ঢাকা, শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
১৮ মাঘ ১৪৩১, ০১ শাবান ১৪৪৬

ঢাকা, শনিবার ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
১৮ মাঘ ১৪৩১, ০১ শাবান ১৪৪৬

রাশিয়ায় যুদ্ধে আট বাংলাদেশি!

হায়দার আলী ও জয়নাল আবেদীন
হায়দার আলী ও জয়নাল আবেদীন
শেয়ার
রাশিয়ায় যুদ্ধে আট বাংলাদেশি!

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে স্থলমাইন বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন বাংলাদেশের রাজবাড়ীর ছেলে আরমান মণ্ডল। ইউক্রেনের ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার মাইন বিস্ফোরণে আক্রান্ত হওয়ার দাবি করেন তিনি। ২১ বছর বয়সী এই তরুণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কিভাবে জড়ালেন, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে কালের কণ্ঠ। এতে বেরিয়ে আসে একটি এজেন্সির ভয়াবহ প্রতারণার তথ্য।

বিভিন্ন কারখানা ও ক্যান্টনমেন্টে মালি বা বাবুর্চির কাজ দেওয়ার কথা বলে তরুণদের পাঠানো হয় রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে। সেখানে অকাতরে প্রাণ হারাচ্ছে অনেকে। শুধু এক এজেন্সির মধ্যস্থতায় পাঠানো ১০ তরুণের মধ্যে আটজন যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এঁদের মধ্যে অনেকের কোনো খোঁজ মিলছে না।

রাশিয়ায় যুদ্ধে আট বাংলাদেশি!গতকাল সোমবার আহত আরমানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন কালের কণ্ঠ প্রতিবেদক। আরমান এ সময় চিকিৎসাধীন ছিলেন রাশিয়ার একটি সামরিক হাসপাতালে। ভিডিও কলে তিনি বলেন, ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরবে নেওয়া হয় তাঁদের। এরপর তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয় রাশিয়ান একটি চক্রের কাছে।

সেখানে এক মাস সশস্ত্র প্রশিক্ষণের পর গত বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) সকালে গোলাবারুদ নিয়ে রওনা দেন কিয়েভের দিকে। এ সময় ইউক্রেনের ছোড়া ড্রোন হামলা প্রতিহত করতে অন্য সৈনিকদের সঙ্গে ছিলেন তিনিও। সেখানে স্থলমাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে তিনি আহত হন। এ সময় তিনি দুই পায়ের ব্যান্ডেজ দেখান।

আরমানের বাড়ি রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার মাজবাড়ী ইউনিয়নের কুষ্টিয়াডাঙ্গি গ্রামে।

তাঁর বাবা আকরাম মণ্ডল কৃষিকাজ করে সংসার চালান। আরমান কালিয়াকান্দি মীর মোশারফ কলেজে পড়াশোনা করতেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে স্থানীয় দালাল মনজুরুল হোসেনের প্রলোভনে পড়ে রাশিয়ায় যাওয়ার আগ্রহ দেখান। মনজুরুল তাঁকে নিয়ে যায় ড্রিম হোম ট্রাভেল নামে একটি এজেন্সির অফিসে। এজেন্সিকে আট লাখ টাকা পরিশোধ করে উন্নত জীবনের খোঁজে দেশ ছাড়েন আরমান। সংসারের হাল ধরতে গিয়ে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিজের জীবন এখন বিপন্নপ্রায়।

ড্রিম হোম ট্রাভেল এজেন্সির ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত খোলার মতো চটকদার বিজ্ঞাপনে সয়লাব প্রতিষ্ঠানটির ফেসবুক পেজ। বিশেষ করে রাশিয়া, কানাডা, সাইপ্রাস, চীনসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার্থী ও শ্রমিক পাঠানো হয় বলে উল্লেখ করা হয়। কোনো নিবন্ধিত রিক্রুটিং এজেন্সি না হয়েও এভাবে প্রকাশ্যে বিদেশে শিক্ষার্থী ও কর্মী পাঠানোর বিষয়টিকে প্রতারণা বলছেন প্রবাসীকল্যাণ খাতের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিরা।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রেফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ওমরা ভিসা দিয়ে নিয়ে সেখান থেকে ইউক্রেনে পাঠানো খুবই অন্যায় একটা কাজ। এ কাজের জন্য এটাকে এক ধরনের যুদ্ধ পাচার বলা যায়। এই ঘটনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসা উচিত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অতি দ্রুত এই ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে দ্রুত কার্যক্রম প্রয়োজন। এর সঙ্গে দোষী ব্যাক্তিকে অতি দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। এই ট্রাভেল এজেন্সিকে পাচারের আইনে বিচার করতে হবে।

