<p>নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের বাসিন্দা দীপক রবিদাস। বাবা কালা রবিদাস পেশায় মুচি। দাদাও করতেন জুতা সেলাইয়ের কাজ। পশুর চামড়া সংগ্রহ করে লবণজাত করার কাজও করেন দীপক। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই সহপাঠী ও প্রতিবেশীদের আচরণে বুঝতে পারেন তিনি সমাজের মূলধারা থেকে কত বিচ্ছিন্ন! মোটামুটি অবস্থাপন্ন মুসলমান বা উচ্চবর্ণের হিন্দু ঘরের কোনো শিশুই মিশতে চাইত না তাঁর সঙ্গে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা করলেও মুচির কাজ ছাড়া তেমন কিছু মাথায় আসেনি দীপকের। শুধু দীপক নন, তাঁর গ্রামের বাসিন্দাসহ সারা দেশের দলিতদের মনস্তাত্ত্বিক গঠন অনেকটা এমনই। শুধু কি তাই! দেশের অনেক অঞ্চলের দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের চায়ের দোকান, রেস্তোরাঁ, বিয়ে বাড়িতেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। জলবায়ুর করাল গ্রাসে বিপর্যস্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের দলিতরাও নানাভাবে নিষ্পেষিত। দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক বঞ্চনা, অস্পৃশ্যতা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে বৃত্তের বাইরে গিয়ে চিন্তা করতেই ভুলে গেছে ‘নিচু বর্ণের হিন্দু’ তথা ‘দলিত’ সম্প্রদায়।</p> <p>সারা দেশের প্রায় ৬৫টি জনগোষ্ঠী দলিত হিসেবে চিহ্নিত। অস্পৃশ্যতা, সামাজিক বৈষম্য, চাকরিতে সুযোগ কম পাওয়া, শিক্ষা ও দরিদ্রতা দিন দিন আরো পশ্চাৎপদ করছে দলিত জনগোষ্ঠীকে।</p> <p>দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ দলিত সম্প্রদায়কে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কিছু অনুসরণীয় পদক্ষেপ নিলেও বৈষম্য কমাতে বৈষম্য বিলোপ আইনটিও পাস করতে পারেনি সরকার। সাংবিধানিকভাবে সব নাগরিকের সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে আইনটি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৬৫ লাখ দলিত জনসংখ্যা আমলে নিয়ে কাজ করা উচিত বলে মনে করেন অধিকারকর্মীরা।</p> <p>বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের (বিডিইআরএম) সাংগঠনিক সম্পাদক ভিমপাল্লী ডেভিড রাজু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব এলাকার দলিতরাই নিষ্পেষিত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান কোনো দিক থেকেই স্বস্তিতে নেই দলিত সম্প্রদায়। ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা থাকলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়েই অধিকাংশ শিশু ঝরে যায়। উত্তরাঞ্চলের দলিতরা চরম অস্পৃশ্যতার শিকার। দলিতদের বাদ দিয়ে সরকারের এসডিজির লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হতে পারে।’</p> <p>জানা গেছ, সারা বিশ্বে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২৬ কোটি। এর মধ্যে ২১ কোটি বাস করে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর এই দক্ষিণ এশিয়াতেই দলিতরা সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষিত এবং নিগৃহীত বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে দলিত জনগোষ্ঠীর সঠিক সংখ্যা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। দলিত অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বাংলাদেশে ৬৫ লাখ দলিতের কথা বলে আসছে। কিন্তু জনমিতিতে দলিত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে কোনো তথ্য না থাকায় তাদের সঠিক সংখ্যা নেই সরকারের কাছে। সংখ্যা যাই হোক, দলিত জনগোষ্ঠী সম্পর্কে দেশে প্রথমবারের মতো ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে তাদের কথা উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরপর ২০১০ সালে দলিতদের জীবনমান উন্নয়নে আলাদা অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হয়।</p> <p>পরবর্তী সময়ে ২০১০-১১ অর্থবছরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির মাধ্যমে দলিত, হরিজন এবং বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করে সরকার। ওই সময় দলিতদের নিয়ে আলাদাভাবে কর্মসূচি নিলেও অদৃশ্য কারণে বর্তমানে দলিত শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত রয়েছে সরকার। ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দলিতদের জন্য আলাদা বরাদ্দ না দিয়ে ‘অনগ্রসর জনগোষ্ঠী’ নামে বরাদ্দ দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। ফলে দলিতদের প্রতি বৈষম্য আরো বেড়েছে বলে মনে করছেন দলিত অধিকারকর্মীরা।</p> <p>এদিকে বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪, ২৭, ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় বৈষম্যের শিকার ব্যক্তির পক্ষে আদালতের আশ্রয় নেওয়া কঠিন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার শিকার হলেও বিচারের আশ্রয় নিতে পারে না তারা। এ ছাড়া আইন না থাকার কারণে থানায় মামলা করার হারও অনেক কম। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং আইন কমিশন দলিত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বৈষম্য বিলোপ আইনের খসড়া তৈরি করেছে। খসড়া আইনটি বর্তমানে আইন বিচার এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আইনটি বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনটি আলোর মুখ দেখেনি।</p> <p>বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে বৈষ্যমের শিকার দলিত জনগোষ্ঠী। চুয়াডাঙ্গা, পঞ্চগড়, দিনাজপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে অস্পৃশ্যতার বিষয়টি প্রকট। খসড়া তৈরি হলেও বৈষম্য বিলোপ আইনটি এখনো পাস হয়নি সংসদে।’</p> <p>আইনমন্ত্রী আনিসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈষম্য বিলোপ আইনটির খসড়া তৈরি হয়েছে। তবে এর বেশ কয়েকটি বিষয় এখনো আমাদের বিবেচনার মধ্যে রয়েছে। আইনটি অবশ্যই পাস করা হবে।’</p>