সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা

কাজী হাফিজ
কাজী হাফিজ
শেয়ার
সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা
রাজধানীর একটি সড়কে সতর্ক অবস্থানে সেনা সদস্যরা। —ফাইল ছবি

সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমণাত্মক কথা না বলার আহ্বান জানিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বলেছিলেন, একটা কমন জিনিস আমি দেখতে পাচ্ছি, সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের প্রতি বিদ্বেষ কারো কারো। কিন্তু কী কারণে, আজ পর্যন্ত আমি এটা খুঁজে পাইনি।

সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টাওই দিন সেনাপ্রধান আরো বলেন, আমরা হচ্ছি একমাত্র ফোর্স, যেটা আপনাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছি, দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফরমে। অবকোর্স নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স।

নেভি, এয়ারফোর্স উই অল। আমাদের সাহায্য করেন, আমাদের আক্রমণ করবেন না। আমাদের অনুপ্রাণিত করেন, আমাদের উপদেশ দেন। আমাদের প্রতি আক্রমণ করবেন না।
উপদেশ দেন, আমরা অবশ্যই ভালো উপদেশ গ্রহণ করব। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই এবং দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।

সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টাকিন্তু সেনাপ্রধানের সেই অনুরোধেও ঐক্য বিনষ্টকারীদের অপচেষ্টা থামেনি। কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বেশ কিছু দিন ধরেই সেনাপ্রধান সম্পর্কে কটূক্তি ও  অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ বিস্ময়করভাবে নিজের ফেসবুক পোস্টে  ক্যান্টনমেন্টের চাপ-এর কথা বলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেন। তবে হাসনাতের এই বক্তব্য তাঁর দলের অনেকেই সমর্থন করতে পারেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীবিরোধী আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেশে বিভাজন তৈরি করতে পারে এবং কৌশলগতভাবে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করতে পারে।  দেশ এখন একটি কঠিন ও জটিল সময় পার করছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি পক্ষের আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও বিষোদগার অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত ঘটনা।

ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি পাল্টে ফেলতে চাচ্ছে। বিভিন্নভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করছে। একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে জনগণকে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছে। একই সঙ্গে জনগণকেও সরকারের মুখোমুখি করাতে চাচ্ছে। ত্রিমুখী একটি সংঘর্ষ লাগানোর অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। অস্থিতিশীল করার এই পরিকল্পনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে এবং সর্বোপরি সাহায্য করছে কি না বলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা।

তাঁরা বলছেন, ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে  সেনাবাহিনী বাঁকবদলকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আন্দোলকারী জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাবাহিনী। গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেছিল দেশ ও জাতিকে। এই সত্য অনস্বীকার্য।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ৬ অক্টোবর  সেনা সদরে নির্বাচনী পর্ষদ ২০২৪-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই সত্য স্বীকার করে বলেছিলেন, দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনীর সহায়ক ভূমিকার কথা স্মরণ করতে অনেকেই ৩ আগস্টের কথা স্মরণ করেন। সেনাবাহিনী আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাবে না, জনগণের পাশে থাকবেএই বার্তা ৩ আগস্টই ছড়িয়ে পড়ে। ওই দিন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা সদরের হেলমেট অডিটরিয়ামে অফিসার্স অ্যাড্রেস গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশে দেশের চলমান নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর আলোকপাত করে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের জনগণের আস্থার প্রতীক। জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের যেকোনো প্রয়োজনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে। যেকোনো উসকানির মুখেও ছাত্র ও সাধারণ জনগণের দিকে গুলি না ছুড়তে তিনি সেনা সদস্যদের নির্দেশ দেন। জানা যায়, ওই দিন সেনাপ্রধান তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের কাছে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চান এবং স্পষ্ট করে বলেন, এখন থেকে আর কোনো গুলি নয়।

সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার আত্মীয়এ পরিচয়েও জেনারেল ওয়াকারকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি কারো সঙ্গে আত্মীয়র পরিচয়ের বাইরেও একজন দেশপ্রেমিক দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে  ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন বলে অনেকের মূল্যায়ন। সেনাবাহিনীর ১৩ লং কোর্সে সেনাপ্রধানের কোর্সমেট ছিলেন মেজর জাবের (অব.)। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেছিলেন, জেনারেল ওয়াকার ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করার আদেশ মেনে নিতে পারেননি। তাঁকে আমরা যেভাবে জানি, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সমর্থন দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। আমাদের জানা মতে, ১৭ জুলাইয়ের পর থেকেই এ আদেশ নিয়ে তিনি চাপের মুখে ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি ছাত্র-জনতার ওপর গুলি না চালাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।