 

ট্রাভেল এজেন্সির ভয়াবহ প্রতারণায় সংকটে অনেকে

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আরমানসহ নিখোঁজ তরুণদের রাশিয়ায় চক্রের হাতে তুলে দেওয়ার এই লোমহর্ষক ঘটনায় নাটের গুরু ড্রিম হোম ট্রাভেল। এটি জননী গ্রুপের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর বনানীর এফ ব্লকে ৪ নম্বর সড়কের ৪ নম্বর বাড়িতে এর কার্যালয়। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নড়াইলের বাসিন্দা এম এম আবুল হাসান। তিনি নড়াগাতী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি।

আরমান মণ্ডলের সঙ্গে তিনি গত বছরের ১২ অক্টোবর ৩০০ টাকার দলিলে একটি চুক্তিতে সই করেন। চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে, রাশিয়ার ক্যান্টনমেন্টে মালি অথবা বাবুর্চির কাজ দেওয়া হবে আরমানকে। বেতন হবে প্রায় দুই লাখ টাকা। ভিসার মেয়াদ হবে ১০ বছর। চুক্তিপত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকা নেওয়ার তথ্য থাকলেও বাস্তবে আরমানের কাছ থেকে দুই ধাপে আট লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি তাঁর বাবা আকরাম মণ্ডলের।

আরমানের রাশিয়ার ভিসার একটি কপি কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে। এতে দেখা যায়, ভিসাটি ইস্যু হয়েছে গত ৫ ডিসেম্বর। ভিসার মেয়াদ ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে ৬ জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ৩০ দিন। ১০ বছরের কর্মী ভিসা দেওয়ার কথা বলে মাত্র এক মাসের পর্যটক ভিসা দেয় ট্রাভেল এজেন্সি। এভাবে এজেন্সির সূক্ষ্ম কারসাজিতে ফেঁসে গেছেন নিরীহ তরুণ আরমান মণ্ডলসহ কয়েকজন। আরমান ছাড়া বাকিরা হলেননরসিংদীর তুহিন, সোহান ও মোবারক; ঢাকার আমিনুল; গাইবান্ধার হুমায়ুন কবির ও রহমত আলী ও আকরাম।

জানা গেছে, ড্রিম হোম ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান আবুল হাসান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক তামান্না ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসার আড়ালে বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। কার্যত তাদের কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির নিবন্ধনও নেই। স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে নিরীহ ছেলেদের মস্তিষ্কে উন্নত জীবনের আশা জাগিয়ে বিপদে ফেলছেন।

 

যেভাবে যুদ্ধের মাঠে তাঁরা

গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বব ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেয় ড্রিম হোম ট্রাভেলস। এতে বলা হয়, রাশিয়ায় ক্যান্টনমেন্টে মালি ও বাবুর্চির কাজের সুযোগ রয়েছে। বেতন শুরু দেড় হাজার ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার তথ্যও তুলে ধরা হয় এতে।

ফেসবুকে চটকদার বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে স্থানীয় দালালদেরও কাজে লাগিয়ে দেয় ড্রিম হোম ট্রাভেলস। দালালরা উন্নত জীবনের আশ্বাস দিয়ে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করে তরুণদের। সরল মনে তা বিশ্বাস করেন কলেজপড়ুয়া আরমানসহ অন্যরা। বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালরা এই তরুণদের ঢাকায় ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে নিয়ে আসে। একেকজন থেকে নেওয়া হয় আট লাখ টাকা করে।

