাতে দমন করেনি। ফলে এখন একটি বিপর্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।</p> <p>তাদের আরো পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছিল। কিন্তু সরকার তা সেভাবে আমলে নেয়নি। প্রশাসনে এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা ‘শক্ত’ অবস্থানে আছে। পুলিশও নির্বিকার। নেতাদের মতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘দোসরদের’ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বসিয়ে রাখলে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতো তা নিয়ে তারা বারবার সতর্ক করেছিলেন।</p> <p>বৈঠকে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে বিএনপির লিখিত প্রস্তাব চূড়ান্তকরণ নিয়ে স্থায়ী কমিটির তিনজন নেতা বিতণ্ডায় জড়ান। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি বিষয় সংশোধনের পর ওই প্রস্তাব পাস করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে লিখিত প্রস্তাব জমা দেয় দলটি।</p> <p>স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে কমিটির কোনো নেতা নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয় সংস্কারের ওপর সরকার মনোনিবেশ করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিলে এই পরিস্থিতি তৈরি হতো না। নির্বাচন দিতে যত দেরি হবে—এ ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ততই বাড়বে।  </p> <p>এমন বাস্তবতায় বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং পরিস্থিতি উত্তরণে কী করা উচিত, সে বিষয়ে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের কিছু পরামর্শ তুলে ধরবে। আজ-কালের মধ্যে এই বৈঠক হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।</p> <p>গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিদ্যমান অস্থিরতার জন্য পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করে এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি এও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। নইলে দেশ আবার সেই অন্ধকারে চলে যাবে।</p> <p> </p> <p><strong>সরকার ব্যর্থ হোক, চায় না বিএনপি</strong></p> <p>বিএনপি নেতারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হোক তা তারা চান না। কারণ এই সরকার ব্যর্থ হলে দেশে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ফলে দেশে নির্বাচন বিলম্ব হতে পারে। দলটির নেতারা বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি চায়।</p> <p>দলের নেতারা জানান, পতিত ফ্যাসিবাদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিএনপি শিগগিরই কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা করছে। সাম্প্রতিক ‘চক্রান্তের’ বিরুদ্ধে ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করতে পারে দলটি। চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করতে বিএনপি মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।</p> <p> </p> <p><strong>সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে জড়ালেন তিন নেতা</strong></p> <p>বৈঠক সূত্র জানায়, আলোচনার শুরুতে সংবিধান সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ। তার প্রস্তুত করা প্রস্তাব অন্য সদস্যদের মতামত ছাড়াই পাস করার অনুরোধ জানালে কমিটির দুজন জ্যেষ্ঠ সদস্য আপত্তি জানান। তাঁরা প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে তারপর পাস করার পরামর্শ দেন। এতেই সালাহ উদ্দিন আহমদ উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন, তিনি আর কোনো সংশোধন করতে পারবেন না।</p> <p>তার এ ধরনের বক্তব্যের সমালোচনা করে দুজন সদস্য বলেন, আলোচনা ছাড়াই যদি প্রস্তাব পাস করতে হয় তাহলে উত্থাপনের কী দরকার ছিল? জবাবে সালাহ উদ্দিন বলেন, তার পক্ষে নতুন করে কিছু করা সম্ভব নয়।</p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির একজন নেতা বলেন, সাধারণত কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করা হলে তার ওপর অন্য সদস্যদের মতামতের পর সংযোজন-বিয়োজন করে তা পাস করা হয়। কিন্তু সালাহ উদ্দিন প্রস্তাব তৈরি করে তা পাস করতে চাওয়ায় অন্যরা তাতে অসন্তুষ্ট হন।</p> <p>তর্কের এক পর্যায়ে সালাহ উদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, তাহলে তাকে আর বৈঠকে যেন ডাকা না হয়। তার এ ধরনের মনোভাবে অন্য সদস্যরা বিরক্ত প্রকাশ করে বলে জানান এক নেতা। তিন নেতার বিতর্কের সময় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিশ্চুপ ছিলেন। পরে অবশ্যই সংক্ষিপ্ত আলোচনার পর কয়েকটি বিষয়ে সংশোধনী এনে প্রস্তাব পাস করা হয়।</p> <p> </p> <p><strong>সংবিধান সংস্কারে ৬২ প্রস্তাব দিল বিএনপি</strong></p> <p>সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।</p> <p>গতকাল মঙ্গলবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনে সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে নিজেদের লিখিত প্রস্তাব জমা দেয় দলটি। পরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।</p> <p>সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে শুরু করে তফসিল পর্যন্ত ৬২টি জায়গায় বিভিন্ন সংশোধনীর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনার মূল অংশে কিছু নতুন প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহীদের রক্তের অঙ্গীকার, বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে যাতে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র সৃষ্টি না হয়, সেগুলো মাথায় রেখে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।</p> <p>সালাহ উদ্দিন আহমদ জানান, একই ব্যক্তি পর পর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এমন বিধান; সংসদে উচ্চকক্ষ সৃষ্টি, অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ যাতে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকে, গণভোটের বিধান পুনঃপ্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে।</p> <p>বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রস্তাবনায় প্রজাতন্ত্র, নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, তফসিলসহ সব বিষয় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যাতে সংবিধানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সাধিত হয়। রাষ্ট্রের সব অঙ্গে যাতে সব ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয়, সেই প্রস্তাবও রয়েছে।</p> <p>সংবিধান পুনর্লিখনের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিএনপি কোনো বক্তব্য দিয়েছে কি না জানতে চাইলে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ব্যাপক ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব করেছেন তারা, যাতে এটা গণতান্ত্রিক সংবিধান সংশোধন হয়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়।</p> <p>সংসদ না থাকায় সংবিধান সংশোধন কিভাবে হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে সালাহ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংবিধান সংস্কার কমিশন তাদের প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, বিশেষজ্ঞসহ সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তারা চূড়ান্ত করবেন। এ ক্ষেত্রে দেখা যাবে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সবাই একমত হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকতেই পারে। যেসব বিষয়ে ঐকমত্য থাকবে, সেগুলো তারা যদি অঙ্গীকার করেন, নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিফলন করেন, তাহলে সবার অঙ্গীকার থাকবে পরবর্তী নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা সংবিধান সেভাবে পরিবর্তন করবে।’</p> <p> </p> <p><strong>গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা</strong></p> <p>এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের আগে সোমবার গুলশানে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে দলটি। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ছিলেন।</p> <p>বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সেখানেও দেশের বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। নেতারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার পুরোপুরি আমলানির্ভর হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ আমলা পতিত ফ্যাসিবাদের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সরকার জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করতে পারছে না। এসব আমলাই সরকারকে অস্থিতিশীল করতে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছে। সরকারের উচিত, শক্ত হাতে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা, প্রশাসনকে আওয়ামী দোসরমুক্ত করা। নইলে পতিত ফ্যাসিবাদ আবার পুনর্বাসিত হতে পারে, যা কারও জন্যই মঙ্গলজনক হবে না।</p>