<p><strong>‘বনছাতারে পাখিকেই লোকে সাত ভায়লা, সাত ভাই, সেভেন সিস্টারস ইত্যাদি নামে ডাকে। নাম যা-ই হোক না কেন, নিরঙ্কুশ বনবাসী নয় বনছাতারে পাখি; লোকালয়েও এরা দাপটের সঙ্গে বাস করে। শালিকের মতো ছোট ও নিতান্ত সাদামাটা পাখি হলেও বনছাতারের ভয়ে তটস্থ থাকে সাপখোপসহ নানা কিসিমের বন্য প্রাণী। মানুষের মতোই এরা সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রাখে চারদিকে এবং শত্রু দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে</strong></p> <p> </p> <p>হঠাৎ নগরীর আবাসিক এলাকায় ঢুকে চোখ পাকিয়ে চেঁচামেচি শুরু করল মেটে রঙের ছয়-সাতটি পাখি। জানালা দিয়ে মাথা বের করে একজন বললেন, ‘আরে, এখানে বনছাতারে এলো কোত্থেকে!’ দারোয়ানের দল চেঁচিয়ে বলল, ‘সাত ভায়লা, সাত ভায়লা পাখি।’ বনছাতারে পাখিকেই লোকে সাত ভায়লা, সাত ভাই, সেভেন সিস্টারস ইত্যাদি নামে ডাকে। নাম যা-ই হোক না কেন, নিরঙ্কুশ বনবাসী নয় বনছাতারে পাখি; লোকালয়েও এরা দাপটের সঙ্গে বাস করে। এককালে ঢাকা নগরীর সবখানে দেখা যেত এ পাখি। আমাদের পুষি বিড়াল ঘর থেকে বের হলেই ওরা সদলবলে ছুটে আসত আর বিরতিহীন শোরগোল শুরু করত। বিড়াল বেচারা লেজ গুটিয়ে গৃহে প্রস্থান না করা পর্যন্ত ওদের দাপাদাপি আর হৈচৈ ক্ষান্ত হতো না। কোনো দিন নর্দমা থেকে একটি ঢোড়া সাপ বেরিয়ে এলে বনছাতারে পাখিদের উত্তেজনা আর হাঁকডাক তুঙ্গে উঠত। ওদের চেঁচামেচিতে কানে তালা লাগত। সাপের কান নেই বলে তালা লাগার আশঙ্কা ছিল না। তবু পাখির লাফালাফি, ওড়াউড়ি আর হুমকির মুখে সে সরে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালাত। অনেক সময় সাপ বেচারা পালানোর পথ পেত না। পাখির শোরগোলে আকৃষ্ট হয়ে পাড়া-পড়শিরা এগিয়ে আসত এবং তাদের লাঠির আঘাতে সর্প নিধনের পুণ্যকাজটি শেষ হলেই চেঁচামেচি থামিয়ে বনছাতারের দল নিরুদ্দেশ হতো।</p> <p>শালিকের মতো ছোট ও নিতান্ত সাদামাটা পাখি হলেও বনছাতারের ভয়ে তটস্থ থাকে সাপখোপসহ নানা কিসিমের বন্য প্রাণী। মানুষের মতোই এরা সর্বক্ষণ সতর্ক দৃষ্টি রাখে চারদিকে এবং শত্রু দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। লুসাই ও  কুকি জাতির লোকজন বিশ্বাস করে, সূর্যগ্রহণের সময় অসতর্ক মানুষ বনছাতারে হয়ে যায়। মানুষের মতোই বনছাতারে পাখিরা শত্রুমুক্ত রাখতে চায় তাদের বিচরণভূমি এবং সফলকামও হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। তুচ্ছ এ পাখির এই সুপারপাওয়ারের কেন্দ্রে রয়েছে সর্বদা দলবদ্ধ থাকা আর ‘সন্দেহজনক’ কিছু চোখে পড়ামাত্র তারস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করার আগ্রহ। বনছাতারের চেঁচামেচি শুনলেই শিকরে, বাজ ও অন্যান্য শিকারি পাখি সেদিকে ছুটে যায়। ওরা জানে, ওখানে গেলেই সাপ, নেউল, কাঠবিড়ালি, গিরগিটি ইত্যাদি শিকার করার সুযোগ মিলবে। মানুষ বনে ঢুকলেও বনছাতারের দল জোরগলায় প্রতিবাদ করে। জানি না যে বনে বাঘ আছে, সেখানে বনছাতারের এই আচরণ আমাদের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে কি না! বাঘ তো শিকারি পাখির চেয়ে কম বুদ্ধিমান জীব নয়।                </p> <p>ভারতবর্ষ ছাড়া বিশ্বে আর কোথাও বনছাতারে নেই। এমনকি শ্রীলঙ্কা ও মায়ানমারেও নেই এ পাখি। বাংলাদেশ থেকে নেওয়া বনছাতারের নমুনা দিয়েই ফরাসি পাখিবিদ চার্লস হেনরি ফ্রেদেরিক প্রথম একে বৈজ্ঞানিক তালিকাভুক্ত করেন। সর্বভুক এ পাখি ছয় থেকে ১০টি করে দলে থাকে। দল বেঁধেই করে জীবনের সব কাজ, এমনকি প্রজননও। সদলবলে ছানা পালনের কাজ করে বলে বনছাতারের ছানার মৃত্যুহার কম। আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বনছাতারের বাসায় পাকরা কোকিল এসে ডিম রেখে যায়। ওরা সানন্দে সেই ডিমে তা দিয়ে কোকিলছানাকে বড় করে আবার নিজেরা ডিম দিতে শুরু করে। তিন বছর বয়স হলেই মেয়েরা ডিম দিতে পারে। ইন-ব্রিডিং বা অন্তঃপ্রজনন এড়িয়ে চলার জন্য দুই বছর বয়স হলে মেয়েরা মা-বাবার দল ছেড়ে নতুন দলে ভিড়ে যায়। এই জন্য বনছাতারে পাখিকে ‘সেভেন সিস্টারস’ না বলে ‘সাত ভাই’ বলাই বোধ হয় ভালো।</p> <p> </p> <p> </p>