আরমান কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা চুক্তি করে ড্রিম হোম ট্রাভেলস। তিনিসহ ১০ জন তরুণকে প্রথমে ওমরাহ ভিসায় সৌদি আরবে পাঠায় ড্রিম হোম ট্রাভেল। সেখান থেকে তাঁদের বিক্রি করে দেওয়া হয় রাশিয়ান একটি চক্রের কাছে। রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর তাঁদের এক মাসব্যাপী কমান্ডো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কৌশলে দুজন দেশে ফিরে আসতে সমর্থ হলেও ফেঁসে যান বাকি আটজন। তাঁদের জোরপূর্বক মারধর করে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়।

আরমান বলেন, আমরা বারবার তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমাদের কর্মী ভিসায় পাঠানো হয়েছে। আমরা কোনো যুদ্ধে অংশ নিতে চাই না। এর পরও আমাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়। রাশিয়ান কমান্ডোরা মারধর করে আমাদের যুদ্ধে নিয়ে যায়। আমাদের সামরিক পোশাক পরিয়ে হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তুলে দেওয়া হয়। কিয়েভে ড্রোন হামলা ও স্থলমাইন বিস্ফোরণ হলে আমার সামনে থাকা জিপে আটজনই প্রাণ হারান। আমি পেছনে মোটরসাইকেলে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। আমি এখন দেশে ফিরতে চাই।

পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরমানের জন্ম ২০০২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। রাশিয়ায় প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে যে সৈনিক নম্বর দেওয়া হয়েছে, তার একটি ছবিও পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত ছবিতে দেখা গেছে, তাঁর আইডি নম্বর এ৫-১৯৭০৫৯।

 

আমার কলিজার টুকরা ছেলেকে ফেরত চাই

দুই মেয়েকে জড়িয়ে সারাক্ষণ কান্নাকাটি করেন আরমানের মা ফাহিমা বেগম। একমাত্র ছেলের এমন জীবনসংকটে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বাবা আকরামও পাথর হয়ে গেছেন। আরমানের দুই ছোট বোনও ভাইয়ের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।

গতকাল কথা বলতে গিয়ে বারবার আহাজারি করছিলেন ফাহিমা। বারবার ছেলেকে নিরাপদে দেশে ফেরত আনতে সাহায্য প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, আমার কলিজার টুকরা, আমার একমাত্র ছেলে। আমি ছেলের জীবন ভিক্ষা চাই। আমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনুন।

আরমানের বাবা আকরাম মণ্ডল বলেন, আমার ছেলেটারে কাজের কথা বলে রাশিয়ায় নিয়ে দালালরা বিক্রি করে দিয়েছে। স্যার, একটাই ছেলে আমার। ওরা চকোলেট কারখানায় চাকরি দেবে বলেছিল। যদি জানতাম রাশিয়ায় যুদ্ধে ঠেলে দেবে, কখনোই ছেলেটারে পাঠাতাম না। আমার কলিজার টুকরা ছেলেকে যেকোনো মূল্যে ফেরত চাই। সরকারের কাছে আবেদন করি, যেন এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।

তিনি জানান, স্থানীয় দালাল মনজুরুল হোসেন প্রথমে আরমানকে রোমানিয়ায় পাঠানোর প্রসস্তাব দেয়। দালাল বারবার ফুসলাতে থাকে। বিশেষ করে রাশিয়ায় ভালো কাজের সুযোগ রয়েছে বলে জানালে তাঁরা রাজি হন। বেতনও ধরার কথা দুই লাখ টাকা। প্রায় সাড়ে তিন মাস কেটে গেছে। এখন গোটা পরিবারে নেমে এসেছে দুশ্চিন্তার মেঘ।

 

ড্রিম হোম ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা হয় ড্রিম হোম ট্রাভেলসের চেয়ারম্যান এম এম আবুল হাসানের সঙ্গে। অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি দাবি করেন, মালি বা বাবুর্চির ভিসাতেই ১০ জনকে রাশিয়া পাঠিয়েছিলেন তিনি। তবে তাদের যুদ্ধের মাঠে ঠেলে দেওয়া হবেএ বিষয়ে তিনি অবগত ছিলেন না।

যুদ্ধের প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু সেনা ক্যাম্পে চাকরি, তাই আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে তাদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। এখানে আমাদের কোনো দায় নেই। এখন আমরা তাদের ফেরত আনতে চেষ্টা করছি। দোহারের নবাবগঞ্জের বাসিন্দা শফিকুল ইসলামের মাধ্যমে এই তরুণদের রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল বলে জানান তিনি।

