<p>ভারতীয় উপমহাদেশে আরবি সাংবাদিকতার উজ্জ্বল নক্ষত্র, বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)-এর সুযোগ্য ভাগ্নে, দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার বর্তমান প্রধান আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মাদ রাবে হাসানি নদভির সহোদর মুহতারাম আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভি। তিনি একাধারে প্রখ্যাত আরবি সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, সাংবাদিক ও বহু  গ্রন্থপ্রণেতা। গত ১৬ জানুয়ারি বুধবার স্থানীয় সময় ভোর ৬টা ১৫ মিনিটে ইসলামী জ্ঞানের এই বটবৃক্ষ আখিরাতের পথে পাড়ি জমান।</p> <p>আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভি (রহ.)-এর জন্ম ১৯৩২ সালে। ভারতের উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলির তাকিয়া কিলাঁ গ্রামে। ধর্মীয় ঐতিহ্য ও আল্লাহভীতিতে তাঁর পরিবার ও বংশ ছিল প্রবাদতুল্য। বিশ্ববরেণ্য দাঈ ও চিন্তাবিদ আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)-এর স্নেহ-মমতায় তিনি বেড়ে উঠেছেন। মামা হওয়ার সুবাদে খুব কাছ থেকেই ক্ষণজন্মা এ মহাপুরুষের সান্নিধ্যে কাটে তাঁর শৈশব-কৈশোর। তাঁর চিন্তাদর্শন ও মননশীলতা ধারণ করেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ইসলামী জাগরণ, ঈমানি চেতনাবোধ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিন্তা-গবেষণা, মার্জিত রুচিবোধ, শৈল্পিক-মাধুর্যপূর্ণ ভাবনা এবং আরবি-উর্দু রচনাশৈলীতে তিনি ছিলেন আলী নদভির অবিকল নমুনা। ইংরেজিতেও তাঁর দক্ষতা ও পারঙ্গমতা ছিল অভাবনীয় ও ঈর্ষণীয়।</p> <p>প্রাথমিক শিক্ষা পারিবারিকভাবেই সম্পন্ন করেন। ইসলামী ও আরবি ভাষা শিক্ষা লাভ করেন লখনউর দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায়। এরপর আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৫২ সালে ইংরেজিতে অনার্স সম্পন্ন করেন। </p> <p>কর্মজীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করেন তিনি। নদওয়ার আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ডিন, ইসলামী দাওয়াহ ইনস্টিটিউটের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। এ ছাড়া আরবি ও উর্দু ভাষায় গবেষণাধর্মী রচনাকর্মে সদা সিদ্ধহস্ত ছিলেন।</p> <p>তিনি ‘রাবেতুল আদব আল ইসলামী আল আলমি’ (আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা) ও ‘আল মুজাম্মাউল ইসলামী আল ইলমি’র (ইসলামী গবেষণা একাডেমি) সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। ভারতের অন্যতম খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ড. আবদুল্লাহ আব্বাস নদভি (রহ.)-এর মৃত্যুর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দারুল উলুম নদওয়ার শিক্ষাবিভাগীয় প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।</p> <p>আল্লামা মুহাম্মদ ওয়াজেহ রশিদ নদভি (রহ.) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে আরবি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার উজ্জ্বল পথিকৃৎ। আরবি ভাষা ও ইসলামী সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি যদি তাঁর সাধারণ যোগ্যতা হয়, সাংবাদিকতা ছিল তাঁর বিশেষত্ব। ইসলামী জ্ঞান, আরবি ভাষাতত্ত্ব ও সাহিত্য-সংস্কৃতির দক্ষতা তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামাতেই অর্জন করেন। সেখানেই গড়ে ওঠে সাংবাদিকতায় তাঁর সূচনাযাত্রা। পরবর্তীকালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষায় উচ্চতর জ্ঞানার্জন তাঁর সাংবাদিক জীবনে সবিশেষ সহায়ক হয়।</p> <p>তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে আরবি বিভাগের উপস্থাপক হিসেবে সুদীর্ঘ ২০ বছর কর্মরত ছিলেন। এ সময় আল্লাহপ্রদত্ত মেধা ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে আরবি সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজি সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইসলামী চিন্তা-চেতনা, পশ্চিমা সভ্যতা, সাহিত্য সমালোচনা, অনুবাদ-সাহিত্য, পাশ্চাত্যের ছুড়ে দেওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান-অভিজ্ঞান অর্জন করেন। সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়েও প্রভূত অভিজ্ঞতা লাভ করেন।</p> <p>দীর্ঘ ২০ বছরে (১৯৫৩ থেকে ১৯৭৩ সাল) আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভির দক্ষ হাতে প্রচুর কাজ সম্পন্ন হয়। তাঁর নিপুণ ও শক্তিধর কলম দিয়ে সমসাময়িক বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাড়াও রাজনীতি ও সাহিত্য বিষয়ে বিপুল গবেষণাকর্ম রচিত হয়। প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গল্প ও নাটক। যার বেশির ভাগই প্রচারিত হতো আরবি ভাষায়। কিছু দিল্লি থেকে সম্প্রচার হতো, আর কিছু প্রচারিত হতো অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে। অন্যদিকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর গবেষণাকর্মগুলো পাঠকের ভূয়সী প্রশংসা কুড়ায় এ সময়।