২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। সেদিন বিকেলে রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা ছাত্রনেতা আবু সাঈদ। কিন্তু ঢাকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক চিত্র দেখা যায়। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে তখন আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা ও মন্ত্রী আবদুর রহমান তাঁর অফিসে অনায়াসে বসে স্থানীয় এক কবির কবিতা পাঠ উপভোগ করছিলেন।
কিছুক্ষণ পর, একজন সহকারী যখন তাঁকে সাঈদের হত্যার পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার খবর জানান, তিনি বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ও কিছু হবে না। নেত্রী সামলে নেবেন।’
দেশজুড়ে যখন সহিংস পরিস্থিতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল, তখন একজন মন্ত্রীর এমন স্বাভাবিক আচরণ অনেকের কাছে আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিন সপ্তাহের মধ্যেই শেখ হাসিনার সরকার ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়।
তাতে অন্তত ৮৩৪ জন নিহত হন বলে সরকারি হিসাবে বলা হয়। আরো ২০ হাজার জন আহত হয়েছেন। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনের পর্দা নামে।
তৃণমূল বনাম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব : বিভক্ত দল
অনেক আওয়ামী লীগ নেতা এখনো দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন।
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাছিম ১৬ জানুয়ারি একটি অজানা স্থান থেকে আলজাজিরাকে ফোনে বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। এটা শিগগিরই প্রমাণিত হবে।’ তবে তিনি স্পষ্ট করেননি, তিনি কাকে অভিযুক্ত করছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন দাবি দলটির ব্যর্থতা স্বীকার করতে না পারা এবং জনগণের অসন্তোষ মোকাবেলায় অক্ষমতার পরিচায়ক। দলটির তৃণমূল কর্মীরাও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।
তাঁদের অনেকেই এখন আত্মগোপনে বা হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে আইনি প্রক্রিয়া নিয়ে ভীত।
ছাত্রলীগের একজন সিনিয়র স্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আলজাজিরাকে বলেন, ‘যখন এই নাটকীয় পালানোর দৃশ্য (শেখ হাসিনার পালানোর) টিভিতে সম্প্রচারিত হচ্ছিল, তখন আমি খুলনার রাস্তায় কিছু কর্মীর সঙ্গে ছিলাম। আমি স্থানীয় এমপির কাছে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তাঁর ফোন বন্ধ ছিল। তখনই আমি নিজেকে প্রতারিত মনে করেছি।’
অনেক সদস্য নীরব থাকলেও কৃষক লীগের সহকারী সম্পাদক সামিউল বশির সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফরমগুলোতে সরব। আলজাজিরাকে তিনি বলেন, কমিটেড কর্মীদের বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০১৪ সালের পর থেকে সুবিধাবাদী ও স্থানীয় এমপিদের পরিবারের সদস্যরা তৃণমূল পর্যায়ের কাঠামো দখল করে নিয়ে এসেছেন। এটিই এই বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
অনুশোচনা নেই আওয়ামী লীগ নেতাদের
আওয়ামী লীগ এখনো ‘জুলাই আন্দোলন’-এর সময় তাদের সরকারের কঠোর পদক্ষেপের জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো ক্ষমা প্রার্থনা বা বিবৃতি দেয়নি। বরং দলটি বারবার এই আন্দোলনকে অস্বীকার করেছে। উদাহরণস্বরূপ যুবলীগের ১০ জানুয়ারির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। নাছিম স্বীকার করেছেন, তাঁদের দল ‘কৌশলগত ভুল’ করেছে। তবে এর ব্যর্থতার জন্য তিনি মূলত ‘গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতাকে’ দায়ী করেছেন। আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সম্প্রতি ভারতের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আওয়ামী লীগ ‘ইসলামী সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভ্যুত্থানের’ শিকার হয়েছে। তবে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতি, লুটপাট ও কোটি কোটি টাকা পাচারের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাইতে হবে। আমি এখনো আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা বা অপরাধ স্বীকারের কোনো প্রমাণ দেখিনি।’
ফিরে আসা সহজ হবে না
ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞানের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামানের মতে, আওয়ামী লীগ এখন গুরুতর নেতৃত্ব ও ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে। শেখ হাসিনা ছাড়া দলের পুনর্গঠন কঠিন হবে এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজনও বাড়বে।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানের জন্য চারটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। সেগুলো হলো ১৬ বছরের শাসনামলে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সময় সংঘটিত অপরাধের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া; দলের বর্তমান মতাদর্শ পরিত্যাগ করা; শেখ হাসিনার পরিবারের কোনো সদস্যকে আর নেতৃত্বে না রাখা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধসহ সব নৃশংস অপরাধের বিচার নিশ্চিত করা। সূত্র : আলজাজিরা