কেন্দ্রীয় একজন সহসম্পাদক কালের কণ্ঠকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পরে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এত বৃহৎ পরিসরে নেতার উপস্থিতিতে উৎসবের আমেজে বড় মিলনমেলায় পরিণত হয় এই সভা। আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য এই বর্ধিত সভা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অবশ্য লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। অসুস্থতার মধ্যে দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়াকে পেয়ে নেতারা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তাঁরা বলছেন, দলীয় চেয়ারপারসনের এই উপস্থিতিই ছিল সভার প্রধান আকর্ষণ।
বর্ধিত সভার গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় কর্ম-অধিবেশন বিষয়ে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নেতারা বলেন, অতীতে দেখা গেছে, এমন সভায় জেলা, উপজেলা ও থানার নেতারা গঠনমূলক সমালোচনা করতেন, অভিজ্ঞতার আলোকে বলতেন। কিন্তু এবার সেটা দেখা যায়নি। অর্থাৎ তৃণমূল নেতাদের নানা গঠনমূলক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বর্ধিত সভার যে আমেজ তৈরি হয়, সেটা হয়নি। নেতাদের উপস্থিতি এবং আয়োজনের দিক থেকে সবার প্রশংসা কেড়েছে এই বর্ধিত সভা।
অবশ্য বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী কালের কণ্ঠকে বলেন, সভা অত্যন্ত সফল হয়েছে। তৃণমূলের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। সেই আলোকে ১০ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
১০ প্রস্তাব গ্রহণ : গতকাল শুক্রবার বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে দলের বর্ধিত সভার প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়, বিএনপিকে জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব গ্রহণে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বর্ধিত সভায়। দল এবং সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জনবান্ধব কর্মসূচি নিয়ে জনগণের মাঝে সক্রিয় হওয়ার এবং কথা ও কাজে জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দলীয় নীতি, আদর্শ, কর্মসূচি বাস্তবায়নে অবহেলা এবং দুর্নীতি-অনাচারসহ গণবিরোধী সব কর্মকাণ্ড ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে বিরত থাকার জন্যও সবাইকে কঠোর নির্দেশ প্রদান করছে।
বিএনপির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্বাধীনতার ঘোষক বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর-উত্তমের ঘোষিত ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’—এই আদর্শকে ধারণ করে এই সভা ‘ঐক্যেই শক্তি-ঐক্যেই মুক্তি’ এই আপ্তবাক্যকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দলের সৎ ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন করে বিজয়ের পথে এগিয়ে চলার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।
‘২০১৫ সালে খালেদা জিয়ার ঘোষিত ভিশন ২০৩০ এবং যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলের সমর্থনে গৃহীত ২০২৩ সালে তারেক রহমান ঘোষিত ৩১ দফা রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখার আলোকে রাষ্ট্র সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দল/সংগঠনের সঙ্গে মিলে অব্যাহতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলা হয়, ‘ঐকমত্যে গৃহীত যেসব সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন সম্ভব, তা অবিলম্বে বাস্তবায়ন এবং যেসব সংস্কারের জন্য আইন কিংবা সংবিধান পরিবর্তন প্রয়োজন, তা নির্বাচিত জাতীয় সংসদে অনুমোদনের লক্ষ্যে পেশ করার জন্য বিএনপির বর্ধিত প্রস্তাব করছে।’
সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচনের দাবি : বর্ধিত সভা মনে করে, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমেই শুধু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে থাকে।
সভা থেকে দাবি করে বলা হয়, ‘একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে যথাশীঘ্র সম্ভব সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।’
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি : সভা থেকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের অযৌক্তিক ঊর্ধ্বগতি এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমান অবনতিতে গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে দ্রব্যমূল্য জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করার জন্য অর্ন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি : গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ তাঁর সহযোগীরা কিভাবে নির্বিঘ্নে দেশ থেকে পালিয়ে গেল এবং এখনো অসংখ্য অপরাধী অবাধে বিচরণ করছে তার একটি সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা বিএনপির বর্ধিত সভা সরকারের কাছে দাবি করছে। এসব অপরাধীর বিচার ও শাস্তি প্রদানে বিলম্বে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, বিদেশে অবস্থান করে যারা দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও শান্তি-শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের এবং তাদের দেশীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কূটনৈতিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের আরো উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার : বর্ধিত সভায় ঐক্যবদ্ধ বিএনপি ও অঙ্গ দল, সহযোগী সংগঠনগুলোকে আরো ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী, কার্যকর ও জনপ্রিয় করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অধিকারহীন, অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত ও মানবিকভাবে অবহেলিত জনগণকে তাদের কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মানবিক মর্যাদায় ফিরিয়ে দেওয়ার প্রধান দায়িত্ব দেশের সবচেয়ে বড়, নির্ভরযোগ্য এবং অতীতে বারবার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রদানকারী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের।
তারেকের নেতৃত্বের প্রশংসা : বর্ধিত সভায় ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী এই গণ-অভ্যুত্থানের ভিত্তি স্থাপন ও শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বিজয়ী করার লড়াইয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কৌশলী, সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গণতন্ত্রকামী জনগণের প্রশংসা অর্জন করেছে। দলের দুঃসময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করে দলের কার্যক্রমকে শক্তিশালী, দলকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করা, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি ফ্যাসিবাদ পতনে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। একই সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে শহীদ, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের সহায়তার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি মানবিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।
বর্ধিত সভায় দীর্ঘ ১৬ বছরের অবিরাম আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং আহত, পঙ্গু, দৃষ্টিহীন ও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে সব প্রকৃত শহীদের তালিকা প্রণয়ন, তাঁদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান, তাঁদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান, আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সুচিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানানো হয়েছে।
লন্ডনে চিকিৎসাধীন দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আশু আরোগ্যে দেশবাসীসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কাছে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করার আহ্বান জানানো হয়।