</p> <p>১৯৭৩ সালে তিনি যোগ দেন নদওয়াতুল উলামায়। আরবি ভাষা ও ইসলামী সাহিত্যে শিক্ষকতা ও লেখালেখির পাশাপাশি তিনি পাক্ষিক আরবি পত্রিকা ‘আর-রায়িদ’-এর সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। মাসিক আরবি পত্রিকা ‘আল-বায়াসুল ইসলামী’র সহকারী সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। তাঁর পরিচালনায় নিয়মিত প্রকাশিত হয় নদওয়ার ইংরেজি মুখপত্র ‘দ্য ফ্রাগরেন্স অব ইস্ট’ (The Fragrance of East)। ভারতের বুকে আরবি সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেন ভারতের  ‘প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড’।</p> <p>ভারতসহ অনেক দেশের বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে তিনি আমন্ত্রিত হতেন। বিশেষ করে ‘আন্তর্জাতিক ইসলামী সাহিত্য সংস্থা’র উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনগুলোতে। তার মধ্যে কায়রো, ওমান, লাহোর, তাসখন্দ, মক্কা আল-মুকাররমা, লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, রিয়াদ, মদিনা মুনাওয়ারা ও ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সগুলো অন্যতম। ১৯৯৪ সালে তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন চট্টগ্রামের জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়ার সাহিত্য সেমিনারে।</p> <p>আরবি ভাষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার বোদ্ধা ও বিদগ্ধজনের চোখে আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভি (রহ.) ছিলেন ইসলামের একজন দক্ষ ও শক্তিশালী লেখক। সমসাময়িক রাজনীতি, ইসলামী চিন্তা-চেতনাসহ আন্তর্জাতিক নানা বিষয় নিয়ে লেখা তাঁর কলামগুলো আরব বিশ্বের তুখোড় ও প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিকদের লেখার সঙ্গে ভালোই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা রাখত। বিশেষ করে ‘আর-রায়িদ’, ‘আল-বায়াসুল ইসলামী এবং দিল্লি থেকে মুদ্রিত ‘সাকাফাতুল হিন্দ’ নামক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত তাঁর কলামগুলো ছিল অসাধারণ। পাক্ষিক ‘আর-রায়িদ’-এ তাঁর সম্পাদকীয় এবং ‘আল-বায়াসুল ইসলামী’-তে নিয়মিত প্রকাশিত তাঁর ‘সুয়ারুন ওয়া আওদা’ শীর্ষক কলামগুলো ইসলামী আরবি সাংবাদিকতার উজ্জ্বল নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।</p> <p>আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আশফাক আহমদ নদভি বলেন, ‘ওয়াজেহ রশিদ নদভি একজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিক, সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কীর্তিমান অনুবাদক, আরবি ভাষাবিদ, আধুনিক ও প্রাচীন উভয় আরবি সাহিত্যে সমান দক্ষ ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে সমধিক বিজ্ঞ। ইংরেজি ভাষায়ও তিনি পারদর্শী। যা তাঁর পাশ্চাত্য সংস্কৃতি-কলা ও সাহিত্যজ্ঞানের পরিধিকে সুবিস্তৃত করেছিল। আরবি ভাষায় প্রসিদ্ধ ভারতীয় সাংবাদিকদেরও অন্যতম ছিলেন তিনি। সাংবাদিকতায় তাঁর স্বতন্ত্র একটা শৈলী ছিল। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিটি ঘটনার রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ করতেন তিনি। তাঁর লেখা দেখে কখনোই মনে হতো না, তিনি একজন মাওলানা এবং ইসলাম ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না; বরং মনে হতো, প্রাচ্যজ্ঞানের পাশাপাশি পাশ্চাত্যজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও তিনি পূর্ণ দক্ষতার অধিকারী ও গভীর পর্যবেক্ষক। যিনি সমাজের শিরা-উপশিরায় হাত রেখে চলতেন এবং রাজনীতি ও সাহিত্যের প্রতিটি পরিবর্তন থাকত তাঁর নখদর্পণে।’</p> <p>আজ আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভি নেই। তবে পেছনে রেখে গেছেন বহু গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থী ও কীর্তিকর্ম। রেখে গেছেন শিল্প-সাহিত্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিক্ষা ও সাংবাদিকতা, ইতিহাস ও জীবনীমূলক আরবি-উর্দু ভাষায় অনেক মৌলিক ও অনূদিত গ্রন্থ। সেসব গ্রন্থের মধ্যে ০১. তারিখুল আদাবিল আরবি। ০২. আদাবুস সাহওয়াহ আল-ইসলামিয়্যাহ। ০৩. হারকাতুত তালিমিল ইসলামী ফিল হিন্দি ওয়া তাতাওউরুল মানহাজ। ০৪. আদ দাওয়াতুল ইসলামিয়্যাহ ওয়া মিনহাজুহা ফিল হিন্দ। ০৫. মুখতাসারুল শামায়িলিন নববিয়্যাহ। ০৬. ইলা নিজামিন আলামিয়্যিন জাদিদিন। ০৭. আল ইমাম আহমদ বিন ইরফান আশ শহিদ। ০৮. মিন সানায়াতিল মাওতি ইলা সানায়াতিল কারারাত। ০৯. আ-লামুল আদাবিল আরবি ফিল আসরিল হাদিস। ১০. আশ-শাইখ আবুল হাসান নদভি কায়িদান ওয়া হাকিমান। ১১. ‘মাসাদিরুল আদাবিল-আরাবি’ অন্যতম।</p> <p>মহান আল্লাহ সম্মানিত উসতাজ আল্লামা ওয়াজেহ রশিদ নদভির জীবনের ভুলত্রুটি ক্ষমা করুন। তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মর্যাদা দান করুন। শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, ছাত্র-শিক্ষার্থী ও ভক্ত-অনুরক্তদের সুন্দরভাবে ধৈর্য ধারণের তাওফিক দান করুন।</p> <p>লেখক : কর্মকর্তা, বাংলাদেশ দূতাবাস</p> <p>রিয়াদ, সৌদি আরব</p>