শেখ হাসিনার পক্ষ অবলম্বনকারী হিসেবে পরিচিত সেনা কর্মকর্তা লে. জেনারেল সাইফুল আলম (৫ আগস্টের পর চাকরিচ্যুত)  ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ফোনালাপের একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়। তাতে জানা যায়, ডিজিএফআইয়ের দায়িত্ব ছাড়া আগে জুলাইয়ের শেষদিকে সাইফুল আলম কাউকে এই মর্মে  বলছেন যে শেখ পরিবারে জেনারেল ওয়াকার বিয়ে করলেও তাঁর মানসিকতা ভিন্ন। জামায়াত-শিবিরকে তিনি এই যুক্তিতে ক্ষমা করে দেওয়ার পক্ষে যে এখন যাঁরা জামায়াত-শিবির করেন, তাঁদের অনেকের জন্ম একাত্তরের পরে। 

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শিল্প-কারখানাগুলোর নিরাপত্তার বিষয়ে ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত ৮ আগস্ট ঢাকায় সেনা সদরে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা। এ সময় তাঁরা শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহযোগিতা চান। জবাবে দেশের সব নাগরিকের পাশাপাশি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবেন বলে ব্যবসায়ী নেতাদের আশ্বস্ত করেন সেনাপ্র্রধান। বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সাপ্লাই চেইন ও বন্দরের নিরাপত্তা এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নির্বিঘ্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী সর্বদা তৎপর আছে।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা, পুলিশ সদস্যদের ভগ্ন মনোবল দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালানো, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, মাদকবিরোধী অভিযানএসব কাজেও সেনাবাহিনীর নিরলস চেষ্টা অব্যাহত।

 গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে আগের ৫০ দিনে সেনাবাহিনীর কার্যক্রমের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন সেনা সদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ওই সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৮৮টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ৩০ বার মূল সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া গত এক মাসে ৪২টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, রাজনৈতিক কোন্দল এবং অন্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনাও ছিল।

সামরিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য : সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও বিষোদগার সম্পর্কে সামরিক বিশেষজ্ঞ রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) আব্দুল হক গতকাল এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের জন্য সময় এখন খুবই স্পর্শকাতর। ফ্যাসিস্ট হাসিনার রেখে যাওয়া প্রেতাত্মারা খুব সরব। দক্ষতার সঙ্গে তারা পরিস্থিতি পাল্টে ফেলতে চাচ্ছে। বিভিন্নভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তারা কিন্তু গত ১৬ বছর বসে ছিল না। অর্থবিত্ত চুরি-ডাকাতি করেছে, দেশের সম্পদ পাচার করেছে। কিছু লোক বাইরে চলে গেছে; আর যারা দেশে আছে, তারা সম্মিলিতভাবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে সেনাবাহিনীকে সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাচ্ছে। জনগণকেও সরকারের মুখোমুখি করাতে চাচ্ছে। ত্রিমুখী একটি সংঘর্ষ লাগানোর অপচেষ্টায় তারা লিপ্ত। এই অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বন্ধুরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছে, উৎসাহ দিচ্ছে এবং সর্বোপরি সাহায্য করছে।