স্থানীয় দালাল মনজুরুল হোসেনও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি জানান, আরমান তাঁর নিকটাত্মীয়। তিনি নিয়মিত ওই এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠান। ভালো সুযোগ থাকায় আরমানকে রাশিয়ায় পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হবে, এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না। তিনি নিজেও এজেন্সি কর্তৃক মারাত্মক প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেন।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ছাত্রশিবিরের গণমিছিল

আ. লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকব

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
আ. লীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মাঠে থাকব
ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে গতকাল রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকায় গণমিছিল করে ছাত্রশিবির। ছবি : কালের কণ্ঠ

আওয়ামী লীগ এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল শুক্রবার ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের দাবিতে গণমিছিল শেষে এই দাবি জানান শিবিরের নেতাকর্মীরা।

সারা দেশে কর্মসূচির অংশ হিসেবে জুমার নামাজ শেষে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল শুরু করে শিবির। এ সময় শিবিরের নেতারা আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ, হই হই রই রই, ছাত্রলীগ গেলি কই, আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে, দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা, ছাত্রলীগের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না, ফ্যাসিবাদের ঠিকানা, এই বাংলায় হবে না, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই ইত্যাদি স্লোগান দেন।

মিছিলটি শাহবাগে এসে শেষ হয়। এখানে সমাবেশে বক্তব্য দেন শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতারা। সমাবেশের প্রধান অতিথি এবং সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দেশবাসী আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করতে দেখেনি। অবিলম্বে এই ফ্যাসিবাদের বিচার কার্যকর করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিছু রাজনৈতিক দল ফ্যাসিবাদের বিচারের দাবিতে সরব না থেকে বাসস্ট্যান্ড, টেম্পোস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ছাত্রসমাজকে নিয়ে ছাত্রশিবির মাঠে থাকবে জানিয়ে শিবিরের দপ্তর সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ বলেন, আমরা ভেবেছিলাম অচিরেই আওয়ামী লীগের বিচার বাংলাদেশে হবে। কিন্তু দেখছি তাদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগের সন্ত্রাসীরা এখনো আমাদের ভাইদের হত্যা করছে।

আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই, আমাদের শহীদ ভাইদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আপনারা ক্ষমতায় গেছেন। আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত না করা পর্যন্ত ছাত্রসমাজকে নিয়ে শিবির মাঠে থাকবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, ২০০৬ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবির তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছে। সামনে কেউ এই ফ্যাসিবাদী দলকে নিয়ে আসতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধেও শিবির সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগরের উদ্যোগে গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার শিবিরের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক তাওহীদুল হক মিজবাহর নেতৃত্বে মিছিলটি চট্টগ্রাম আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে নগরীর নিউ মার্কেট মোড়ে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।

মিছিল শেষে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে তাওহীদুল হক মিজবাহ বলেন, ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ যতসংখ্যক গণহত্যা এবং একদলীয় শাসন ও স্বৈরাচারী ক্ষমতা কায়েমের চেষ্টা করেছে, তাদের এ দেশে আর রাজনীতি করার নৈতিক অধিকার নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, স্বৈরাচার হাসিনা ও জুলাই-আগস্টের সব খুনির দ্রুত বিচার করতে হবে।

খুলনা অফিস জানায়, কেন্দ্র ঘোষিত ফ্যাসিস্ট সরকারের গুম, খুন, দুর্নীতিসহ সব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে খুলনায় গণমিছিল করেছে ছাত্রশিবির খুলনা মহানগর শাখা।

 

মন্তব্য

ডিজেল কেরোসিন পেট্রল অকটেন লিটারে ১ টাকা বাড়ল

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
ডিজেল কেরোসিন পেট্রল অকটেন লিটারে ১ টাকা বাড়ল

ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম লিটারে এক টাকা করে বাড়িয়েছে সরকার। জ্বালানি তেলের নতুন এ দাম কার্যকর হবে আজ শনিবার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ গত মার্চ থেকে শুরু করেছে সরকার। সে হিসাবে প্রতি মাসে নতুন দাম ঘোষণা করা হচ্ছে।

