সাংবাদিকতায় এন্ট্রি লেভেলের জন্য ন্যূনতম বেতন বিসিএস কর্মকর্তাদের মতো নবম গ্রেডে করার সুপারিশ করেছে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করতে বলেছে কমিশন।
গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদসহ অন্য সদস্যরা তাঁদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে যেগুলো এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন করে ফেলতে চাই। সে জন্য আমি চাইব, সংস্কার কমিশন আশু করণীয় বা দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায় এমন সুপারিশগুলো তাড়াতাড়ি আলাদাভাবে আমাদের কাছে পেশ করুক।’
এই প্রতিবেদন যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য মানুষ পড়তে পারে, সেই লক্ষ্যে কাজ করার পরামর্শ দেন প্রধান উপদেষ্টা।
দেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একটি নির্দিষ্ট স্যাটেলাইট ব্যবহারে বাধ্য, ফলে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দেখা যায় না।
কমিশনের প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যাতে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা এবং আগ্রহী বিদেশিরা দেখতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার।
কমিশনপ্রধানসহ অন্য সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাঁদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করে পরে যমুনার সামনে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন কমিশনপ্রধান কামাল আহমেদ।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কমিশন সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বেতন-ভাতার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। ওয়েজ বোর্ড নিয়ে একটি মামলার কারণে তা ঝুলে আছে।
ওয়েজ বোর্ডের বিষয়ে কামাল আহমেদ বলেন, সাংবাদিকতায় প্রবেশপদের বেতন বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের নবম গ্রেডের বেতন স্কেলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে, যা সারা দেশের সাংবাদিকদের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়ায় এখানকার সাংবাদিকদের জন্য ‘ঢাকা ভাতা’ যোগ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ভাতার পরিমাণ সরকার ও সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন পক্ষ যৌথভাবে নির্ধারণ করবে।
‘ওয়ান হাউস ওয়ান মিডিয়া’র সুপারিশ
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, একই কম্পানি, গোষ্ঠী, ব্যক্তি বা পরিবারের অধীনে একাধিক গণমাধ্যম থাকা উচিত নয়। এ কারণে তারা ‘ওয়ান হাউস ওয়ান মিডিয়া’ নীতির পক্ষে মত দিয়েছে।
বিশ্বের অনেক দেশেই ‘ক্রস-ওনারশিপ’ (একই মালিকের টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মালিকানা) নিষিদ্ধ।
কমিশনের মতে, বাংলাদেশেও দ্রুত এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিদ্যমান মালিকানায় পরিবর্তন আনতে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে অধ্যাদেশ জারি করা যেতে পারে। মালিকরা যেকোনো একটি মাধ্যম রেখে অন্যগুলোর মালিকানা হস্তান্তর করতে পারেন বা দুটি মাধ্যম একীভূত করে বৃহত্তর ও শক্তিশালী একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।
সংবাদপত্রশিল্পের টিকে থাকা ও উন্নয়নে সুপারিশ
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে, সরকারি বিজ্ঞাপনের হার বেসরকারি বিজ্ঞাপনের তুলনায় অত্যন্ত কম, যা বৈষম্যমূলক। এই পরিস্থিতি দূর করতে সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্যহার বাজারভিত্তিক করা প্রয়োজন। সংবাদপত্রে আরোপিত অগ্রিম আয়কর কার্যত একটি অঘোষিত কর, যা প্রদেয় করের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় না। তাই সংবাদপত্রশিল্পে আরোপিত সব ধরনের অগ্রিম কর বাতিল করা উচিত। একই সঙ্গে করপোরেট ট্যাক্স কমানোও জরুরি। এ ছাড়া সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর বিজ্ঞাপনের পাওনা দ্রুত পরিশোধ এবং গণমাধ্যমের জন্য সহজ শর্তে, স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা উচিত।
অনলাইন পোর্টালের জন্য ৭ দফা সুপারিশ
অনলাইন পোর্টালের জন্য সাত দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নিবন্ধনের নীতিমালা হালনাগাদ করে স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশনের অধীনে দেওয়া উচিত, নিবন্ধনের জন্য একাধিক নিরাপত্তা সংস্থার তদন্তব্যবস্থা বাদ দিয়ে শুধু পুলিশের তদন্ত যথেষ্ট হবে ইত্যাদি।
সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য আইন সংস্কারের সুপারিশ
সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে জাতীয় নিরাপত্তা ও বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ শুধু যুদ্ধাবস্থায় প্রযোজ্য করার বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
বাসস, বিটিভি ও বেতার একীভূতকরণের প্রস্তাব
রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের লক্ষ্যে বাসসকে বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গে একীভূত করে একটি কেন্দ্রীয় বার্তা বিভাগ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই নতুন প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ সম্প্রচার সংস্থা’ বা ‘জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা’ নামে পরিচালিত হতে পারে।
সার্কুলেশনের জালিয়াতি রোধে কোনো সুপারিশ করা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে কামাল আহমেদ বলেন, পত্রিকার সার্কুলেশন যাচাইয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া পত্রিকা বিক্রির বিল রসিদ যাচাই করারও সুপারিশ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।