তিনি আরো বলেন, সেনাবাহিনী হচ্ছে একটি দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সেনাবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়লে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব টিকে থাকবে না। সেই সময় আমাদের প্রতিবেশী দেশ হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই পরিস্থিতিই চাচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার দোসররা। শুধু ফ্যাসিস্ট না, ফ্যাসিস্টের চেয়ে যদি কঠিন শব্দ থাকে সে শব্দ হাসিনা ও তার দোসরদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। শুধু অর্থ লুটপাট না, এ দেশের মানুষের চরিত্রও ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে ওরা। এই চরিত্র ধ্বংস শুধু নিজেদের দলের মধ্যে না, প্রশাসনের চরিত্র ধ্বংস করেছে, পুলিশের চরিত্র ধ্বংস করেছে, রাষ্ট্রের যত স্টেক হোল্ডার রয়েছে, সবার চরিত্র ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। তারা জনগণের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারাই এখন চাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি নানাভাবে অস্থিতিশীল করতে। এ জন্য দুর্বল লোকজন খুঁজে বের করছে। পরিস্থিতি বোঝার জন্য ম্যাচুরিটি লাগে। বুঝতে হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতে নাড়া দিতে হয় না। এতে নিজেদেরই ক্ষতি হয়। পরিকক্বতার অভাবে তাদের দলকে দুর্বল ভাববে মানুষ। দলটার প্রতি সাধারণ মানুষ আগ্রহ দেখিয়েছিল; কিন্তু সেনাবাহিনী প্রধান, সেনাবাহিনীর প্রতি রুখে দাঁড়ানোর হুমকি, দেশকে টালমাটাল করার চেষ্টা যারা করে, তাদের প্রতি তো মানুষ আস্থা রাখতে পারবে না। তারা ভুল করেছে। যেকোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, আমি সামরিক ও সামাজিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে বলব, এখনো যদি পরিস্থিতির অবনতি হয়, মানুষ আর্মির কাছে চলে যাবে। এখন যদি আর্মি উঠিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে দেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে আপনারা কল্পনা করতে পারছেন? রাস্তায় হাঁটার মতো পরিস্থিতি থাকবে না। এই বিষয়টি অনেকে বোঝেন না। যদি গণ্ডগোল লাগে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসই বলবেন, আর্মি নামাও। তখন বাধ্য হয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা এই পরিস্থিতিই সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। সামরিকবাহিনী সম্পর্কে ঘরোয়াভাবে যে কথা বলা যায়, প্রকাশ্যে তা বলা উচিত না। সেনাবাহিনী প্রধান একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর মর্যাদার সঙ্গে সেনাবাহিনীর মর্যাদাও জড়িত। কেউ যদি ঘরোয়া আলোচনায় কিছু বলে থাকেন, সেটা প্রকাশ করা ঠিক না। কেউ কি তাদের ঘরের কথা বাইরে প্রকাশ করেন? কোনো ব্যক্তির নিজস্ব মতামত থাকতেই পারে। সেই মতামত তো বাইরে প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। উনি তো কাউকে ডেকে নিয়ে যাননি। যাঁরা এই অপরিপক্ব কাজটি করেছেন, তাঁরাই  এখন বলছেন, আমাদের ভুল হয়ে গেছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পক্ষে একাত্ম থাকে। ২০২৪-এর জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে বা জুলাই বিপ্লবের সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বাঁকবদলকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তী সাত মাসে পুলিশসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্বল অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও অন্তর্বর্তী সরকারের শক্তিশালী কার্যকর শক্তি হলো সেনাবাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে একটি পক্ষের আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও বিষোদগার অত্যন্ত দুঃখজনক  ও অনভিপ্রেত ঘটনা। আমরা জটিল ও কঠিন সময় পার করছি। এই সময় জুলাই বিপ্লবের অসাধারণ সাহসী ও বীরত্বসুলভ ভূমিকা পালনকারী কিছু তরুণ নেতার (বর্তমানে এনসিপি নেতা)  সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনীবিরোধী আক্রমণাত্মক বক্তব্য দেশে বিভাজন তৈরি করতে পারে এবং কৌশলগতভাবে রাষ্ট্রকেই দুর্বল করতে পারে। এখন সব পক্ষের ধৈর্য ও বিচক্ষণতা কাম্য। এই ক্রান্তিলগ্নে প্রয়োজন ঐক্যের।

মেজর জেনারেল ( অব.) মো. নাঈম আশফাকুর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের প্রত্যেক নাগরিকের একটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ইন্টিগ্রেশন। আমাদের অবজেক্টিভ হওয়া দরকার ঐক্য। ভিন্নমত থাকতেই পারে। একেকজনের একেক ধরনের মতামত হবেএটাই বিউটি অব ডেমোক্রেসি। কিন্তু দেশের ইউনিটিকে ধ্বংস করা কারোরই উচিত না। বিশেষ করে যাঁরা কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের নেতৃত্বে আছেন। তিনি স্টুডেন্ড লিডার অথবা পলিটিক্যাল লিডার হলে তাঁর প্রতিটি বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ জনগণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ জনগণ তাঁর প্রতিটি শব্দ তাঁর অনুপস্থিতে ইন্টারপ্রিটেশন করবে এবং নিজেদের মতো করে বুঝে নেবে। এই জন্য তিনি কী বাক্য, শব্দ ব্যবহার করবেন, তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, কী কী ভাবে হতে পারে এসব দিক বিবেচনা করে মন্তব্য করা উচিত।  বিশেষ করে পোস্ট জুলাই রেভল্যুশনের পরের যে অবস্থা, আমরা একটি জটিল সময় পার করছি, রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে, সব সংস্কার তো আর এত দ্রুত করা যাবে না। রাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই দুর্বল অবস্থায় আছে সেগুলোর সংস্কার দরকার। নির্বাচনও এগিয়ে আসছে। এই সময় সেনাপ্রধান ও সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক এবং ঐক্যবিনষ্টকারী বক্তব্য  অপ্রত্যাশিত।  কারো প্ররোচনায় এ ধরনের বক্তব্য এসেছে কি না  সেটাও জানার বিষয়। আমার মতে, আমাদের ঐক্যের দিকেই এগিয়ে যাওয়া উচিত। অনৈক্যের দিকে নয়। আমিআপনি এই সব শব্দ বাদ রেখে এখন আমরা বলতে হবে। আমরা কখন, কিভাবে বলতে পারব তার ওপর কাজ করা উচিত। যা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত। সেনাবাহিনীকে নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্য সাধারণ জনগণও মেনে নিচ্ছে না। আপনি একদিকে বলবেন সেনাবাহিনীই হচ্ছে জাতীয় ঐক্য ও দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য শেষ ভরসা, আবার এই সংস্থার দিকে আঙুল তুলছেন। এটা শুধু সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল তোলা নয়, রাষ্ট্রের দিকেও আঙুল তুলছেন।