জ্বালানি তেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে গতকাল শুক্রবার রাতে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৪ টাকা থেকে বেড়ে ১০৫ টাকা হয়েছে। অকটেন প্রতি লিটার ১২৫ টাকা থেকে বেড়ে ১২৬ টাকা এবং পেট্রল ১২১ টাকা থেকে বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে।

বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিল রেখে প্রতি মাসে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।

একই প্রক্রিয়ায় প্রতি মাসে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা প্রায় ৭৪ লাখ টন। মোট চাহিদার প্রায় ৭৫ শতাংশই ডিজেল ব্যবহার করা হয়। বাকি ২৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হয় পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলে।

ডিজেল সাধারণত কৃষি সেচে, পরিবহন ও জেনারেটরে ব্যবহার করা হয়। জ্বালানি তেলের মধ্যে উড়োজাহাজে ব্যবহৃত জেট ফুয়েল ও বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করে বিপিসি।

আর ডিজেল, কেরোসিন, পেট্রল ও অকটেনের দাম নির্ধারণ করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়াও উন্নত বিশ্বে প্রতি মাসেই জ্বালানির মূল্য নির্ধারণ করা হয়।

 

মন্তব্য

পাঁচ ফলের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০-৯০ টাকা

শিহাবুল ইসলাম
শিহাবুল ইসলাম
শেয়ার
পাঁচ ফলের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫০-৯০ টাকা

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর চলতি অর্থবছর বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সঙ্গে আমদানি করা ফলের দামে দ্বিতীয় দফায় সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে। এর প্রভাবে পাঁচটি ফলে প্রতি কেজিতে দাম ৫০ থেকে ৯০ টাকা বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ফল কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলের নিয়মিত ক্রেতা অনেকে ফল কেনা কমিয়ে দিয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও ভাটারা এলাকার খুচরা বাজার ঘুরে এমন তথ্য জানা গেছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, শুল্ক বাড়ানোর পর প্রতি কেজি কালো আঙুরের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ টাকা। একইভাবে মানভেদে আপেলের দাম কেজি প্রতি বেড়েছে ৪০ থেকে ৯০ টাকা। কমলার দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৭০ টাকা, নাশপাতি ও আনারের দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৯ জানুয়ারি আমদানি করা ফলের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে।

বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, কালো আঙুর ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। সাদা আঙুর মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি। আফ্রিকার আপেল মানভেদে ৩০০ থেকে ৩৮০ টাকা কেজি।

আগে ছিল ২৬০ থেকে ২৯০ টাকা কেজি। সবুজ আপেল ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি, এখন ৩৫০ থেকে ৩৭০ টাকা। কমলা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি, আগে ছিল ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। নাশপাতি বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজি, আগে ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা। ছোট আনার ৩৫০ টাকা কেজি, মাঝারিটা ৪৫০ টাকা।
সবচেয়ে বড় আনার ৬০০ টাকা কেজি।

কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা মো. আমিনুল হক বলেন, দাম শুনলেই ক্রেতা চলে যায়। বিক্রি অনেক কমে গেছে। কেউ কেউ দোকান বন্ধ করে দিচ্ছেন। ক্রেতা না থাকলে কী করা যাবে? আমার এখানে গতকাল একটা ছেলে কাজ চেয়েছে। আগে সে ফল বিক্রি করত। লাভ হয় না বলে ব্যবসা গুটিয়েছে।

একই বাজারে ফল কিনতে আসেন পশ্চিম তেজতুরি বাজার এলাকার মো. রফিকুল ইসলাম। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এই চাকরিজীবী কালের কণ্ঠকে বলেন, এখানে সরকারকে আমাদের সাহায্য করতে হবে। ফলের ওপর যে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, এতে আমরা বেশ চাপে আছি। আগের মতো আর কিনতে পারছি না ফল। আগে মাসে পাঁচ কেজি ফল কিনতাম, এখন দেড়-দুই কেজি কম কিনছি।

জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি ও আনারের ওপর মোট শুল্ককর ছিল ৮৯.৩২ শতাংশ। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুল্ককর বাড়ানো হয়। তখন মোট শুল্ক দাঁড়ায় ১১৩.৮০ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়িয়ে তা করা হয় ১১৮.৮০ শতাংশ। চলতি অর্থবছর দ্বিতীয় দফায় আবার বাড়ানোর ফলে মোট শুল্ককর হয়েছে ১৩৬.২০ শতাংশ।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএফআইএ) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। হুমকি দিয়ে সংগঠনটি বলেছে, ফলের ওপর বর্ধিত সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার না করা হলে ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের সব স্থল ও নৌবন্দরে আমদানিকরা ফল খালাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখবেন।

সংগঠনটির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম ওই সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফলে শুল্ক বাড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়। বর্তমানে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের কাছে বর্ধিত শুল্কের কারণে দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলের ওপর বর্ধিত শুল্ক আরোপ হটকারী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই না, যা বাতিল করে দেওয়া আবশ্যক। অন্যথায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে ফল।

তিনি বলেন, আগে প্রতি ট্রাক ফল এক দিনে বিক্রি করা সম্ভব হলেও এখন তিন-চার দিনেও সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য পোর্ট থেকে পণ্য খালাস করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে শিপিং ও পোর্টে জরিমানা দিতে হচ্ছে। উচ্চ শুল্কের কারণে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

 

মন্তব্য
অন্য জীবন

সামান্য টাকায় অসামান্য কাজ

পিন্টু রঞ্জন অর্ক, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে
পিন্টু রঞ্জন অর্ক, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে
শেয়ার
সামান্য টাকায় অসামান্য কাজ
পূর্ণ রঞ্জন চাকমা ও বিমলা দেবীর সঙ্গে চঞ্চল কান্তি চাকমা (মাঝে)। ছবি : উয়ই সিং মারমা

খাগড়াছড়ি সদর থেকে উঁচু-নিচু পাহাড়ি রাস্তা ধরে যেতে হয় প্রায় ২৫ কিলোমিটার। দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী ইউনিয়নের উত্তর কামাকুছড়া গ্রাম। চারদিকে চোখজুড়ানো সবুজ। কিছুটা নির্জন।

এর মধ্যে একেবারে রাস্তা লাগোয়া বাড়িটা। নাম অবসর ভবন। বৃদ্ধ মা-বাবার আরাম-আয়েশের জন্য নিজে এটি তৈরি করেছেন চঞ্চল কান্তি চাকমা। যদিও এখন আর তাঁরা বেঁচে নেই।

সামনে বড় উঠান। ভেতরে পা রাখতেই মন ভালো করে দেবে চারপাশে ফুটে থাকা গাঁদা, গোলাপ আর থোকা থোকা পলাশ ফুল। এল আকৃতির ভবন। ফুলগাছের আড়ালে যেন ঢাকা পড়েছে।

সামনে বিশাল করিডর। সেখানে বসে আলাপ করছিলেন তিনজন।

একজন বিমলা দেবী, বয়স আশির ঘরে। জানতে চাইলাম, কেমন আছেন?

তাকানো দেখে বুঝলাম, প্রশ্নটা শুনতে পাননি। তিনজনের মাঝেরজন চঞ্চল কান্তি চাকমা।

ইশারায় তিনি বোঝালেন, শুনতে সমস্যা। এবার কানের কাছে গিয়ে গলার স্বর বাড়িয়ে বললাম, কেমন আছেন?

ছল ছল চোখে এমনভাবে চেয়ে রইলেনযেন এই প্রশ্নটা শুনেছেন অনেক দিন পর! পরে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন, বাবা, শুধু চঞ্চল বাবু মাঝে মাঝে জানতে চায়ভালো আছি কি না।

শুধু বিমলা দেবীরই নন, এমন আরো অনেক প্রবীণের নিয়মিত খোঁজ নেন চঞ্চল। চেষ্টা করেন সাধ্যমতো পাশে দাঁড়াতে। তিনি নিজেও প্রবীণ। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৮ সালে। পেনশন পেতেন ১২ হাজার টাকা। এই সম্বল দিয়েই বছর সাতেক আগে শুরু করেছেন মহৎ এই উদ্যোগ। পাঁচজন মানুষকে ৫০০ টাকা করে প্রতি মাসে মোট আড়াই হাজার টাকা বয়স্ক ভাতা হিসেবে দিচ্ছেন। তাঁদের একজন বিমলা দেবী।

