<p>কবি হেলাল হাফিজ গৃহী ছিলেন না। স্বেচ্ছায় সন্ন্যাস বেছে নিয়েছিলেন। নিঃসঙ্গতা কুরে কুরে খেয়েছে তাকে। একজীবনে কত বর্ণিল ও তীব্র বিষাদই না তাকে বিদ্ধ করল। পোড়াল। না পুড়লে নাকি সোনা খাঁটি হয় না। সন্ন্যাস, আত্মপীড়ন, নির্লিপ্তির পথে দীর্ঘকাল হাঁটলেন। সে এক কষ্টদ্রাবী দুর্গম শিল্পযাত্রা। কত নারী এলো জীবনে, তার পরও তৃষ্ণার শেষ নেই, নেই। তাও বুঝি শিল্পচূড়া থেকে গেল অনেকটাই অধরা! কবিতার জন্য সব ছেড়েছুড়ে বিবাগী জীবন। জুয়ার টেবিল, স্কুল মাস্টারি, সাংবাদিকতা, সরকারি চাকরি প্রত্যাখ্যান, হোটেলবাস, অকৃতদার থাকা, নির্মোহ বৈরাগ্য—আলো-আঁধারি রহস্যকুয়াশা, কৌতূহল কিছু কম নেই তাকে ঘিরে।</p> <p>তার সম্পর্কে বলা হয়, ‘হেলাল হাফিজ অল্প লিখে গল্প হয়েছেন।’ মোক্ষম ও যথার্থ মূল্যায়নই বটে। পাঠকসাধারণের অপার কৌতূহল এবং আগ্রহ এই ব্যক্তিমানুষটির জীবনযাপনের ধারা-প্রকৃতি, নানা বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনা, পর্যবেক্ষণ, অনুভূতি সম্পর্কে। একখানি মাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ গভীর মমতা-ভালোবাসায় স্পর্শ করেছে অজস্র মানুষের হূদয়। দোলায়িত, শিহরিত, মুগ্ধ-আপ্লুত করেছে পাঠক-মনন। সে এক আশ্চর্য নান্দনিক টান, সম্মোহনও।</p> <p>৭ অক্টোবর ১৯৪৮ কবি হেলাল হাফিজের জন্ম। নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলায়। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান। বলতেন, মাতৃহীনতার বেদনাই তাকে কবি করেছে। স্কুল শিক্ষক পিতা আবার বিয়ে করেন। দুই সংসারে মোট চার ভাই তিন বোন। গ্লুকোমা, কিডনি, ডায়াবেটিসসহ নানা ব্যাধির আক্রমণে শরীর ছিল অত্যন্ত দুর্বল। জীবনের অন্তিমলগ্নেও শাহবাগের একটি হোটেলে বরাবরের মতো বসবাস করতেন। তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রেস ক্লাব ছিল প্রকৃতই সেকেন্ড হোম। জীবনসায়াহ্নে সেখানে যাতায়াত করতে পারতেন না শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে।</p> <p>কবি হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ ১৯৮৬ সালে প্রকাশের পর ব্যাপক তোলপাড় তোলে। মোট ৩৩টি মুদ্রণ হয়েছে। এটি রেকর্ড। প্রকাশিত অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘কবিতা ৭১’ (ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য টিয়ার্স দ্যাট ব্লেজ’সহ), ‘একজীবনের জন্মজখম’ (ইংরেজি অনুবাদ ‘বার্থ উন্ড অব ওয়ান লাইফ’সহ)। শেষতম গ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ বের হয় ২০১৯ সালে, ঢাকা ও কলকাতা থেকে একযোগে।</p> <p>অসামান্য জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজকে বলা হয় দ্রোহ ও প্রেমের কবি। তার সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাটির নাম ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। সে কবিতার দুটি পঙক্তি হলো ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়...’</p> <p>কিভাবে জন্ম ঐতিহাসিক সেই কবিতাটির? কবির জবানিতেই জানা যাক। তিনি আমাকে বলেছেন, “উত্তাল ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে একদিন সন্ধ্যায় আমি পুরনো ঢাকা থেকে ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ফিরছিলাম। সেই সময়টাতে একটু ‘অব্যবস্থিতচিত্ত’ ছিলাম। পানাহার করে ফিরছিলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার আস্তানায়। তখন বাংলা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যে কতটা সর্বগ্রাসী ও সর্বপ্লাবী ছিল, সেটা যারা না দেখেছেন, তাদের বোঝানো দুষ্কর। গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ায় আমার রিকশাটি থেমেছিল। সমানে মিছিল চলছিল সেখানে। ইপিআর (বর্তমানের বিজিবি) ও পুলিশ মিছিলকারীদের পেটাচ্ছিল। ধাওয়া দিচ্ছিল। মিছিল থেকেও ইটপাটকেল ছোড়া হচ্ছিল। একটা রিকশা ছিল থামানো। বয়স্ক সেই রিকশাওয়ালা বলে উঠল, ‘মার মার শালাদের। কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ রিকশাওয়ালারা মাঝে মাঝে টুকটাক ইংরেজি শব্দও বলে। এই কথাটা আমার মগজে ও মনে গেঁথে গেল। ওই ঘটনা থেকেই এ কবিতার জন্ম।”</p> <p>নন্দিত কবি হেলাল হাফিজ জানান, “আহমদ ছফা আর কবি হুমায়ূন কবির এই দুজন আমাকে তত্কালীন দৈনিক পাকিস্তানের সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের কাছে নিয়ে যান। কবিতাটা হাবীব ভাইয়ের হাতে দিয়ে তারা বললেন, ‘হাবীব ভাই, এ আমাদের এক তরুণ কবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ে।’ আহসান হাবীব অনেক বড় মাপের কবি। উনি কবিতাটা পড়েন আর আমার দিকে তাকান। অবাক চোখে দেখছেন আমাকে। আমার তখন কীই বা বয়স। হাবীব ভাই পড়া শেষ করে আরো এক-দুইবার পড়লেন। পড়েই ছফাকে বললেন, ‘ছফা এই কবিতাটা আমি দৈনিক পাকিস্তানে ছাপতে পারব না। কারণ দৈনিক পাকিস্তান সরকারি কাগজ আর কবিতাটি হচ্ছে রাষ্ট্রদ্রোহী কবিতা, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লেখা। সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানানো হয়েছে এই কবিতার মাধ্যমে। এটা ছাপলে আমার চাকরি তো যাবেই, কাগজটাও বন্ধ হয়ে যাবে, আরো কত কী যে হবে! তাই আমি কবিতাটি ছাপতে পারলাম না। তবে হেলালের আর কবিতা না লিখলেও চলবে। তিনি তো বড় কবি। পাকা জহুরিও। চকিতেই তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, এই ভূখণ্ডের তত্কালীন সাড়ে সাত কোটি মানুষের তীব্র যে আকাঙ্ক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষা এই কবিতায় সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। হাবীব ভাই আর ছাপলেন না কবিতাটা। আমরা চলে এলাম।”</p> <p>কবি হেলাল হাফিজের ভাষায়, “কবিতাটির প্রথম দুটি লাইন ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। ছফা ভাই ও হুমায়ূন কবির এক রাতে সমস্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে দিলেন। তখন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এত ভবন ছিল না। মূলত আর্টস ফ্যাকাল্টি ও কার্জন হল। মাত্র দুই রাতে গোটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে স্লোগান হিসেবে এই পঙক্তি লেখা হলো। চিকা মারা যাকে বলে। এখনকার প্রজন্ম অবশ্য চিকা মারা কী, সেটার মর্ম বুঝতে পারবে না। গভীর রাতে ভীতিকর পরিবেশে দেয়াল লিখনরত তরুণদের জিগ্যেস করা হয়েছিল, তোমরা কী করছো? উত্তরে ওরা বলেছিল, চিকা (ছুঁচো) মারছি। সেই থেকে দেয়াল লিখনের কাজকে বলা হতো চিকা মারা। </p> <p>মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কবিতা রণাঙ্গনের মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, সেই বীর যোদ্ধাদের জাগরণী ও উজ্জীবন মন্ত্র ছিল এই কবিতাটি। স্বাধীনতার পরে, বিশেষ করে বাম রাজনীতি যারা করতেন, হক, তোহা, সিরাজ সিকদার গ্রুপ—এরা এই কবিতাটিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা শুরু করল। কবিতাটি আমাকে রাতারাতি তারকা খ্যাতি এনে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। যে সমাজে একটু পীড়ন থাকবে, নির্যাতন থাকবে, শোষণ থাকবে, সেই সমাজে এই কবিতা থাকবেই—এটা বাদ দেওয়া যাবে না। এর পর থেকে এই একটি কবিতাই আমার জীবনধারা আমূল বদলে দিল।</p> <p>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা করিডর দিয়ে চলাই তার দায়। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, ‘ওই যে কবি হেলাল হাফিজ যায়, দ্যাখ! দ্যাখ!’ আমার নাম না নিয়ে এটাও বলে যে এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। যেখানেই যাই, সেখানেই একটু অতিরিক্ত পাত্তা পাই। তখন টিএসসি নতুন হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার মডেলে। টিপটপ। হাই ফাই। রোজ দুপুরে আমাকে কে খাওয়াবে, তা নিয়ে কম্পিটিশন হয়। আমাকে কোনো বিল দিতে হয় না।”</p> <p>কবিকে প্রশ্ন করি, একদা যৌবনে আপনি লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত কবিতার পঙক্তি—এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়। এখন জীবনসায়াহ্নে এসে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে আপনি কী ধরনের পঙক্তি লিখবেন?</p> <p>এ প্রশ্নের উত্তরে কবি হেলাল হাফিজ বললেন, ‘এখন যৌবন যার... এই দ্যুতিময় পঙক্তির যিনি স্রষ্টা, তিনি চিরনবীন। বাস্তবে তার বয়স যতই হোক না কেন। এটা ঠিক, শরীর একটা বড় ফ্যাক্টর। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যত দিন সমাজে অন্যায় উত্পীড়ন অনিয়ম অনাচার থাকবে, এই পঙক্তিমালাকে আশ্রয় করে প্রতিবাদী কিছু মানুষ ঘুরে দাঁড়াতে চাইবে। রুখে দাঁড়াবে অন্যায়-বৈষম্য। এই কবিতার পঙক্তি তাদের প্রাণিত করবে। এমনটা হতেই পারে যে, বেশির ভাগ মানুষই ক্ষমতার বলয়ের মধ্যে থাকতে চাইবে। কলাটা-মুলোটার জন্যে। কিন্তু কিছু মানুষ তো ব্যতিক্রমী থাকবেই। তারা রুখে দাঁড়াবে। অন্যায়-অবিচারের অবসান চাইবে।’</p> <p> </p> <p>লেখক : কবি, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি</p>