এনসিপি নেতার ভুল স্বীকার : সেনাবাহিনীকে নিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহর কথাগুলো যেভাবে ফেসবুক স্ট্যাটাসে এসেছে, সেই প্রক্রিয়াটি সমীচীন মনে হয়নি। এর ফলে পরবর্তী সময়ে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে দলটির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারেএ মন্তব্য করেছেন দলটির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথিত  বৈঠকের ১০ দিন পর হাসনাত আব্দুল্লাহ গত ২১ মার্চ তাঁর ফেসবুকে  সেনাপ্রধান, সেনাবাহিনী সম্পর্কে আক্রমণাত্মক  স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর নিজ দলের মধ্যেই ভিন্নমত প্রকাশের ঘটনা ঘটে। হাসনাত আব্দুল্লাহ ওই পোস্ট সম্পর্কে গতকাল রবিবার নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আরেক মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি ১১ মার্চ সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ নিয়ে আমার জায়গা থেকে কিছু সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন শিরোনামে লেখেন, সেদিন আমি এবং হাসনাত সেনাপ্রধানের সাথে গিয়ে কথা বলি। আমাদের সাথে আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ আরেকজন সদস্যেরও যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি যেতে পারেননি। প্রথমেই স্পষ্ট করে জানিয়ে রাখি, সেদিন সেনানিবাসে আমাদের ডেকে নেওয়া হয়নি বরং সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজরের সাথে যখন প্রয়োজন হতো তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসা ও উত্তর আদান-প্রদান হতো। যেদিন সেনাপ্রধান পিলখানা হত্যাকাণ্ড দিবসে (২৫ ফেব্রুয়ারি) অনেকটা কড়া ভাষায় বক্তব্য দিলেন এবং বললেন, এনাফ ইজ এনাফ তখন আমি সেনাপ্রধানের মিলিটারি অ্যাডভাইজরকে জিজ্ঞাসা করি আপনাদের দৃষ্টিতে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখছেন কি না? সেনাপ্রধানের বক্তব্য তুলনামূলক ংঃত্ধরমযঃ-ভড়িধত্ফ এবং যধত্ংয মনে হচ্ছে। তিনি আমাকে বললেন, তোমরা কি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে চাও? আমি বললাম, বলা যেতে পারে। এর পর সেদিন সেনাপ্রধানের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। সেনাভবনে সেই রুমে আমরা তিনজনই ছিলাম। সেনাপ্রধান, হাসনাত এবং আমি। মানুষ হিসেবে যেকোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অবজার্ভ ও রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে আমার সে ক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে। আমার জায়গা থেকে আমি সেদিনের বক্তব্যকে সরাসরি প্রস্তাব দেওয়ার আঙ্গিকে দেখি না; বরং সরাসরি অভিমত প্রকাশের মতো করে দেখি। অভিমত প্রকাশ এবং প্রস্তাব দেওয়া দুটি বিষয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যদিও পূর্বের তুলনায় সেদিন সেনাপ্রধান অনেকটা  স্ট্রেইট-ফরওয়ার্ড ভাষায় কথা বলছিলেন। পাশাপাশি রিফাইন্ড আওয়ামী লীগের জন্য চাপ দেওয়ার যে বিষয়টি এসেছে সেখানে চাপ দেওয়া হয়েছে এমনটি আমার মনে হয়নি; বরং রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ না আসলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের পরিস্থিতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে সমস্যার সৃষ্টি হবে সেটা তিনি অতি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছিলেন।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সচিবালয় এলাকায় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ আহত অর্ধশতাধিক

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
সচিবালয় এলাকায় শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ আহত অর্ধশতাধিক

রাজধানীতে বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে আন্দোলনকারী শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়ের লিংক রোডের সামনে এই ঘটনা ঘটে।

সংঘর্ষের সময় উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৪০ জন শ্রমিক এবং ১১ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন।

পুলিশের দাবি, সংঘর্ষ চলাকালে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। আর আন্দোলনকারী শ্রমিকরা বলছেন, পুলিশ বিনা উসকানিতে তাঁদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করলে আতঙ্কে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। এ সময় শ্রমিকদের মারধর করা হয় বলেও তাঁরা অভিযোগ করেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শাহবাগ থানার পরিদর্শক সরদার বুলবুল আহমেদ বলেন, সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার চেষ্টা করেন।

