<p>অবিশ্বাস্য মনে হলেও আমাদের নগরীর কেন্দ্রে আজও বেঁচে আছে শতাধিক নিশিবক। বহুদিন হলো এখান থেকে উত্খাত হয়ে গেছে কানিবক আর গোবগার মতো বল্লম-চঞ্চু অনেক পাখি। কিন্তু এখনো দেখতে পাই ওদের উত্তরজীবী নিশিবকগুলো ডানা নেড়ে উড়ে চলে সন্ধ্যার আকাশে। বিকেল গড়িয়ে গেলে শোরগোল করে টিয়া, কাক আর ভুবনচিলেরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় নগর পেরিয়ে দক্ষিণে রাতের নিবাসে। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলে শূন্য হয় পথবাতিতে আলোকিত নগরীর নক্ষত্রহীন আকাশ। তখনই চোখে পড়ে সাদা ডানা নেড়ে সার বেঁধে উড়ে চলা সুশৃঙ্খল নিশিবক। ঘরমুখো মানুষের গাড়ির নিরবচ্ছিন্ন হর্নের শব্দ ছাপিয়ে নিশিবকের ‘ওয়াক, ওয়াক’ ডাক শুনতে পাই মাঝে মাঝে। পরিচিত এই ডাকের জন্যই বাংলার গ্রামগঞ্জে নিশিবকের নাম ‘ওয়াক পাখি’। একই কারণে এর হিন্দি নামটি হয়েছে ‘কোয়াক’। </p> <p>‘ওয়াক, ওয়াক’ ডাক দিয়ে নিশিবকেরা উড়ে যায় এই নগরীর অকিঞ্চিত্কর নদী-নালা আর খানা-ডোবার দিকে। তারপর ওরা ওই সব অভিধর্ষিত জলাধারের কলুষিত কিনারায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে সারা রাত। বাঙালির খাদ্যতালিকার শীর্ষে আছে বলে মাছ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে নগরীর সব জলাধার থেকে। তবে এখানে মাছ না থাকলেও সাপ, ব্যাঙ, শামুক ইত্যাদি জীব দু-চারটে আজও টিকে আছে। আমাদের জন্য ‘অখাদ্য’ এসব জীব খেয়েই জীবন চলে নিশিবকের। তাই দু-একটি সাপ-ব্যাঙ শিকার করার আশায় পানিতে পা ডুবিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থেকে নিশিভোর হয় নগরীর সব নিশিবকের। নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকাটাই নিশিবকের সেরা শিকার-কৌশল। আর সব বকের মতো সে ধাওয়া করে যায় না শিকারের পিছু পিছু। নিশ্চল দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি তার নাগালের মধ্যে আসে। হৃত্স্পন্দন কমিয়ে রাখার জন্য সম্ভবত সে মেডিটেশনও করে। কারণ স্পন্দন বাড়লে তার শরীর থেকে ইনফ্রারেড রশ্মি বেশি ছড়াবে এবং সাপ বুঝে ফেলবে তার উপস্থিতি। তাই রাতের আঁধারে সবচেয়ে কম শ্রমে সাপখোপ শিকার করার অনন্য এই পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে বুদ্ধিমান নিশিবক।</p> <p>বাংলাদেশের সর্বত্র আপনি নিশিবকের দেখা পাবেন। এর পোশাকি নাম ‘কালোমাথা নিশিবক’ এবং ইংরেজি নাম ‘ব্ল্যাক ক্রাউন্ড নাইট হেরন’। এর মজাদার আন্তর্জাতিক নামটি হলো ‘নিক্টিকোরাক্স নিক্টিকোরাক্স’। নিক্টিকোরাক্স অর্থ ‘নিশি-কাক’। আসলেই কাকের মতো বুদ্ধি এবং লোকালয়ে টিকে থাকার দক্ষতা রাখে নিশিবক। এরা শুধু বাংলাদেশ নয়, এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও দুই আমেরিকার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বে কালোমাথা নিশিবকের বৃহত্তম কলোনি রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার ওকল্যান্ড নগরীতে। নিশিবকই ওই নগরীর অফিশিয়াল সিটি বার্ড।</p> <p>ফ্লাশ দিয়ে তোলা একটি পূর্ণবয়স্ক নিশিবকের ছবি দেখুন। শিকারের জন্য সারা রাত এভাবেই তাক করে থাকে নিশিবক। চ্যাংড়া পাখি দেখতে একেবারেই অন্য রকম; তার বাদামি পালকে সাদা সাদা ফোটা। তিন বছর বয়স হলে চ্যাংড়ার গায়ে সাবালকের এই সাদা-কালো পালক হয় এবং প্রজনন মৌসুমে মাথার পেছনে ঝুলে থাকে সাদা পালকের দীর্ঘ দুটি ঝুঁটি। আমাদের দেশে আরো দুই প্রজাতির নিশিবক দেখা গেছে; কিন্তু তাদের বিস্তৃতি অত্যন্ত সীমিত। একমাত্র কালোমাথা নিশিবক ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। এ দেশের জলাশয়ে যত দিন সাপ-ব্যাঙের ছানাপোনা হবে, তত দিন এরা টিকে থাকবে।</p> <p> </p> <p> </p>