 

এসএসসিতেই ইতি

রাঙামাটির বালুখালীতে এক হতদরিদ্র পরিবারে চঞ্চল কান্তির জন্ম। মা-বাবা কৃষক। শৈশবে কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে যায় ঘরবাড়ি। পরিবার চলে আসে খাগড়াছড়িতে, দীঘিনালার উত্তর কামাকুছড়ায়। তখন চঞ্চলের বয়স মোটে ছয়। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। খেয়ে না-খেয়ে স্কুলে যেতেন। ইউনিফর্মের জন্য শিক্ষকদের বকাও কম খাননি। এসবের মধ্যেই ১৯৭৫ সালে দীঘিনালা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। সেখানে তখন কলেজ না থাকায় যেতে হতো খাগড়াছড়ি রাঙামাটি সদরে। সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকার মতো সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। ফলে পড়াশোনা আর এগোল না!

 

কাঁধে পরিবারের বোঝা

বাবার বয়স হওয়ায় চঞ্চলের ছোট্ট কাঁধে পড়ল পরিবারের বড় বোঝা। স্টোরকিপারের কাজ নেন কর্ণফুলী পেপার মিলে। বছর তিনেক পর ক্লার্ক পদে চাকরি নেন তৎকালীন সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন বোর্ডে। মাস ছয়েক ছিলেন। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে রাঙামাটি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট পদে যোগ দেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক। তাঁরা সবাই সরকারি চাকুরে। তিনি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। ওই সময় এককালীন ২৩ লাখ টাকা পেয়েছিলেন।

 

তাঁরাও মানুষ

মাঝ বয়সে এসে কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখেন চঞ্চল। শৈশবে দেখা এলাকার বয়স্কদের দুঃখ-কষ্ট আর দুর্ভোগের স্মৃতি তাঁকে নাড়া দেয়। বয়স হলে মানুষ কত অসহায়! এ সময় ভালো কিছু খেতে মন চাইলেও সামর্থ্য থাকে না। সন্তানকে মুখ ফুটে বলতে অস্বস্তি লাগে।

সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু অন্যদের সে সুযোগ নেই। দরিদ্র ও শ্রমজীবীরা জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে মানবেতর জীবনযাপন করেন। এসব বয়স্ক মানুষের জন্য কিছু কথার কথা ভাবেন চঞ্চল।

গ্রামের প্রবীণ, বয়স্ক ও দুস্থদের জন্য বয়স্ক ভাতা চালুর উদ্যোগ নিলেন চঞ্চল। তিনি বলেন, সরকারি চাকরিজীবীরা অবসর ভাতা পান। কিন্তু শ্রমজীবীদের বয়স হলে একেবারে অসহায়। যাঁদের শ্রমে-ঘামে ফসল ফলে, ইমারত গড়ে ওঠে, তাঁরা কখনো অবসর ভাতা পান না। এমনকি সন্তানরাও অনেক সময় বৃদ্ধ মা-বাবার খোঁজ রাখে না। ভাবলাম, আমার সামান্য পেনশনের মধ্য থেকে কিছু যদি অসহায়দের দিই, অন্যরা এতে উদ্বুদ্ধ হবে। তাই এমন উদ্যোগ নিয়েছি।

 

সাত বছর ধরে চলছে

২০১৮ সালের ১ অক্টোবর বিশ্বপ্রবীণ দিবসে গ্রামের হতদরিদ্র চারজন নারী ও একজন পুরুষকে মাসিক ৫০০ টাকা হারে দিয়ে বয়স্ক ভাতা প্রদান শুরু করেন চঞ্চল। গত সাত বছর ধরে কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। শুরুতে পাঁচজনকে দিয়েছেন। গত বছর একজন মারা গেছেন। এখন চারজন নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন। চঞ্চল বললেন, আমি তো নিজেও প্রবীণ। তাই এই বয়সী মানুষগুলোর কষ্ট বুঝি। পেনশন যা পাই, তা দিয়ে আমার ভালোই চলে যায়। পেনশনের একটা অংশে যদি কয়েকজনের সামান্য উপকার হয়, এতেই আমার আনন্দ।