এ সময় পুলিশ তাঁদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু শ্রমিকরা পুলিশের ওপর হামলা করলে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ফজলে রাব্বি নামের এক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হয়েছেন।

গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন, সচিবালয়ের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে  তাঁদের ৩০ থেকে ৩৫ জন শ্রমিক আহত হয়েছেন।

জানা গেছে, টানা তিন দিন ধরে শ্রম মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে আসছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল সকাল ১০টার দিকে নয়াপল্টন থেকে বিজয়নগরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন তাঁরা। এ সময় পুলিশ তাঁদের প্রথমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও সেই বাধা উপেক্ষা করে তাঁরা সামনে এগিয়ে যান। পরে পল্টন পার হয়ে তোপখানা রোডে প্রবেশ করতে গেলে পুলিশ আবারও তাঁদের বাধা দেয়, যা পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়।

এরপর তাঁরা সেখান থেকে সচিবালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে যান। এ সময়  শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দিতে ধাওয়া দেয়। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এতে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনে অংশ নেন টি এন জেড অ্যাপারেলস, অ্যাপারেল প্লাস ইকো লিমিটেড, রোর ফ্যাশন, স্টাইল ক্রাফট গার্মেন্টস ও ডার্ড কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডের কয়েক শ শ্রমিক।

সংঘর্ষের এক পর্যায়ে  শ্রম ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ও সোয়েটার্স শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন  বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। বেতন-বোনাস না পেলে ঈদের দিন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও করা হবে।

শাহবাগ থানার পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সচিবালয় সড়কে ঢুকতে চাইলে নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকদের বাধা দেওয়া হয়। এ সময় তাঁরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে টিয়ার শেল ছুড়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

শাহবাগ থানার ওসি মো. খালিদ মনসুর বলেন, পুলিশের ব্যারিকেড থেকে দূরে থাকতেই শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে আমাদের কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। অল্প সময়ের মধ্যে আমরা তাঁদের  ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। পরে শ্রমিকরা যে যাঁর মতো চলে গেছেন।

 

 

মন্তব্য

১০% কারখানা নিয়ে আশঙ্কা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
১০% কারখানা নিয়ে আশঙ্কা
ঈদের আগে বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে গতকাল শ্রমিকরা শ্রম ভবনের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের দিকে যাওয়ার সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। ছবি : সংগৃহীত

তৈরি পোশাকশিল্পের নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও অধিকাংশ মালিক শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ করেছেন। কিছু কারখানা, যেগুলো নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে সেগুলো নিয়েও মালিক-শ্রমিক ও সরকার তৎপর। আশা করা হচ্ছে দু-এক দিনের মধ্যে এ সংকটও কেটে যাবে। গতকাল মঙ্গলবার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

১০% কারখানা নিয়ে আশঙ্কাখাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক হাজার কারখানার মধ্যে দু-চার-দশটি কারখানায় প্রতিবছরই সংকট দেখা দেয়। তবে সবশেষে খুশিমনে শ্রমিকরা ঈদ করতে বাড়ি ফিরতে পারেন।

এদিকে ১৪টি কারখানার বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস নিয়ে গতকাল আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিজিএমইএ। তবে এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলেও জানিয়েছে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠনটি।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল কালের কণ্ঠকে বলেন, আশা করছি প্রতিবারের মতো এবারও শ্রমিকরা তাঁদের ঈদ বোনাস ও বকেয়া বেতন নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এর জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ব্যাংকগুলোকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। কারণ এসব ব্যাংক তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদেরই অংশীদার। তাই যেসব মালিক ব্যাংকঋণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের সহযোগিতায় হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।

সমস্যা সমাধানে কাজ করতে হবে। 

তিনি বলেন, শ্রমিক ভাইদের প্রতি অনুরোধ, ভাঙচুর চালিয়ে এই শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন না। এতে কর্মসংস্থানসহ দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো পক্ষই উপকৃত হবে না।

এদিকে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন এবং ঈদ বোনাস নিয়ে গতকালও রাজধানীতে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে।

 

গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাব ও সচিবালয়ের লিংক রোডে পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে।

 

১২ পোশাক কারখানার মালিকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা

সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস পরিশোধ না করায় ১২টি কারখানার মালিকের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। এসব কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ না করা পর্যন্ত বিদেশ যেতে পারবেন না।

গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নৌ পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এ তথ্য জানান।

শ্রম উপদেষ্টা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইমিগ্রেশনে তাঁদের বিষয়ে তথ্য জানানো হয়েছে। আজ (গতকাল) থেকেই এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে।

তিনি বলেন, ২৭ মার্চের মধ্যে পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ১২টি কারখানা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছে না বলে জানিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি কারখানায় অসন্তোষ চলছে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাঁরা বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারছেন না, তাঁদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। আমরা শ্রম আইন অনুযায়ী এঁদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেববলেন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন।

কোনো কোনো কারখানার মালিকদের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কারখানাগুলোর নাম বলা যাবে না বলে জানান উপদেষ্টা।

১২ কারখানার বাইরে অন্য কারখানা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ না করলে তাঁদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে প্রশ্ন করলে উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ২৭ মার্চের মধ্যে সব কারখানার শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে হবে। ২৭ মার্চের পর আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করব। যদি আরো কোনো প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধ করতে না পারে তাদের বিরুদ্ধেও সর্বোচ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

কালিয়াকৈরে বকেয়া বেতন না দিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে পলাতক কর্তৃপক্ষ

কালিয়াকৈর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে তিন মাসের বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাস না দিয়ে কারখানার গেটে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ।  মঙ্গলবার সকালে  মৌচাকের  কামরাঙ্গীচালা এলাকার হ্যাগ নিট ওয়্যার নামের একটি নিট কারখানার শ্রমিকরা বেতনের জন্য কারখানায় এসে তালা দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। পরে বকেয়া বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এতে ওই মহাসড়কে চলাচলকারীরা বিপাকে পড়ে।

কারখানার শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, চলতি মাসসহ তিন মাস ধরে তাঁদের কোনো বেতন দেয় না মালিক পক্ষ। আশপাশের সব কারখানায় বেতন ও ঈদের বোনাস দেওয়া হয়েছে। পরিবার-পরিজন নিয়ে কিভাবে এখন তাঁরা ঈদ করবেন।

কালিয়াকৈর থানার ওসি রিয়াদ মাহমুদ বলেন, মৌচাকের একটি কারখানা কর্তৃপকক্ষ শ্রমিকদের বেতন ও ঈদ বোনাস না দিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে রেখেছে। তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করেছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে। পরে শ্রমিকরা কারখানার সামনে গিয়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন।

 

সাভারে ঈদের ছুটি বৃদ্ধি, বন্ধ কারখানা চালুর দাবিতে শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ

সাভার (ঢাকা) প্রতিনিধি, জানান সাভারে ঈদের ছুটি বৃদ্ধি, বন্ধ কারখানা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের ওভারটাইম পরিশোধ এবং দাবি আদায়ে আন্দোলনের ঘটনায় আটক ছয় শ্রমিকের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন তৈরি পোশাক শ্রমিকরা। এ সময় কারখানা বন্ধের প্রতিবাদ জানিয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসী দিয়ে শ্রমিকদের ওপর হামলা-মামলার প্রতিবাদ জানিয়ে কর্তৃপক্ষের অপসারণ দাবি করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তাঁরা। গতকাল সকালে সাভারের হেমায়েতপুর-সিংগাইর-মানিকগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় জিন্স ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি লিমিটেড কারখানার দুই হাজার শ্রমিক।

 

 

মন্তব্য

ব্যাঙ্ককে ইউনূস-মোদি বৈঠকের জন্য প্রস্তুত ঢাকা দিল্লির সম্মতির অপেক্ষা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
ব্যাঙ্ককে ইউনূস-মোদি বৈঠকের জন্য প্রস্তুত ঢাকা দিল্লির সম্মতির অপেক্ষা

আগামী সপ্তাহে ব্যাঙ্ককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকের জন্য ঢাকা প্রস্তুত। এ বৈঠকের জন্য নয়াদিল্লির ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় আছে ঢাকা।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন এ কথা জানান। ড. ইউনূস-নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, যেকোনো দেশের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের যে বৈঠক, সেই বৈঠক আমরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি।

ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বর্তমান যে প্রেক্ষাপট সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠকটি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি এবং আমরা আশা করছি, এই বৈঠকটি যদি অনুষ্ঠিত হয় তাহলে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সৃষ্ট যে স্থবিরতা, সেটি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আমাদের দিক থেকে বলতে পারি, আমরা এই বৈঠকের জন্য প্রস্তুত আছি। ভারতের দিক থেকে আমরা একটা ইতিবাচক উত্তরের অপেক্ষায় আছি।

বৈঠকের জন্য দিল্লি কি প্রস্তুত নয়এই প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, দিল্লি প্রস্তুত কি না, সেটা দিল্লি বলবে।