এ জন্য একটা নীতিমালাও করেছেন। তাঁর প্রতিপাদ্য কৃতজ্ঞতা ও মানবতার সঙ্গে একটু মমতা মিশিয়ে অসহায় প্রবীণদের প্রতি সহায় হোন

বয়স্ক ভাতা যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁদের একজন দোষা চাকমা। বয়স আশির ঘরে। তাঁর ছেলে-মেয়ের সংসারেও অভাবের কালো ছায়া। ফলে মাকে আর তেমন খরচ দিতে পারেন না। তিনি বয়স্ক ভাতার টাকা দিয়ে নিজের জন্য কিছু ওষুধ কিনেছেন।

চঞ্চল কান্তি চাকমার প্রতি কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ল দোষার কণ্ঠে। চাকমা ভাষায় যা বললেন, তা বাংলা করলে দাঁড়ায়—‘টাকাটা খুব কাজে দেয়। ওষুধ কিনি। ভগবান তাঁকে (চঞ্চল) অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখুক।

আরেকজন উপকারভোগী পূর্ণরঞ্জন চাকমা বললেন, মাঝেমধ্যে ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছা হয়। ছেলের অবস্থাও ভালো নয় যে তাকে বলব। এই টাকা দিয়ে ইচ্ছাপূরণ করি।

চঞ্চল বললেন, ভবিষ্যতে আরো বয়স্ক ব্যক্তিকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যা করছি, এটা সামান্য। চাইলে যে এভাবেও পাশে দাঁড়ানো যায়, সে পথটা দেখানোই ছিল উদ্দেশ্য। সাধ্য অনুযায়ী সবাই যদি নিজ এলাকার অসহায় প্রবীণদের সহায়তা দেয়, তাহলে শেষ বয়সে মানুষগুলোর কষ্ট দেখতে হবে না।

 

আরো মানবিক কাজ

বয়স্ক ভাতা প্রদান ছাড়াও আরো অনেক মানবিক কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছেন চঞ্চল। এলাকায় প্রজ্ঞা ভাবনা বৌদ্ধবিহারে চার লাখ টাকা ব্যয়ে ভিক্ষুসীমা ভবন নির্মাণ করে দিয়েছেন। কামাকুছড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের জমি কেনার জন্য দান করেছেন ৪০ হাজার টাকা। অসহায় দুজন তরুণীকেও ২৪ হাজার টাকা দিয়েছেন। প্রতিবছর দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেন।

এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন। এ ছাড়া ২০২০ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন থেকে পেয়েছেন মানবাধিকার পদক।

 

পৃষ্ঠপোষক পেলে বৃদ্ধাশ্রম হবে

সবার আগে মা-বাবার সেবা এবং অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানুষের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করেন চঞ্চল। তাঁর মা-বাবা থাকতেন মাটির ঘরে। শহরে যেতে বললেও গ্রামের মায়া ছাড়তে রাজি হননি তাঁরা। তাই অবসরের সময় পাওয়া অর্থ থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা দিয়ে তিনি মা-বাবার জন্য বানিয়েছেন অবসর ভবন। এ প্রসঙ্গে চঞ্চল বললেন, আমি বিলাসবহুল জীবনে বিশ্বাসী নই। মা-বাবা বয়সের ভারে দুর্বল। ঘরে একটি পরিবারের সুবিধাজনক বসবাসের জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবই আছে।

সেই ঘরে বেশ আনন্দেই জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন চঞ্চল কান্তির মা সুনীতি বালা চাকমা ও বাবা নিরতা রঞ্জন চাকমা। বছর তিনেক আগে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন তাঁরা।

অবসর ভবনটি এখন বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা চঞ্চলের। বললেন, বৃদ্ধাশ্রম চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অর্থ নেই আমার কাছে। কিন্তু ভবনটি মানুষের কাজে লাগছে দেখে যেতে পারলে মরেও সুখ পাব। পৃষ্ঠপোষক পেলে বিনা শর্তে এটি বৃদ্ধাশ্রম হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ দেব।

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