আমরা এই বৈঠকের অপেক্ষায় থাকব।

ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আগামী ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ৩ এপ্রিল ব্যাঙ্ককে পৌঁছবেন।

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, তিনি আগামী ২ এপ্রিল বিমসটেকের সচিব পর্যায়ের সভায় অংশ নেবেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আগামী ৩ এপ্রিল বিমসটেকের মন্ত্রী পর্যায়ের সভায় অংশ নেবেন। প্রধান উপদেষ্টা শীর্ষ সম্মেলন শেষে আগামী ৪ এপ্রিল বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হবেন।

পররাষ্ট্রসচিব বলেন, এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের আগে আগামী ৩ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা বিমসটেক ইয়াং জেনারেশন ফোরাম : হয়্যার দ্য ফিউচার মিটস শীর্ষক ফোরামে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেবেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ আগামী ২ বছরের জন্য বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করবে। এ কারণে এবারের বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আসন্ন বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা বিমসটেক সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে মতবিনিময় করবেন এবং বিমসটেক অঞ্চলের জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নসহ এই অঞ্চলকে আর্থ-সামাজিকভাবে আরো উন্নত, টেকসই ও শান্তিপূর্ণ হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন। বিমসটেকের আওতায় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিমসটেক মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, যোগাযোগ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন, জ্বালানি সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা ও মানব নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কৃষি, সংস্কৃতি, পর্যটনের বিকাশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অতিমারি মোকাবেলায় প্রস্তুতি প্রভৃতি বিষয়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার অগ্রগতি পর্যালোচনাপূর্বক শীর্ষ সম্মেলনে রাষ্ট্র/সরকারপ্রধানরা সর্বসম্মতিক্রমে যৌথ ঘোষণা দেবেন। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট কো-অপারেশন সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। এ চুক্তি বাণিজ্যিক শিপিং ও সামুদ্রিক পরিবহন শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে।

 

 

মন্তব্য
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ

জরুরি অবস্থা ঘোষণায় দ্বিমত বিএনপির

হাসান শিপলু
হাসান শিপলু
শেয়ার
জরুরি অবস্থা ঘোষণায় দ্বিমত বিএনপির

জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। দলটি বলেছে, জরুরি অবস্থা জারির সঙ্গে সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হওয়ায় এসংক্রান্ত ক্ষমতা সরকার ও সংসদের বাইরে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা সংগত নয়।

সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরো বলা হয়, জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। তাই অনুচ্ছেদ ১৪১(খ) ও অনুচ্ছেদ ১৪১(গ) বাতিল হবে।

এই প্রস্তাবের সঙ্গেও একমত নয় বিএনপি। দলটির মতামত, নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত না করে জরুরি অবস্থা জারির কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, প্রস্তাবিত সুপারিশে তা বোধগম্য নয়।

গত রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে জমা দেওয়া সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর বিএনপি এই মতামত তুলে ধরেছে।

বিএনপির দেওয়া মতামত পর্যালোচনায় এ তথ্য জানা গেছে।

ওই দিন সংবিধান কমিশনসহ পাঁচ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর মতামত জমা দেয় দলটি। জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের বিষয়টি প্রস্তাবিত।

সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশের ওপর দেওয়া মতামতে বিএনপি জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। সংস্কার কমিশনের চার বছর মেয়াদের সুপারিশের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দলটি এই মত দেয়।

একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক দলের প্রধান ও সংসদ নেতা হতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে দলটি বলেছে, এটি রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তের বিষয়।

প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান কিংবা সংসদ নেতা হিসেবে থাকতে পারবেন না বলে সংবিধান সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে সে বিষয়ে বিএনপির বক্তব্য হলো প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধান অথবা সংসদ নেতা পদে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হবেন কি না, তা একান্তই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী।

অবশ্য সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সময়ে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করা হয়।

এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ব্যবস্থা। জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা সাংবিধানিক বিধান। এ ক্ষেত্রে  আগের মতো ৯০ দিন মেয়াদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এই সময়ে শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা আবশ্যক, অন্য কোনো নির্বাচন নয়। সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো সুযোগ নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, দলের পক্ষ থেকে সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। এখন সরকার অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে—এটাই সবার প্রত্যাশা। তিনি বলেন, সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব নির্বাচিত সরকারের। সে জন্য সংবিধানসংক্রান্ত কোনো সংশোধন করতে হলে আগে নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচিত সরকার সংসদে সেই সংশোধন আনবে।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ওপর বিএনপির মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স ২১ বছর চায় না দলটি। আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হওয়ার বিধানের সঙ্গেও একমত নয়। তবে সংসদের দুজন ডেপুটি স্পিকারের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত করায় দলটি একমত। একই সঙ্গে উচ্চকক্ষের একমাত্র ডেপুটি স্পিকার সরকারি দলের বাইরে থেকে নির্বাচিত হোক, সেটাও চায় বিএনপি।

বিএনপির দেওয়া মতামত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট একটি আইনসভার বিষয়ে নীতিগতভাবে তারা একমত। তবে উভয় কক্ষের (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ) মেয়াদ চার বছর করার যে সুপারিশ করা হয়েছে, সেখানে বিএনপি বলেছে, মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া সমীচীন হবে।

প্রস্তাবের সংবিধান সংশোধনী অংশে সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় অনুমোদন এবং গণভোটে করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি এর সঙ্গে একমত নয়। দলটি বলেছে, সংবিধানের সব সংশোধনী গণভোটে উপস্থাপন বাস্তবসম্মত নয়। এ ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ১৪২-কে পঞ্চদশ সংশোধনীপূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই যথেষ্ট। নিম্নকক্ষে পাস হওয়া বিল উচ্চকক্ষ সুপারিশসহ কিংবা সুপারিশ ব্যতিরেকে পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে ফেরত পাঠাতে পারবে—এরূপ বিধান করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রপতি অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ হবে চার বছর। রাষ্ট্রপতি সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি অধিষ্ঠিত থাকবেন না। এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত না হয়ে বিএনপি তাদের মতামতে বলেছে, রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছর হওয়া সমীচীন হবে। বিদ্যমান সংবিধানে সর্বোচ্চ দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত না থাকার বিধান [অনুচ্ছেদ ৫০(২)] থাকায় এতত্সংক্রান্ত সুপারিশ অপ্রয়োজনীয়।

প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী অংশে বলা হয়েছে, আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবে। এর সঙ্গে একমত নয় বিএনপি।

প্রধানমন্ত্রী অংশে আরো বলা হয়েছে, আইনসভার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগে যদি কখনো প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা আস্থা ভোটে হেরে যান কিংবা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতিকে আইনসভা ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন, সে ক্ষেত্রে যদি রাষ্ট্রপতির কাছে এটা প্রতীয়মান হয় যে নিম্নকক্ষের অন্য কোনো সদস্য সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে, তবেই রাষ্ট্রপতি আইনসভার উভয় কক্ষ ভেঙে দেবেন। সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশের সঙ্গে একমত নয় বিএনপি।

বলা হয়েছে, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সর্বোচ্চ দুইবার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। তিনি একাদিক্রমে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে পারবেন না। সুপাশিরকৃত এই বিধানের সঙ্গে একমত পোষণ না করে বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদসংক্রান্ত বিষয়ে ‘কোনো ব্যক্তি একাদিক্রমে তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভের যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইবেন না’—এরূপ বিধান করাই যথেষ্ট।

প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং সংসদ নেতা হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকতে পারবেন না। এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বিএনপি বলেছে, প্রধানমন্ত্রী দলের প্রধান অথবা সংসদ নেতা পদে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি অধিষ্ঠিত হবেন কি না, তা একান্তই সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল চেতনার পরিপন্থী।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিচার বিভাগের সুপ্রিম কোর্ট অংশে দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ারসম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন রাজধানীতেই থাকবে। সব বিভাগে হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের বিষয়ে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, দেশের সব বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী আসন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় এটি করার সুযোগ নেই। বিকল্প হিসেবে ঢাকার বাইরে অনুচ্ছেদ ১০০-এর অধীনে হাইকোর্ট বিভাগের সার্কিট বেঞ্চ স্থাপন করা যেতে পারে।

প্রস্তাবে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ জ্যেষ্ঠ বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি এই প্রস্তাবের সঙ্গে আংশিকভাবে একমত। দলটি তাদের মতামতে বলেছে, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বিবেচনায় রেখে প্রবীণতম তিনজন বিচারকের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা যেতে পারে।

স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস অংশে সংবিধানের অধীন একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। দলটি বলেছে, স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা আইনের মাধ্যমে ও পর্যায়ক্রমে হওয়া সমীচীন।

প্রস্তাবে সংবিধানের মূলনীতি অংশে বলা হয়েছে, কমিশন নিম্নোক্ত বিধান অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করছে। ‘বাংলাদেশ একটি বহুত্ববাদী, বহুজাতি, বহুধর্মী, বহুভাষী ও বহু-সংস্কৃতির দেশ, যেখানে সব সম্প্রদায়ের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে।’

অন্যদিকে রাষ্ট্রের মূলনীতি অংশে সংবিধানের মূলনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এসংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রে একমত নয় বিএনপি। দলটি দুই ক্ষেত্রেই বলেছে, অনুচ্ছেদ ৮, ৯, ১০ ও ১২-কে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